পাহাড়ের রাণী আলুটিলার অতুলনীয় হৃদয়স্পর্শী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মেয়েটি মোহিত। হাটছে আপন মনে। কখনো মাথা নিচু করে কখনো চারপাশটি দেখতে দেখতে। আকাশ পাহাড় আর মেঘের সাথে যেন তার মিতালি। পর্বতের সর্পিল আকারের আঁকাবাকা রাস্তার দু'ধারের সবুজ বনাঞ্চল, সারি সারি উঁচুনিচু পাহাড় আর লুকিয়ে থাকা মেঘ মেয়েটিকে উন্মনা করে তুলেছে। রোদের তেজ মরে গিয়ে মাত্র মিঠে হতে শুরু করেছে। মেয়েটির নাক ঘামছে, চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে।
রাস্তা ধরে মিনিট খানেক হেঁটে মেয়েটি পৌছুলো একটি সরু পাহাড়ি পথে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে পথটি। মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু দ্বিধা কাজ করলো, নিচে নামবে কি? জোরে একটি শ্বাস নিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো। মেয়েটি এবার সাবধানী। দেখে শুনে পা ফেলছে। ঢালু পথে পা হড়কে পড়ে না যায়।
নেমেই চোখে পড়লো ছোট্ট ঝর্ণাটি। স্হানীয়রা ঝর্ণাটিতে বাঁধ দিয়েছে। মেয়েটির
ইচ্ছে হলো ঝর্ণার মিষ্টি পানি পান করার। কিন্তু মেয়েটির হাতে সময় নেই। মেয়েটির গন্তব্য
আলুটিলার প্রখ্যাত প্রাকৃতিক গুহা। স্হানীয়রা বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। বন্ধুদের
কাছে মেয়েটি দেবতার গুহা সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছে। রহস্যময় বিষয়ের উপর মেয়েটির আগ্রহ
অনেক। মেয়েটি বেশ লম্বা একটু পলকা, শ্যাম, উনিশ ছুঁই ছুঁই । ভারি মায়াবী।
শামা দাড়াও!!
ডাক শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে কোমরে দু-হাত রেখে শহীদ দাঁড়িয়ে
আছে। প্রচন্ড অভিমানে শহীদের ফর্সা মুখটি লাল হয়ে আছে। অভিমানী মুখে শহীদকে কি বোকা
বোকা লাগছে! শহীদকে দেখে এতোটুকু অবাক হয়নি শামা। ওর মুখে একরাশ দুষ্টুমি মাখা হাসি!
যেন সে জানতো শহীদ আসবে। খাগড়াছড়ির রেস্টহাউজে ভাত ঘুম দিয়েছিল শহীদ। অমনি তাকে একলা
ফেলে বেড়িয়ে পরেছিল শামা। আজ দুদিন হলো ওরা এসেছে খাগড়াছড়ি, বেড়াতে। কিন্তু শহীদ কোনভাবেই
দেবতার গুহা দেখতে আসতে রাজি নয়।
কোন প্রতুত্তর না দিয়ে শামা আাবারো হাটতে শুরু করলো।
শুনতে পেলো শহীদ দৌড়ে আসছে। পাহাড়ি পথে দৌড়াতে গিয়ে রীতিমতো হাঁপাতে
লাগলো।
- কোথায় যাচ্ছ তুমি?
- দেবতার গুহা দেখতে যাচ্ছি।
- তুমি জানো না, ওখানে যেতে হলে তোমাকে কতকগুলো সিড়ি ভাঙ্গতে হবে?
- কতগুলো?
- প্রায় সাড়ে তিনশ।
- তো?
- তো মানে? আমতা আমতা করে বলল শহীদ, তোমার শরীরের যা অবস্হা,... তুমি
কিভাবে পারবে?
- আমি পারবো!
শামার ছেলেমানুষী জেদের কাছে খুব অসহায় বোধ করতে লাগলো শহীদ। কি বলবে,
কি যুক্তি দেবে ভেবে উঠতে পারলো না! শেষে মিন মিন করে বলল, গুহাটা অনেক অন্ধকার, ঠান্ডাও।
সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢুকতে পারে না। গুহার গেটে গার্ড থাকে, ওরা মশাল ছাড়া কাউকে ঢুকতে
দেয় না৷ ওরা তোমাকে ঢুকতে দেবে না।
দাঁড়িয়ে শহীদের দিকে স্হির চোখে তাকিয়ে শামা উত্তর দিল, দেবে। ওর দৃঢ়
কন্ঠে হতচকিত হয়ে গেলো শহীদ।
- রাস্তটা অনেক লম্বা। পুরোটা বলতে গেলে অসমতল, পাথুরে, পিচ্ছিল।
প্লিজ সোনা, নিজের কথা না ভাবো, বাচ্চাটার কথা ভাবো!
