গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

পার্থ রায়

গরম ভাতের গন্ধ


ঝটিতি অফিস ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয় সুপ্রতিম। প্রচণ্ড তাড়া। অবশ্য এর জন্য ও নিজেই দায়ী। দেরি করে অফিস যাবার প্রস্তুতি নেওয়া ওর অনেকদিনের অভ্যাস। কথায় আছে ‘স্বভাব যায় না মলে’। তাই স্ত্রী সুতপা এবং বাড়ির অন্য সদস্যরা এই সময়টা খুব তটস্থ থাকে। শেষ মুহূর্তে গাড়ি ঘোড়ার মধ্য দিয়ে সুপ্রতিমের মিলখা সিং হয়ে ছুটে যাওয়া ওদের বিলকুল না পসন্দ।

“তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না। নুতন কাজের লোক বিমলাকে টিফিন দাও না?”, নিচু স্বরে স্ত্রীকে বলে সুপ্রতিম।

সুতপার ভ্রূ কুঁচকে যায়। “হঠাৎ এই কথা? এই সময়ে? তোমার কি আজ ট্রেন ধরার ইচ্ছে নেই? অফিস থেকে ফিরে এলে না হয়...”

“ওহ! যা জানতে চাইছি সেটা বলো। দাও কি দাও না? আস্তে কথা বলো”

“না দিই না। কারণ আগের যারা কাজের লোক ছিল তাদের থেকে অনেকটা বেশি মাহিনা ওকে দেওয়া হয়। তাছাড়া ওর আগে ঝর্না ছিল। ঝর্না খেতে চাইত না”

“সে বেশি নিক। বাজারদরও তো অনেক বেড়েছে। আর ঝর্নার কথা বাদ দাও। তুমি কাল থেকে দুটো চাল বেশি নিও। বিমলাকে চাট্টি ভাত খেয়ে কাজ ধরতে বলবে”।

সুতপা স্বামীর কথায় অবাক হয়। কারণ সুপ্রতিম এসব নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামায়নি। সংসারের এসব খুঁটিনাটি ব্যাপার সুতপাই ঠিক করে। কিন্তু এখন এসব নিয়ে কথা বললে স্বামীর অফিসের দেরি হয়ে যাবে। তাই কথা না বাড়িয়ে ঘাড় নাড়ল।

অফিস যাবার সময় হাবিজাবি পদ বিশেষ করে মাছ একেবারেই পছন্দ করে না সুপ্রতিম। খুব সংক্ষিপ্ত কিছু পেলেই ও খুশি। এমনিতেই খুব সামান্য ভাত খায়। ভাতটা অবশ্য গরম চাই। করোনার আবহে প্রথম দিকে কিছুদিন অফিস যেতে পারেনি। তারপর থেকে নিয়মিত যেতে হচ্ছে। সুতপাই একদিন ওকে গরম ভাতের সাথে মাখন, একটা ডিম সেদ্ধ আর কাঁচালঙ্কা, সর্ষের তেল দিয়ে মাখা আলু সেদ্ধ দিয়েছিল। সুপ্রতিমের খুব মনে ধরেছিল। ব্যাস! সেটাই এখন স্থায়ীভাবে বহাল। রীতিমতো জোর দিয়ে সুপ্রতিম এটা চালু রেখেছে। অন্যদিনের মতোই গোগ্রাসে খাচ্ছিল সুপ্রতিম। ডাইনিং টেবিলের পাশে যাতায়তের জন্য কিছু জায়গা ছেড়ে দেয়ালে একটা সুদৃশ্য বড় আয়না ফিট করা। চারজন খেতে বসলে তিনজনই নিজেদের দেখতে পায়। শুধু আয়নার দিকে পিঠ দিয়ে যে চেয়ার, সেখানে যে বসবে সে নিজের প্রতিফলন দেখতে পাবে না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই হোক বা কোন অজানা অনুভূতিতেই হোক, সুপ্রতিমের চোখ আয়নায় পড়ে। থমকে যায় সুপ্রতিম। আয়নায় ওর পেছনে বিমলার প্রতিফলন। ঝাড়ু হাতে। কাজ থামিয়ে। পলকহীন দৃষ্টি ওর থালার দিকে। গরম ভাতের গন্ধ সুপ্রতিমের বড় প্রিয়। কষ্ট মিশে সেই গন্ধ বিস্বাদ লাগে। ওকে থমকে যেতে দেখে সম্বিত ফেরে বিমলার। তড়িঘড়ি ঝাড়ু দেওয়া শুরু করে অপ্রস্তুত বিমলা। ওরও প্রিয় গরম ভাতের গন্ধে লজ্জা মেশে।