কোম্পানীর বিশ্বস্ত অফিসার সমীরণ সাহা ভ্যাবাচ্যাকা দাঁড়িয়ে রইলো ।
হাতে গুলদস্তা – রঙ্গীন রিবন আর ঝিলিমিলি কাগজে জড়ানো সুন্দর একটা ফুলের তোড়া । বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পর পর একএকটা ভিআইপি গাড়িতে উঠে পড়লো । সামনে লালবাতিয়ালা সাইরেন বাজানো পাইলট ভ্যান। পেছন পেছন কুড়িটা গাড়ীর কনভয় , একে একে সবাই লাইন দিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে বিদায় নিল ।
সবাই চলে যাবার পর সিনিয়র একজিকিউটিভ মিষ্টার নটিয়াল
এগিয়ে এলেন – “ মিষ্টার সাহা! ডিরেক্টর-অপারেশন মিষ্টার মেহেতাকে গুলদস্তা দিয়ে আপনারই ওয়েলকাম করার কথা ছিল?
হাউ ইউ মিস ইট?”
সমীরণ সাহা কিছুটা অপ্রস্তুত – “ স্যার, এই
কনভয়ের ভিড়ে আমি তো ৫-নম্বর গাড়ির মিষ্টার মেহেতাকে
আইডেন্টিফাই করতে পারি নি !”
- “ দ্যাটস ইয়োর গ্রেটনেস ! আপনাকে বলা হয়েছিলো নীল অ্যাপ্রোন, ৫ নম্বর
ভিআইপি গাড়ি থেকে যিনি নামবেন , তিনিই মিষ্টার মেহেতা ।
তাকেই গুলদস্তা দিয়ে আপনার ওয়েলকাম করার কথা ! বাট ইউ
হ্যাভ মিসড ইট !”
– “ স্যার, ৫ নম্বর
ভিআইপি গাড়ি থেকে যারা যারা নামলেন, তাদের কারোরই পরনে
নীল অ্যাপ্রোন ছিল না। বরং একজন জন ছিলো, ফর্সা মোটাসোটা,
তিনি পরেছিলেন অনেকটা কালচে মতো একটা পোষাক।
আমি তো ডিরেক্টর মিষ্টার মেহেতাকে কখনো চাক্ষুষ দেখি নি। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। নীল অ্যাপ্রোন না থাকলে আমি কি করতে পারি,
ভেরী সরি স্যার ......!”
- “গ্রেট! আজকাল আপনি
সবতেই কালো দেখতে শুরু করেছেন! হোপলেস!”
ডিরেক্টর ভিজিটের আগের দিনটার কথা। খবর কাগজ খুলতেই সমীরণের চোখে পড়েছিলো, সেখনে লেখা ছিল ভিআইপি সফরের সংবাদ। লোকাল কাগজে চাটনি করে কোম্পানীর বড় বড় সাহেবদের কিস্যার কথা লিখে রেখেছে ! একজন ডিরেক্টর নাকি হোমটাউন অফিসে ট্রান্সফার করিয়ে দেবায় জন্যে এক
মহিলার থেকে কিছু যৌন ও অনৈতিক সুবিধা নিয়েছিল । আরেকজন ভিআইপির কেরামতিতে নাকি
নতুন একটা প্রোজেক্ট-এর পুরো অর্ডারটাই অনেক বেশী দামে
দেয়া হয়েছে, তারই জানা শোনা একটা মাল্টি ন্যাশানাল
কোম্পানীকে । মিষ্টার মেহেতার আয়ের থেকে বেশী সম্পত্তি – তার
জন্যে সি বি আই কিছু অনুসন্ধান চালাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি
। যাক, এসব তো মানবীয় ভুল, একটু আধটু হয়েই থাকে। খবরের কাগজ আর মিডিয়ার সংবাদের
কোন মাথা মুণ্ডু নেই ! অথচ সমীরণ আজকে কেন এই ছোট্ট অ্যাসাইনমেন্টটা করতে পারলো না ?
এগিয়ে এলেন মিষ্টার দাসগুপ্ত - “ ৩ নম্বর গাড়ির ডিরেক্টর মিষ্টার
খিচারিয়াকে আমি তো ফুলের তোড়া দিয়ে ওয়েলকাম করলাম । ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি। কালো কই? তার পরণে ব্লু আপ্রোন-ই তো ছিলো ।”
মিষ্টার দাসগুপ্তের কথায় সমীরণ সাহা কেমন অসহায় বোধ
করলো, কেন তার এই
কনফিউশন? নীলকে সে কি আজকাল কালো দেখতে শুরু করেছে?
