গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

সুদীপ ঘোষাল

 

ভূত নয় অদ্ভূত

আমার শোনা তিনটি, রহস্যঘেরা সত্য কাহিনী তোমাদের আজ শোনাবো। বন্ধুরা ভয় পেও না কিন্তু। প্রথমে আমার দেখা ভূত। হয়তো বিশ্বাস করবে না। তা হলেও বলছি শোনো।

অমাবস্যা র রাতে অন্ধকার হয় শুনেছি । কিন্তু তার থেকেও ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি চারজন। হঠাৎ সামনে দেখি গলা থেকে মাথা পর্যন্ত কাটা একটা স্কন্ধ কাটা ভূত ।আমার আর অনুপের  হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। ছোটো থেকেই জয় দা ও রমা দি র সাহস বেশী । আমরা ভয়ে বু বু করছি । এমন সময় দেখলাম অনুপকে  কে যেনো ছুঁড়ে পাশের হাই ড্রেনে  ফেলে দিলো। জয় দা হাঁক  দিয়ে বললেন, কে রে ভয় দেখাচ্ছিস । কিন্তু ভূত কোনো সাড়া না দিয়ে থপাস করে বসে পড়লো।

 

জয়দা বললেন, কে তুমি, বসে পড়লে কেনো ?

 

তারপর লাইনের পাথর কুড়িয়ে যেই না মারতে যাবেন তখন ভূতটা কথা বললো ।

 

বললো,  আমি ভূত নই । আমি মানুষ ।

 

তারপর আমরা দেখলাম তার আপাদ মস্তক কালো জামা ও প্যান্ট দিয়ে ঢাকা ।

 

কালো জামার মাঝে সাদা গোল গোল ছাপ । ফলে অন্ধকারে আমরা সাদা ছাপ দেখতে পাচ্ছি কিন্তু আর কিছু দেখা যাচ্ছে না । শুধু দেহ টা ভেসে যাচ্ছে ।

 

আমি  জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে অনুপকে ছুঁড়ে ফেললো কে ?

 

রমাদি বললেন, ভয় পেলে মানুষের আপৎকালীন হরমোন বের হয় । ফলে মানুষ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য লাফিয়ে পড়ে ।

 

জয় দা বললেন, আর বসে পড়ে লোক টা  পেচ্ছাপ করছিলো ।আর আমরা মনে করেছি ভূত বসে পড়েছে ।

 

অনুপ ততক্ষণে ড্রেনের কাদা মেখে উঠে আসছে ভূত হয়ে ।

 

বাড়িতে গিয়ে এই রহস্য গল্প বলার পরে সবাই  হেসে ফেলেছেন ।

 

                     

 

কবরের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা জীবনের ।যখন স্কুল থেকে মোটর সাইকেলে ফেরে তখন সন্ধ্যা হয়ে যায় । বর্ষার এক অবিশ্রান্ত বৃষ্টির দিনে একলা আসছিলো । বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে চড়খীর মিষ্টি র দোকানে কিছু খাবার খেলো । তারপর চা পান করে একটু অপেক্ষা করলো বৃষ্টি থামার । কিন্তু মেঘ যেনো ফেঁসে গেছে । কোনো মতে ই বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই । অগত্যা মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিলো । জোরে চালানো যাচ্ছে না । ধীরে ধীরে কবরের কাছাকাছি আসতেই সন্ধ্যা নেমে এলো । 

জীবনের খুব ভয় করছে । একবার বলছে আল্লাহ সালাম সালাম, আবার বলছে রাম রাম প্রণাম l

 

হঠাৎ একটি সাদা জামা পড়া মানুষ সামনে দাঁড়ালো । জীবন জোরে গাড়ি চালালো কিন্তু গাড়ি থমকে গেছে । এবার হাত দুটি পরম মমতায়  মাথায় হাত বোলাতে শুরু করল।সে বলল,আমার ছেলের মোবাইল নাম্বারে ফোন করে আমার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে দাও প্লিজ।

জীবন তার ছেলের নাম্বারও পেয়ে গেলো কন্টাক্টে।অবাক হয়ে সে ফোনও করল। তারপর সাদা জামা পরা ছায়ামূর্তি সরে গেলো পাশের কবরখানার গাছে।

 

 

