অন্তঃতদন্ত
কাশীপুরের ফুটবল-দলের ক্যাপ্টেন রমেশ একদিন মজার ছলে বলে
বসলো,’এখানকার মেয়েদের সঙ্গে খেলা হলে আমরা নির্ঘাত ৫০-১ গোলে জিতবো ।‘
ওর দলের অন্যতম স্টপার দিবাকর তখন বলল,’একটা গোলই বা আমরা
খাবো কেন ?’
রমেশ মুচকি-হেসে উত্তর দিলো,’ও খেতে হয় । মায়ের জাত না
? নাহলে কষ্ট পাবে যে ।‘
ওর কথা শুনে অন্য ফুটবল-সঙ্গীরা হেসে অস্থির ।
যাহোক,রমেশের সতীর্থদের কেউ বা অন্য এক সেকথা পৌঁছে দিলো
মেয়েদের দলের ক্যাপ্টেন সুদীপার কানে । ও শুনে খুব রেগে উঠলো ।
বলল,’কথায় কাজ হয় না । সে মাঠেই দেখা যাবে কাদের কত মুরোদ
। ফাজলামো নাকি আমাদের সাথে ?’
ওর সতীর্থরা সাহসের সঙ্গে তখন শপথ নিলো,’হয়ে যাক তবে ।
আমরা জন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে দিচ্ছি ওদের । ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি ওরা ?’
এক সপ্তাহের মধ্যে সেই খেলা । খুব দ্রুত ব্যবস্থা হয়ে গেলো
সব ।
সেদিন বিকালে কাশীপুর মাঠ লোকে-লোকারণ্য । শুধু কাশীপুর
নয়,আরও অনেক জায়গা থেকে অনেকে ছুটে এলো দুই বিপরীত মেরুর অভূতপূর্ব খেলা দেখতে ।
কিন্তু খেলা শুরু হতেই চমকের পর চমক । রমেশের নেতৃত্বে
ছেলেরা কেমন যেন জড়সড় । আর সেই সুযোগ নিচ্ছে মেয়েরা । পায়ে বল নিয়ে প্রায় অনায়াসে এগিয়ে
যাচ্ছে । রাইট স্ট্রাইকার দোলা তো ছেলেদের একেবারে দুলিয়ে দিচ্ছে ।
মিনিট কুড়ির মধ্যে মেয়েরা দুই গোল দিয়ে দিলো ছেলেদের ।
মাঠ-জুড়ে সেকি উল্লাস তখন । বেশ ব্যঙ্গের শিস খাচ্ছে ছেলেরা ।
পরের পঁচিশ মিনিট ছেলেরা কিছুটা তেড়েফুঁড়ে উঠতে চায় । কিন্তু
বারবার এক জায়গায় এসে ওরা থেমে যায় । রমেশকে কিছুটা সপ্রতিভ দেখালেও বাকিরা আগের মতো
সেই জড়সড় । মেয়েরা তাদের পাশ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে । ওরা কিছুই করতে পারছে না ।
গোল রক্ষা করতে-করতে ক্যাপ্টেন সুদীপা ছেলেদের নাকানিচোবানি
মনে-মনে হেসেই চলেছে ।
প্রথম অর্ধ শেষ ।
মেয়েরা ৩-১ গোলে এগিয়ে গেলো । ভুল করে লেফট-স্টপার বৃন্দা
একটা আত্মঘাতী গোল করে বসে ।
এদিকে মাঠের প্রায় সব দর্শক চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে মেয়েদের উৎসাহ
দিয়ে যাচ্ছে । তাতে রমেশ সহ ওর ছেলেদের মাথা খারাপ ।
রমেশ তো চিল্লিয়ে বলে উঠলো ওর সঙ্গীদের,’এবার কিন্তু বুঝিয়ে
দিতে হবে আমাদের ।‘
সঙ্গীরা মুখ কাচুমাচু করে ওকে কথা দিলো ।
কিন্তু সেই তো আগের অবস্থা ।
ছেলেরা জড়তা থেকে বেরোতেই পারলো না । দীপক রঞ্জিতাকে আলগাভাবে
ধাক্কা দেওয়ায় মাঠের দুদিক থেকে ছিছিক্কার ধ্বনি উঠে গেলো । তাতে আরও জড়তা ভর করলো
ছেলেদের ওপর ।