#
মাত্র পনেরো মিনিট আগের কথা। ডিপার্টমেন্টের অফিস গেটে
গান্ধীজির মূর্তির সামনে সামনে লোকজনের ভীড়। দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল গাড়ীর সাইরেন।
ওই ওরা আসছে ! সামনে পাইলট ভ্যান। কুড়িটা গাড়ীর কনভয় এসে দাঁড়ালো। একে একে
ভিআইপিরা গাড়ী থেকে নামলো, সমীরণ সাহা খুঁজতে লাগলো মিষ্টার মেহেতাকে, কিন্তু
৫-নম্বর গাড়ির থেকে নেমে আসা নীল অ্যাপ্রোন পরা সেই
নির্দিষ্ট মানুষটাকে সে খুঁজেই পেল না। প্রোটোকল অনুসারে ভিআইপি ও ডিরেক্টরদের
এখানে ভিজিটের মেয়াদ মাত্র পাঁচ মিনিট!
এই ভীড়ের মধ্যে অ্যাতো অল্প সময়ে মিষ্টার মেহেতাকে
সনাক্ত করতে না পেরে ফুলের তোড়াটা নিয়ে সমীরণ অসহায় এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। ভেতরে
ভেতরে সে ঘামছে? ভীষণ
কোণঠাসা অবস্থা! সে দেখতে লাগলো ব্যস্ত ডিরেক্টররা কেউ
কেউ গুলদস্তাগুলোকে তুলে দিচ্ছিল তাদের অ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে । এদের মধ্যে কে
মিস্টার মেহেতা?
ডিরেক্টরদের অ্যাসিস্ট্যান্টরা নিপুন হাতে ক্যাচ লুফে
ফুলের তোড়াগুলোকে চালান করে দিচ্ছিল তাদের ভিআইপি গাড়ীগুলোর পেছনের ডিকিতে।
সম্মানের প্রতীক গুলদস্তাগুলো জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়ছে প্রাইভেটকারের পেছনে, ডিকির কালো মসৃণ ভেলভেটে!
ঝটিকা সফরে এসেছিল তার কোম্পানির চেয়ারম্যান আর
ডিরেক্টরেরা । এক একটা ডিপার্টমেন্টে তাদের সাইক্লোন সফর। প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে
কয়েক দিন ধরে ঝাড়পোঁছ, মিটিং, রিহার্সাল, কে
কি কথা বলবে, কে কাকে এসকর্ট করবে। প্রোটোকল তৈরী হয়ে
গেছিলো । ডিপার্টমেন্টের সুনাম আর স্থানীয় একজিকিউটিভদের প্রোমোশন সব কিছুই নির্ভর
করছে এই ভিআইপি ও ডিরেক্টরদের মতামত আর সুপারিশের উপর।
ডিপার্টমেন্ট থেকে এই উপলক্ষে অতিথিদের স্বাগত জানাবার জন্যে এক একজনকে কিছু কিছু
নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো । সমীরণ সাহাকে বলা হয়েছিলো , ডিরেক্টর মিষ্টার মেহেতাকে গুলদস্তা দিয়ে ওয়েলকাম করতে। এই কাজটাও সে করতে পারলো না, সমস্ত জীবনভরই
তার কনফিউশন! এইমাত্র বিদায় নেয়া কনভয় আর সিনিয়র
একজিকিউটিভ মিষ্টার নটিয়াল-এর ক্রূদ্ধ চোখ দুটো মনে করে
সমীরণ সাহা নিজেকে একনম্বরের গান্ডু ভাবতে লাগলো।
অফিস থেকে বেড়িয়ে মন খারাপ করা সন্ধ্যায় সমীরণ সাহা একটা বারে ঢুকে বেশ কয়েক পেগ মাল টানলো । বার থেকে বেরিয়ে
এসেই কাছে রাস্তায় ধারে এই শহরের ফুলের নার্সারি। অবাক হয়ে দেখলো
সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে সকালের ভিআইপি নম্বর লাগানো গাড়ি্গুলোর একটা – পেছনে ডাই করা অনেকগুলো গুলদস্তা – অতিথিরা
সবাই চলে গেছে। রঙ্গীন রিবন আর ঝিলি মিলি কাগজে জড়ানো ফুলের ভালোবাসা! সকালে কিনে এগুলোই ভিআইপিদের দেয়া হয়েছিলো সম্মান আর
সুস্বাগতমের প্রতীক হিসেবে।
গাড়ির ড্রাইভার সন্ধ্যায় গুলদস্তাগুলো ফেরত বিক্রি করে
দিচ্ছে ফুলের নার্সারিকে। জলের ঝাপ্টা খেয়ে এই গুলদস্তাগুলো তাজা থাকবে – কাল সকালেই এগুলো আবার অন্য
খদ্দেরদের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে । ফুলের এমন হাত বদল হওয়া – সমীরন সাহা এর মধ্যে খুঁজে পেলো ট্যালেন্ট – ডোন্ট
ওয়েস্ট এনি থিং , সেভ মানি - আর্ন
মানি ।
ডিপার্টমেন্টে প্রোটোকল অনুযায়ী মিষ্টার মেহেতাকে
গুলদস্তা দিয়ে ওয়েলকাম করা হয় নি - একথাটা জানাজানি হতেই কোম্পানীর উচু মহলে হই চই
পড়ে গেল। এই ডিরেক্টরটি যথেষ্ট প্রভাবশালী। এই ব্যর্থতার নিদান হিসেবে সমীরন
সাহাকে দায়ী করা হলো। তাকে মেডিক্যাল চেক আপে পাঠানো হলো, সেখানে তার সাইকোলোজিক্যাল টেষ্ট । অতঃপর সেখান থেকে সমীরণ সাহাকে কোম্পানীর বড় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো । বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা তন্ন তন্ন
করে খুঁজলো – সত্যি তার কোন অসুখ আছে কিনা?
