গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০২০

সুবীর কুমার রায়

গুরু-শিষ্য পরম্পরা




অবিবাহিত মুকুন্দবাবু মানুষটা একটু অদ্ভুত ধরণের। অর্ডার সাপ্লাই-এর ব্যবসা করে যেক’টা টাকা উপায় করেন, তাতে তাঁর একার সংসার সচ্ছলভাবে না চললেও ভালভাবেই চলে যায়। না, ভুল বললাম। একার নয়, বোধহয় দুজনের সংসার বললেই ঠিক বলা হবে। প্রায় চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেলেও, আজও তাঁর বিয়ে করার সুযোগ হয়নি। হয়নি, কারণ তাঁর গুরুদেবের বারণ।
তাঁর গুরুদেব, স্বামী পরমানন্দজী। কলকাতার বুকে বিরাট একটা দোতলা বাড়িতে তিনি বসবাস করেন। তিনি সংসার করেননি, ব্রহ্মচর্য পালন ও মানব সেবাই তার একমাত্র কারণ। প্রচুর শিষ্য-শিষ্যার প্রতিনিয়ত তাঁর বাড়িতে আগমন হলেও, বাড়ির একতলার একটি বেশ বড় হল ঘর, ও অপর একটি বড় ঘরেই তাঁদের আসা যাওয়া সীমাবদ্ধ ছিল। শোনা যায় তারাপীঠে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে তিনি তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করেন, যদিও কিছু শিষ্য-শিষ্যা বলেন, যে তারাপীঠ নয়, তবে অন্য কোন শ্মশানে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। পরনে টকটকে লাল ধুতি ও চাদর, বড় বড় গোঁফ দাড়িতে ঢাকা ফর্সা মুখটার, নাকের কাছ থেকে প্রায় চুল পর্যন্ত লাল সিঁদুরের চওড়া টিপ। দেখলেই ভয় না শ্রদ্ধায় বুঝতে না পারলেও, মুকুন্দবাবুর মাথাটা সম্ভবত শ্রদ্ধায় নীচু হয়ে যায়। মুকুন্দবাবুর সবথেকে বিশ্বাস ও আস্থা, এই গুরুদেবের ওপর। গুরুদেবের ইচ্ছায়, তিনি তাঁর মতোই নিষ্কাম নির্লোভ জীবন যাপন করার জন্য, নিজে বিয়ে পর্যন্ত করেননি। পঞ্চ মকারের প্রথম দুটি, অর্থাৎ মদ ও মাংসের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ থাকলেও, এবং প্রতি শনিবার রেসের মাঠে গেলেও, তাঁর অন্য কিছু পার্থিব জিনিসের ওপর বিন্দুমাত্র লোভ নেই। গুরুদেবের আদেশ ও ইচ্ছা পালন করবার জন্য, প্রতিমাসে মানব সেবার জন্য ক্ষমতার অধিক অর্থ গুরুদেবের হাতে হাসিমুখে তুলে দিতে গিয়ে তাঁর ভবিষ্যতের জন্য কোন সঞ্চয় না হলেও, প্রায় প্রতি মাসে ঋণের পরিমাণ বেড়েই যায়। তবু এই নিয়ে তাঁর মনে কোন দুঃখ ছিল না। গুরুদেব তাঁকে বারবার উপদেশ দিয়েছেন, “বেটা ল্যাংটা অবস্থায় এসেছিস। সময় হলে ডাক আসলেই, ল্যাংটা অবস্থাতেই পরম পিতার কাছে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে। শুধু শুধু এইক’টা দিন অর্থ ও অন্যান্য পার্থিব জিনিসের ওপর লোভ করে নরকবাস করবি কেন? যতদিন এই ধরায় আছিস, নিষ্কাম নির্লোভ জীবন যাপন কর। গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর, এই গুরুর ওপর আস্থা রাখ, আমিই তোকে পুণ্যের পথ, স্বর্গের পথ দেখাবো”। সকলের চোখের অলক্ষ্যে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার পর সস্তার বারে গিয়ে বাদাম ও ভিজে ছোলা দিয়ে দু-এক পাত্র বাংলা মদ পান করে ও প্রতি শনিবার রেসের মাঠে গিয়ে তিনি বেশ সুখেই ছিলেন।
এক শনিবারে রেসের মাঠে গিয়ে হঠাৎ তাঁর অনেকগুলো টাকা প্রাপ্তি হয়। মুকুন্দবাবুর স্থির বিশ্বাস, তাঁর এই রেসের মাঠে আসার নেশার কথা গুরুদেবের অজানা হলেও, গুরুদেবের আশীর্বাদেই তাঁর এই আকস্মিক ও অস্বাভাবিক অর্থ প্রাপ্তি। তিনি তখনই মনে মনে স্থির করে ফেলেন, যে আগামীকাল সকালেই গুরুদেবের বাড়ি গিয়ে এই টাকার একটা বড় অংশ গুরুদেবের চরণে দিয়ে প্রণামটা সেরে আসবেন। প্রফুল্ল মনে আজ আর পরিচিত সস্তার বারটায় না গিয়ে, ট্যাক্সি নিয়ে পার্ক স্ট্রীটের খরচাসাপেক্ষ ওয়াইল্ড লাইফ বার কাম রেস্তোরাঁয় হাজির হলেন। স্বল্পালোকে বারের ভিতরটা একটা মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। কোণের দিকে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে স্কচের অর্ডার দিয়ে, মাংসের কি কি পদ নেওয়া যায় দেখার জন্য তিনি মেনু কার্ডে মনোনিবেশ করলেন। বেয়ারা এসে তাঁর টেবিলে একটা বাদাম ভাজার প্লেট ও স্কচের গ্লাসটা রেখে দিতে, তিনি চিকেনের দুটো প্রিপারেশন ও একপ্লেট স্যালাডের অর্ডার করলেন। বেয়ারা চলে গেল।