বাচ্চার প্রসঙ্গ আসতেই থেমে গেলো শামা। ওর প্রেগন্যান্সির ছ'মাস চলছে।
এতোটা পথ হেটে এসে ইতিমধ্যেই ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আরো অনেকটা পথ বাকি..বুঝতে পেরে
নিজের অজান্তেই হাতটা চলে গেলো পেটের উপর। অনুভব করার চেষ্টা করলো অনাগত সন্তানকে।
ছোট্ট করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝলো মা'দের স্বার্থপর হওয়া চলে না। আচমকা শহীদের
হাতটি ধরে বলল, চল ফিরে যাই।
গাড়িতে ফেরার পথে শামা একদম নিশ্চুপ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে পাহাড়ি রাস্তা
আর মানুষ দেখছে। শহীদ ওকে খুশি করে নানান কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোন সাড়া পেলো
না। সাড়া না পেয়ে বার বার তার দিকে তাকাতে লাগলো৷ আর দাঁত চেপে ধরে রাখলো। শহীদ খুব
ভীত ও নার্ভাস। ওর শামার না বলে বাইরে চলে আাসাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। শহীদ সবসময়ই
নার্ভাসনেসে ভোগে। বিশেষ করে শামাকে নিয়ে৷ সবসময় বোঝার চেষ্টা করে শামা তাকে সত্যি
ভালোবাসে তো!! ওদের বিয়েটা প্রেমের বিয়ে নয়। বিয়ের আগে দুজনের দেখা সাক্ষাৎও হয় নি।
এসব নিয়ে ভাবা শুরু করলে শহীদের মাথা ব্যথা করে। শরীর আড়ষ্ট হয়ে পড়ে৷ মানসিক ভাবে প্রবল
অস্হিরতা আর ভয় কাজ করে। শামাকে হারিয়ে ভয়।
-আমার ঘুম পাচ্ছে। অস্ফুট স্বরে বলল শামা। বলেই শহীদের কাঁধে মাথা রাখলো।
গাড়ির দুলুনিতে কিছুক্ষণের ভিতর ঘুমিয়ে পড়লো। শামার স্পর্শ পেয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া মাংসপেশিতে
ঢিল পড়লো।
চর আলেকজান্ডার৷ মেঘনা নদীর উপহার দেয়া প্রকৃতির মত সুন্দর একটি প্রত্যন্ত
ইউনিয়ন। সম্রাট আলেকজান্ডারের নামে নাম হলেও ইউনিয়নটি অভিশপ্ত। একদিকে মেঘনার ভাঙ্গন
অন্যদিকে অশিক্ষা।
ফিরে যাই বিশ বছর আগের চর আলেকজান্ডারে। এক শীতের ভোর। চারপাশের প্রকৃতিতে
পাখির কলতান। বাজারে চায়ের দোকানগুলো ঝাড়মোছ শুরু করেছে, খুলবে বলে। রাস্তায় লোকজনের
আনাগোনা নগন্য, শুধু কুকুরের উপস্হিতি লক্ষনীয়। চর আলেকজান্ডার তখনও ঘুমন্ত। ঘুম ভাঙ্গল
একটি শিশুর আর্তচিৎকারে। চিৎকারের উৎস রশীদ পাটোয়ারীর বাড়ি। মানুষ ছুটলো সেই বাড়ির
উদ্দেশ্যে।
কিছুক্ষণের ভিতর স্হানীয় পুলিশের ওসি বরকতউল্লাহ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে
দুটো মৃতদেহ উদ্ধার করলেন। একটি রশীদ পাটোয়ারীর গর্ভবতী স্ত্রী ও অন্যটি রশীদের ছোট
ভাই। চিৎকারটি দিয়েছিল ছোট্ট দশ বছরের শাহেদ।
পরদিন চর আলেকজান্ডারের স্হানীয় পত্রিকা স্বদেশভূমিতে পত্রিকার রিপোর্টার
নাসিম হত্যাকান্ড সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করলো। রিপোর্টটি ছিল এরকম -
"গতকাল আনুমানিক ভোর রাতে চর আলেকজান্ডারের বাজার সংলগ্ন পাটোয়ারী
বাড়িতে নিজ দেবরের সাথে পরকিয়ার কারনে খুন হন রশীদ পাটোয়ারীর গর্ভবতী স্ত্রী
রাহেলা (২৮) এবং দেবর বাশার (৩০)। রাহেলার মৃতদেহ গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় তারই শোবার
ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। আর বাশারকে কে বা কারা জবাই করে রেখে যায়। সন্দেহ করা
হচ্ছে একমাত্র সন্তান শাহেদের সামনেই তার মা'কে হত্যা করা হয়েছিল। ছেলেটি বর্তমানে
অসুস্থ। এদিকে রশীদ পাটোয়ারী নিখোঁজ।"
খুনের ঘটনার দিন তিনেক পর মেঘনা পাড় থেকে রশীদ পাটোয়ারীর মৃতদেহ উদ্ধার
করে স্হানীয় পুলিশ। কুয়াচ্ছন্ন শীতের রাতে দূর্ঘটনাবশত নৌকাডুবি ঘটেছে নাকি স্ত্রী
ও ভাইকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছে, সে সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত নয়।
বাবা-মাকে হারিয়ে অসুস্হ শাহেদ বড় হয় তার মামার কাছে। কিন্তু ভুলতে
পারেনি সে দিনের ভয়াবহতাকে। ঘুম ভেঙ্গে দেখতে পায় মায়ের লাশ।
উঁচু পেট ,
নগ্ন দুটি পা,
বাতাসে দুলছে।
একটি আধিভৌতিক ছবি।
প্রবল আতংক আর ভয়ে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয় শাহেদ। অবচেতন মনে গেঁথে
যায় সেই আধিভৌতিক ছবি...