সত্যিই কি সে নীলকে কালো দেখতে শুরু করেছে? না, ডাক্তারেরা তেমন কিছু অসুখ খুঁজে পেল না ।
তিন দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে সে বাড়ীতে ফিরে এলো, ডাক্তার
তাকে ফিট সার্টিফিকেট দিয়েছে। পরদিন সে অফিসেও জয়েন করেলো ।
#
অফিসে জয়েন করার পরেও সমীরণের কাজে মন বসছিলো না।
সেদিনের অব্যবহৃত ফুলের তোড়াটা ! সেটা আলমারীর উপর এক কোনে অবহেলায় পড়ে আছে। পড়ে
পড়ে ফুলগুলো বিবর্ণ - তার মনে হতে লাগলো এই গুলদস্তাটাই অপরাধী! কালপ্রিট!
যেটার জন্যেই সে ভিআইপি গাড়ির মিষ্টার মেহেতাকে ওয়েলকাম করতে
পারে নি । সিনিয়র একজিকিউটিভ মিষ্টার নটিয়াল তার উপর দারুন অসন্তুষ্ট ! এই বিভ্রাটের জন্যেই তাকে মেডিক্যালে যেতে হয়েছে। ফুলের তোড়াটার উপরেই
তার রাগ হলো। অব্যবহৃত শুকিয়ে যাওয়া বিবর্ণ গুলদস্তাটাকে অফিসের দোতালা জানালা
দিয়ে সে জোড়ে ছুঁড়ে ফেললো নীচের দিকে। বিল্ডিংএর পেছনে মাটি, ঘাস, বাগান আর ঝোপঝাড়ের দিকে পতিত হতে হতেই
গুলদস্তাটা একটা সাদা প্রজাপতি হয়ে উড়াল দিলো আকাশের দিকে ! গুলদস্তার মুক্তি ! এবার সমীরণ সাহার মনে হলো,
ফুলের তোড়াটারই বা দোষ কি? কেন সে
গুলদস্তাটাকে কালপ্রিট ভাবছে। বরং এই ফুলগুলো একটা করাপ্টেড মানুষের হাতের মুঠো
থেকে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে।
ব্যবহারের পর ভিআইপিদের ব্লু অ্যাপ্রোনগুলোকে ধোপার
কাছে ঘোলাই করতে নিয়ে গিয়েছিলো অফিসের আর্দালি রামু। লন্ড্রী থেকে নীল পোষাকগুলো
যখন ফেরৎ এলো, জানা
গেল সেগুলোর রঙ কালো হয়ে গেছে। কারণটা অজানা! রামু ঘটনাটা
কাউকে বললো না। কাউকে কিছু না জানিয়ে প্যাকেটেমোরা অবস্থাতেই রঙ পালটে যাওয়া
অ্যাপ্রোনগুলোকে সে চুপচাপ চালান করে দিলো অফিসের স্টোর রুমে! যা হোক পরে দেখা যাবে। এখন একথাটা অফিসে জানাতে গেলে রামুই গালি
খাবে।
ভিআইপিদের ব্যবহৃত নীল অ্যাপ্রোনগুলোর এই রঙ পালটে
যাওয়ার গোপন খবরটা জানার পর সমীরণ সাহা আরো একবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো
বাইরের দিকে। একটু আগেই মিষ্টার মেহেতার জন্যে নির্দিষ্ট, অথচ অব্যবহৃত সেই
গুলদস্তাটা মুক্তি পেয়ে উড়ে গেছে আকাশে!