মুকুন্দবাবু সবে গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে দুটো বাদাম মুখে পুরেছেন, এমন সময় তাঁর নজর গেল সামনের একটা টেবিলের ওপর। বিশাল বিশাল দুটো চিকেন রোস্ট্ ও হুইস্কির গ্লাস নিয়ে একজন সৌম্য চেহারার ব্যক্তি একজন তন্বী যুবতীকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। ভদ্রলোকের পরনে নীল রঙের সুট, লাল টাই, গোঁফ দাড়ি কামানো, ব্যাক ব্রাশ করা চুলে ফর্সা সুন্দর মুখটা আরও সুন্দর লাগছে। আঁটসাঁট পোশাক পরিহিতা যুবতীটি ভদ্রলোকটির গায়ে প্রায় হেলান দিয়ে কাত হয়ে বসে আছেন আর মাঝেমাঝে চিকেন রোস্টে কামড় ও পানীয় গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে এত নীচু গলায় কথাবার্তা বলে হাসাহাসি করছেন, যে তাঁদের একটি কথাও তাঁর কানে পৌঁছচ্ছে না। ইতিমধ্যে খাবার দিয়ে গেছে। গুরুর আদেশ, তাই তাঁদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের খাবারে মন দিলেন। কিন্তু কি কারণে বুঝতে না পারলেও, তাঁর দৃষ্টি বারবার সামনের টেবিলেই চলে যাচ্ছে। কোথায় যেন ভদ্রলোককে দেখেছেন। রেসের মাঠে বা ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কাজে? নাঃ, কিছুতেই মনে করতে পারলেন না।
বেয়ারাকে বিল দিতে বলে, আজকের সুন্দর দিনটার কথা ও আগামীকালের কাজের একটা পরিকল্পনা স্থির করতে করতে ধীরে ধীরে বারকয়েক নতুন করে নেওয়া পানীয়র গ্লাস ও খাবার শেষ করে, তিনি একটু টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। বেশ কিছুক্ষণ আগেই সামনের টেবিলের দুজন খাওয়া শেষ করে তাঁর পাশ দিয়ে একটু বেসামাল ভাবেই চলে গেছেন। বেয়ারা এখনও বিল দিয়ে না যাওয়ায়, কাউন্টারে গিয়ে বিল মেটাতে গিয়ে তিনি তো অবাক। কাউন্টারের ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাঁকে জানালেন, “আপনার বিল তো পেমেন্ট হয়ে গেছে স্যার, রতনবাবু আপনার বিলের টাকা মিটিয়ে দিয়েছেন”। মুকুন্দবাবু একটু অবাক হয়ে জড়ানো গলায় বললেন, “আমার বিলের টাকা রতনবাবু মিটিয়ে দিয়ে গেছেন? কে রতনবাবু? আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে”।
“না স্যার আমার কোন ভুল হচ্ছে না। আপনার বিলের টাকা উনি মিটিয়ে দিয়ে বলে গেছেন, যে আমি যেন আপনার কাছ থেকে বিলের টাকা আর গ্রহণ না করি”। অগত্যা বেয়ারার হাতে কিছু টিপস দিয়ে, মৌরি মুখে দিয়ে মুকুন্দবাবু বার থেকে বেরোতে যাবেন, এমন সময় কাউন্টারের ভদ্রলোক তাঁকে ডেকে তাঁর হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন, “রতনবাবু এই খামটা আপনাকে দিতে বলে গেছেন। আসলে ওনার মতো একজন সম্ভ্রান্ত রেগুলার খদ্দেরের অনুরোধ আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। ভালো থাকুন, আবার দেখা হবে, শুভ রাত্রি”। 
বার থেকে বেরিয়ে কৌতুহল মেটাতে খামটা খুলে তাঁর চোখ তো কপালে উঠে গেল, নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। খামের মধ্যে একতাড়া দুহাজার টাকার নোট ও একটা চিরকুট। তাতে লেখা টাকাটা রেখে দিলে খুশি ও নিশ্চিন্ত হতাম, ইতি-রতন চন্দ্র মালাকার।