প্রথম কুড়ি মিনিট ছেলেরা কোনোরকমে বেঁচে গেলেও পরের পঁচিশ
মিনিটে মেয়েরা অবলীলায় তিনটে গোল দিয়ে দিলো । দোলা আবার পরপর তিন গোল দিয়ে হ্যাট্রিক
করে বসলো ।
উল্লাসে ফেটে পড়লো মাঠ । ছেলেদের তখন কাঁদো-কাঁদো অবস্থা
। রমেশের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে । কারো দিকে তাকাতে পারছে না একরাশ লজ্জায় । তবে
খেলার একেবারে শেষের দিকে ও একটা পেনাল্টি গোল করে ।
তাতে কি আর এসে গেলো । খেলার শেষে সুদীপার দল- ৫ । রমেশের
দল- ২ ।
খেলার শেষে ঘর্ম-ক্লান্ত সুদীপা ওর দল নিয়ে ছুটে এলো রমেশের
কাছে ।
ওর একেবারে মুখের সামনে এসে সরোষে বলে উঠলো,’দেখলি তো কি
হল তোদের গতি ? আমাদের শক্তি না দেখে,না বুঝে কথা বলিস কোন মুখে,শুনি ? তোদের লজ্জা
বলে আর কিছু থাকলো কি ?’
দোলা আবার নেচে উঠে রমেশের মুখের সামনে হাততালি বাজাতে
শুরু করলো ।
অন্য মেয়েরাও কম যায় না । শিসে-শিসে লজ্জায় একসার করে দিলো
রমেশকে ।
বলে চলে যাচ্ছিলো সুদীপা ওর দল নিয়ে ।
সহসা সুদীপার কানে এলো ছেলেদের দলের লেফট-উইঙ্গার রাজীবের
কথা ।
ও বেশ গর্বের সুরে বলল,’দেখিয়ে দিলাম সভ্যতা কাকে বলে ।
সব ছেলে এক নয় । নইলে আজ ৫০-২ গোল হত ।‘
একথা শুনে সুদীপা আবার ওর দল নিয়ে ছুটে আসতেই ছেলেরা রমেশের
নেতৃত্বে এ গলি ও গলি দিয়ে ক্লান্ত শরীরে কোথায় যেন বেপাত্তা হয়ে গেলো ।
‘হুম । বুঝেছি ওরা কি বলতে চায় । মেয়ে বলে আমাদের বুঝি
ছেড়ে দিয়েছে । সত্যিই কি তাই ?’
সুদীপা একটু উদাস-সুরে একথা বললে মেয়েদের মাথা নিচু হয়ে
গেলো । কারো মুখে তখন কোন কথা নেই ।
মাঠ প্রায় শূন্য হয়ে এসেছে । তাই ওদের হয়ে তখন কে কথা বলবে
। আর মাঠ তো নিজেই লাথিতে-লাথিতে পীড়িত । সে ক্ষোভে-দুঃখে কোনোদিনই মুখ থেকে একটা কথা
বার করেনি ।
মেঘমঙ্গল
পণ্ডিতমশায় চন্দ্রকান্ত গোস্বামী প্রায়ই লক্ষ্য করতো তার স্কুলের কলিগরা
নিজেদের মধ্যে গোপনে কথা বলে আত্মীয়দের জন্য পাত্র-পাত্রীর ব্যবস্থা করে ফেলে । সে
অবশ্যই নিমন্ত্রণ পেতো । হাসিমুখে সবার সাথে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেও চলে যেতো ।
কিন্তু পণ্ডিতমশায়ের দুই মেয়ে । তারা তখন বিয়ের যুগ্যি । দুই মেয়েই
কলেজ পাস করে বসে আছে । কিন্তু সুপাত্র আর আর্থিক দুরবস্থার কারণে সে অন্তত একটা মেয়ের
বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারছিলো না । কলিগদেরও তার মেয়ের ব্যাপারে তেমন কোন উৎসাহ ছিল
না ।
এদিকে পণ্ডিতমশায়ের স্ত্রী প্রায়ই চাপ দেয় তাকে ।
উষ্মার সুরে তাকে বলে,’কতবছর ধরে স্কুলে চাকরী করছ তুমি । স্কুলের কাউকে
বলতে পারো না ? কেমন বাবা তুমি ? তোমাকে স্কুলে কেউ মানে কি ?’