উঁচু পেট
নগ্ন দুটি পা
বাতাসে দুলছে।
ফিরে আসি বিশ বছর পরের আজকের সন্ধ্যায়। এলজিইডির রেস্ট হাউজের ভিআইপি
রুমে সাজতে বসেছে শামা। মনটা ওর উড়ু উড়ু করছে যেন সে একটি দুষ্টু টুনটুনি। ভীষন মন
ভালো। দেবতার গুহা দেখতে যেতে পারেনি বলে মন যেটুকু খারাপ হয়েছিল, সেটুকুও ভেসে গেছে
শহীদের ভালোবাসায়। কিছুক্ষণের ভিতরেই ওরা দুজনে বেড়িয়ে পড়বে আলুটিলা পর্বতের উদ্দেশ্যে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু। সেজন্যই ওখান থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহরটি
দেখা যায়। আজ পূর্নিমা। পূর্নিমা রাতে মোহনীয় রূপ ধারন করে পুরো খাগড়াছড়ি।সেটা দেখতে
যাওয়াই আজকের প্ল্যান।
গুন গুন করে গান গাইছে শামা। আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে আজ...গাইতে
গাইতে থেমে গেলো! ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কোন শাড়িটা পড়বে! সবুজটি নাকি রয়্যাল ব্লু। শহীদের
প্রিয় রঙ কালো। কি অদ্ভুত! কালো রঙ কেউ পছন্দ করে নাকি! শহীদের অনেক কিছুই শামার কাছে
অদ্ভুত মনে হয়। একটু কেমন যেন
ও। নিজের পরিবারের কথা বলতেই চায় না। জিগ্যেস করলেই মুখ শক্ত করে ভীত
চোখে তাকায়! ভীষন নার্ভাস হয়ে পড়ে! বড্ড মায়া হয় শামার। তাই শহীদের অতীত নিয়ে কিছুই
জানতে চায় না।
শেষ পর্যন্ত শাড়ি পছন্দ হলো! ব্লু রঙের শাড়িই পড়বে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
শাড়ি পরছে শামা। রুমের বাহির থেকে শহীদের কন্ঠ ভেসে এলো। কাকে যেন কি বলল। এবার পায়ের
আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে! হা!! এদিকেই আসছে শাহেদ। প্রায় এসে পরেছে। এমনি সময় শামার মাথায়
একটু দুষ্টুমি ভর করলো। শাড়িটা না পরে শুধু ব্লাউজ, পেটিকোট পরে চোখ বন্ধ করে বিছানায়
শুয়ে পড়লো। ভীষন রোমাঞ্চ অনুভব করছে শামা। ভাবছে দেখি না শাহেদ কি করে!
শাহেদ রুমে ঢুকলো। রুমে লাল রঙের ডিম লাইট জ্বালানো। অল্প আলো আধারীতে
একটা ধাক্কা খেলো শাহেদ। কেমন ভয় আর অস্বস্তি হচ্ছে তার। হঠ্যাৎ চারপাশটা বদলে যেতে
লাগলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে ও। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখলো।দাঁতে দাঁত
লেগে যাচ্ছে। শরীর আড়ষ্ট হয়ে এলো। পেটের পেশিতে টান পড়লো। সারা শরীর ভারি হয়ে এলো শাহেদের।
এসময়েই চেতনা হ্রাস পেলো.. কি ….কি...
বিছানায় কি ওটা!!!
চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে শামা। অপেক্ষা করছে..কখন কাছে
আসবে শাহেদ। কিন্তু দেরী করছে কেন! ও রুম থেকে বের হয়ে গেল! তবু চোখ খুললো না শামা।
না, আসছে। আসছে। এলো বলে। কিন্তু একি! হঠ্যাৎ করে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলো শামার।
শহীদ ওর গলা টিপে ধরেছে। জোরে আরো জোরে টিপে মারছে। শামা ভয়ানক আতংক নিয়ে গো গো করতে
লাগলো। আর দু'হাতে নিজেকে শহীদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো।
লাল ডিম লাইটের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো রুম। একজন গর্ভবতী নারী বাঁচার
চেষ্টা করছে! পুরুষটির চোখে একটিই আধিভৌতিক ছবি।
উঁচু পেট
নগ্ন দুটি পা
বাতাসে দুলছে।