বাড়ি ফিরে মুকুন্দবাবু খামটা খুলে টাকাগুলো গুণে দেখলেন, পঞ্চাশটা দুহাজার টাকার নোট। হাজার চেষ্টা করেও তিনি রতন চন্দ্র মালাকার নামে কারও কথা মনে করতে পারলেন না। শেষে অনেক ভেবে ঠিক করলেন, যে আগামীকাল সন্ধ্যায় ওই বারে গিয়ে টাকাটা ফেরৎ দিয়ে আসবেন।
গতকাল রেসের মাঠে টাকাটা পেয়েই তিনি ঠিক করেছিলেন, যে আজ রবিবার ছুটির দিন, আজ তিনি গুরুদেবের বাড়িতে গিয়ে গুরুদেবকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে প্রণাম করে আসবেন। সেইমতো তিনি গুরুদেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তিনি ঠিক করলেন, যে গতকাল রাতের এক লাখ টাকাটার ব্যাপারে কি করা উচিৎ, গুরুদেবের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে আসবেন।
আজ রবিবার, গুরুদেবের বাড়িতে অন্যান্য দিনের তুলনায় ভক্ত সমাগম অনেক বেশি হয়। বড় হলটার ভিতর ভীষণ ভিড়, তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। অন্যান্য দিনের মতো গুরুদেবের বসার আসনটি ফুল দিয়ে সাজানো থাকলেও, গুরুদেব এখনও সেই আসন গ্রহণ করেননি। কিছুক্ষণ পরে ভিতর থেকে একজন এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে ভিতরে গেলেন। লোকটিকে তিনি চেনেন, প্রতিবার তাঁকে গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে থাকতে দেখেছেন। তিনি মুকুন্দবাবুকে নিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ধরলেন। মুকুন্দবাবু আজ পর্যন্ত কোনদিন দোতলায় ওঠেননি, অন্য কোন শিষ্যকেও দোতলায় উঠতে দেখেননি। তিনি লোকটিকে এ বিষয় কোন প্রশ্ন করার আগেই লোকটি তাঁকে বললেন, গুরুদেব আপনাকে একবার দোতলায় তাঁর ঘরে নিয়ে যেতে বলেছেন।
লোকটি তাঁকে গুরুদেবের ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। ঘরটি বিশাল ও খুব সুন্দর সুন্দর আসবাব দিয়ে সাজানো। গুরুদেব তাঁকে তাঁর কাছে একটি চেয়ারে বসতে বললেন। মুকুন্দবাবু ব্যাগ খুলে প্রণামী বাবদ নিয়ে আসা টাকাটা বের করলেন। গুরুদেব তাঁকে হাতের ইশারায় নিরস্ত করে খুব নীচু গলায় বললেন, “মুকুন্দবাবু, টাকাটা পেয়েছেন তো? দয়া করে আপনি গতকাল সন্ধ্যার ঘটনাটা ভুলে যান। এবিষয়ে কাউকে কিছু বলবেন না। আপনি মুখ খুললে আমার ব্যাবসা রাতারাতি লাটে উঠে যাবে। আমি আপনার জন্যই এখনও নীচে না গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আপনি টাকাটা রেখে দিন, আরও চাইলে আমি দিতে প্রস্তুত। আশা করি আপনি আমার অনুরোধটা রক্ষা করবেন। আপনি এখন ফিরে যান, বিস্তারিত ভাবে পরে কথা হবে।
মুকুন্দ বাবু উঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি তাহলে...”
কথার মাঝখানে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে গুরুদেব বললেন, “হ্যাঁ, আমিই রতন চন্দ্র মালাকার, ওরফে আপনার প্রাক্তন গুরুদেব, স্বামী পরমানন্দজী। গতকাল সন্ধ্যায় ওয়াইল্ড লাইফ বার কাম রেস্তোরাঁর মতো একটা নির্জন জায়গায়, সামনের টেবিলে তোকে, মানে আপনাকে দেখবো আশা করিনি। আমায় ক্ষমা করে দিন। আপনি এখন মুক্ত, তবে ভবিষ্যতে যেকোন প্রয়োজনে, আমার দোতলার এই ঘরটি আপনার জন্য খোলা থাকবে। অনুগ্রহ করে আপনি এখন ফিরে যান।
মুকুন্দবাবু চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। রতনবাবু তাঁর সাথে হাত মিলিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ লোকটিকে ডাকলেন। লোকটি ভিতরে ঢুকে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসলেন।
ধীরে ধীরে প্রাক্তন গুরুদেবের অসীম কৃপায় মুকুন্দবাবুর সমস্ত ঋণ শোধ হয়ে আর্থিক সচ্ছলতা দেখা দিলো। সামনের মাঘে তাঁর বিয়ের দিনও পাকা হয়ে গেছে।