স্ত্রীর মনের ব্যথা পণ্ডিতমশায় বুঝত ।
একদিন সে তাকে আশ্বস্ত করলো,’তবে বলেই দেখি দেবীদাকে । তিনি অনেক খোঁজ
রাখেন । বেশ যোগাযোগও করিয়ে দেন । হয়েও যায় বেশ ।‘
‘দেখো উনি কি করেন । তবে এতদিনেও তার তোমার মেয়ের কথা মনে হল না একবারও
?’
বেশ আনমনা-সুরে তার স্ত্রী বলল ।
পরেরদিনই বাংলার প্রবীণ শিক্ষক দেবীদাস পাল পণ্ডিতমশায়ের মুখে সব কথা
শুনে একটু ফ্যাকাসে মুখে বলল,’মেয়ে আছে যখন বিয়ে দিতেই হয় । তবে তোমার দুই মেয়েকেই
দেখছি । দেখতে মন্দ না । তবে গায়ের রঙ বেশ চাপা । লম্বাও খুব একটা বেশি না । তবু দেখছি
। অপেক্ষা কর ।‘
পণ্ডিতমশায় তার কথা শুনে খুশি হয়ে হাত চেপে ধরে বিনয়ের হাসি হেসে বলল,’তুমি
পারবে নিশ্চয় । দেখোই না । আর যে পারি না ।‘
‘ভেবো না । সময় দাও । দেখছি আমি ।‘
দেবীদাস পাল একটু উন্মনা হয়ে পণ্ডিতমশায়কে বলে তখন ।
বাড়ি ফিরে পণ্ডিতমশায় খুব খুশি-মুখে তার স্ত্রীকে সব বলে ।
সে শুনে মুখভার করে বলে,’আগেই তো তিনি তোমার মেয়েদের খুঁত ধরে বসলো
। জানি না তিনি কি করবেন । দেখো কি হয় । তবে আমাদের আশীর্বাদে মেয়েদের মঙ্গল না হয়ে
পারে না ।‘
পণ্ডিতমশায় তাকে তখন বোঝালেন,’সে দেবীদা যাই বলুন । তিনি একটা ব্যবস্থা
করবেনই । তুমি দেখে নিও ।‘
‘বেশ । অপেক্ষা করি তবে ।‘
বলে পণ্ডিতমশায়ের স্ত্রী তার কাজে ডুবে গেলো । তবে দুই মেয়ে কিছুই জানলো
না । তাদের বিয়ের ব্যাপারে তেমন উৎসাহও দেখা যায় না । বান্ধবীদের বিয়েতে হাসতে-হাসতে
যায় । বান্ধবীদের বিয়ের খবর এনে মার বুকে অজান্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয় দুজন ।
এক সপ্তাহ পরেই দেবীদাস পাল পণ্ডিতমশায়কে পাত্রের খোঁজ দিলো ।
সে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তাকে বলল, ‘এক পাত্রের খোঁজ পেয়েছি । তবে
সে দোজবর । বছর চারেক আগে তার স্ত্রী ক্যানসারে মারা যায় । রেখে যায় দু’বছরের এক মেয়ে
।বয়স একটু বেশিই হবে । তবে পাত্র আমাদের মতোই স্কুল-শিক্ষক । চলবে ? এখানে কিন্তু হয়ে
যাবে । দাবী-দাওয়াও নেই তেমন ।‘
তার কথা শুনে পণ্ডিতমশায় মনে-মনে খানিক খুশি হল । খানিক হওয়ার কারণ,
বাড়িতে শুনে আবার কি বলে কে জানে ।
সে তখন স্মিত-হেসে বলল,’আমার পছন্দ ভেবে নিতে পারো । পেশায় তো স্বজাত
। খারাপ কি ।‘
এবার দেবীদাস পাল তাকে আরও একটা খবর দিলো ।
‘ছেলে কিন্তু ব্রাহ্মণ নয় । কায়স্থদের ছেলে । চলবে তো ?’
পণ্ডিতমশায় অমায়িক-হেসে উত্তর দিলো,’আমার পরিবার আর মেয়েরা
...