গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০২০

উত্তম বিশ্বাস

ভারা
                                             


এই বয়েসেও অনেকটা লোড নিতে পারেন পরান কাকা। কিন্তু ঘাটের নিয়ম পঞ্চাশজনের অধিক একটা পোষা পায়রাও নৌকোয় তোলা যাবেনা। কেননা পরান কাকার নৌকোটা বড্ড পাতলা আর অনেকদিনের পুরোনো। এমনিতেই সমুদ্র শঙ্খিনী নদী, তার ওপরে বর্ষায় উত্তাল! সকালের দিকে অনেকটা চাপ থাকে। দুটো তিনটে ট্রিপে পরান কাকা ওদের ভাগ করে নেন। তারপর আস্তে ধীরে পার করেন। এতে ওর শশীরে ধকলও পড়ে বেশি। কিন্তু সংসার বড় বালাই, সে মারী মহামারী কিছুই বোঝে না! তাছাড়া সকাল হতে না হতে গলুইয়ে খুচরো পয়সার ঝিকিমিকি চাঁদ সূর্য না দেখতে পেলেও পরান কাকাও কেমন যেন অঞ্জালা অনুভব করেন! অথচ বেশ কয়েকদিন হল উনি কাউকেই তুলছেন না। এ নিয়ে ফেরিঘাটে বেশ কদিন ধরে চাপা উত্তেজনা চলছে। কিন্তু কেউই মুখ খোলার সাহস দেখায় না। এতবড় একখান নৌকো নিয়ে প্রিয়তোষ একাই নদী পার হচ্ছে! দূর দেহাতের অসংখ্য মানুষ ফেরিঘাটে এসে এমন দৃশ্য দেখেন আর এ ওর মুখের দিকে চেয়ে আকচাআকচি করেন। প্রিয়তোষের বাবার ভয়ে পরান কাকাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। 

এমনিতেই ওরা প্রভাবশালী, তার ওপর প্রিয়তোষ শহরের মস্ত বড় অফিসার। ওর বাবার হুকুম
- আমার ওই একটামাত্র চোখ! খুব সাবধান পরান! ছোঁয়াচ যদি লাগে, নদীতে পেট্রল ঢেলে সবশুদ্ধ জ্বালিয়ে দেব মাথায় রেখো! পরান কাকার গলা শুকিয়ে আসে,
- আমারও তো সিকি গোনা সংসার! ভয় কি আমারও করেনা! ওদের এতো বলি এট্টু ফাঁক রেখে দাঁড়া, কিন্তু কে শোনে কার কথা!
- দরকারে দ্বিগুন ভাড়া দেব সেও স্বীকার, কিন্তু নৌকাটি তো আমার। ওতে আম আমড়া একসাথে তোলার হুকুম আমি তো দিইনি!
দানের তরী বলে কথা! অর্থাৎ পরান কাকা আপাতত এতেই ঘাড় নাড়লেন। নৌকো আজ মাঝ নদীতে। এমন সময় প্রিয়তোষের নজরে এল, পাটাতনের নিচে অনেকগুলো পাথর।

প্রিয়তোষ চশমা মাথায় তুলে জিজ্ঞাসা করল
- কাকা, এসব কী?”
পরানের ঠোঁটে ফ্যাকাশে হাসি
,

-ও কিছু না, অপরাধের বোঝা বাপ!
টাল সামলে প্রিয়তোষ ধমক দিয়ে উঠল,“কীসের অপরাধ শুনি?”    
বুড়ো পরান মন্ডল মুখ কাচুমাচু করে বললেন
- জনমভর এতো ভার বয়েছি বাপ, এখন এই পাতলা খোসার মতো খালি নৌকোখানা নিয়ে নদীতে নামলেই চতুর্দিকে কেমন যেন চক্কর কাটে, সবকিছু উল্টো দেখি!
এবার প্রিয়তোষ বাঘের মতো নৌকোর খোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখন একটা একটা করে পাথর নদীর বুকে নিক্ষেপ করছে প্রিয়তোষ। 

এই অবসরে পরান কাকা একটা বিড়ি ধরালেন। হালটা ভেসে যাচ্ছে স্রোতে। আজ ওর মুখের ওপর ঝিকিয়ে পড়েছে আনকোরা আলো। মনের সুখে বিড়ি টানছেন পরানা কাকা। আর ওই নিকোটিন পোড়া ধোঁয়ার মধ্যে নৌকোটিকে নর্তকী রূপে দেখতে পাচ্ছেন পরান কাকা!