ভূত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করে না।

কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যায় তার কোন ব্যাখ্যা মেলে না। আকুদা ছোট থেকেই চাষবাসে এক্সপার্ট। সে চাষবাসের জমি দেখাশোনা করে। নিজেই চাষ করে নিজেই বীজ বোনে। আবার ধান কাটে ফসল হয়। এই ভাবেই তার দিন কেটে যায়। বাড়িতে অভাবের সংসারে থেকেও সে নিজের সাধ্যমত রোজগার করে চলে।গ্রামে আকুদাকে ভালোবাসা সবাই। গ্রামে তার অনেক বন্ধু আছে। রমেন বিশু ও আরও অনেকে। আকুদা ভরা শ্রাবণে  লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। সেই সময়ে রমেন বলল, কিরে আকু কোন মাঠে যাচ্ছিস? আকুদা বলল গরগরে মাঠে।গরগরের মাঠে আজকে লাঙ্গল দিয়ে শেষ করতে হবে। দূরের দিকে জমিটা পড়ে আছে। জল দিয়ে এসেছি আজকে গিয়ে লাঙ্গল দেব।

রমেন বলল আমিও যাচ্ছি।

আমি যাচ্ছি কদতলার মাঠে। সেখানে অনেক দিন ধরেই আমার জমিটা শুখা পড়ে আছে। দেখি গা, ঘাস হয়েছে বড় বড়। আজকে জল বেঁধে দেব। আকুদা লাঙ্গল দেওয়ার পর প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এমন সময় দেখল পাশে একটা তালগাছ। তালগাছ তো সে আগে কোনদিন দেখেনি।

 কি করে এলো। এইভেবে সে ভিজে গাছে উঠে পড়ল। খচাম করে তারপর একটা তাল গাছে র বাগরা কেটে এনে জমিতে লাগলো সকালে দেখার জন্য।

তাল গাছের পাতাসহ ডালকে বাগরা বলে। 

 

বিশু আকুকে দেখতে পেয়ে  বলল কিরে এত সন্দে করলি কেন? মাঠে চন্দ্রবোড়া সাপের অত্যাচার। একবার ছোবল দিলে জীবনে ছবি হয়ে থাকবি। খবরদার এত সন্দে করবি না আপু বলল শোন শোন তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।

 

বিশু বলল কি বল তাড়াতাড়ি বল সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এই মাঠে দাঁড়িয়ে গল্প না করাই ভালো যেতে যেতে গল্প করি।পূর্ববর্ধমানের এই গ্রামগুলি ভরা শাওনে মায়াময় হয়ে ওঠে। 

 

আকু বলল, বুঝলি আমার  মাঠের কাছে তো কোন তাল গাছ ছিল না।

আজ একটা তালগাছ দেখলাম। বিশু বললো কি পাগলের মতো বকছিস। গরগরে মাঠে  আমি কালকে গেছিলাম। আমার দরকার ছিল। না তালগাছ ছিল না। মাঝমাঠে তালগাছ কোথা থেকে আসবে। তু তো বাপু মদ খাস না। আকুদা বলল, আমি তাল গাছে উঠলাম। আকু বলল আমি একটা বাগড়া কেটে পুঁতে দিলাম জমিতে।  কাল সকালে আমরা যাব দুজনে কি রে বুঝলি।

বিশু বলল, তাই হবে। গ্রামে গিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল তার পর হাত মুখ ধুয়ে, জল খেয়ে, সন্ধ্যেবেলার খাবার খেয়ে তারা বেরোল যাত্রার রিহার্সালে। এই রিয়ার্সালে  হেমন্ত কাকা খুব ভালো পরিচালক ছিলেন।

 তিনি যাত্রার অভিনয় সব দেখিয়ে দিতেন সকলকে। তাকে গ্রামের সকলেই খুব মান সম্মান করতো।

আকু বলল দেখেছো কোনদিন গরগরে মাঠে তালগাছ। 

এভাবে বলোনা ঘরে তোর কোন কাজ নাই।শুধু ভূত দেখিস। একজন অভিনেতা বলল। 

আকু বলল আজকে আমি দেখেছি।  কালকে সকালে কি দেখব গাছটা আছে নাকি।দাদু বলল যে, চ একবার গিয়ে দেখে আসি। তোর তালগাছ কেমন?

একজন বলল,রাতের বেলা যাবিনা। ভূতে বিশ্বাস না করিস সে কথা আলাদা। কিন্তু না বুঝে  তেনাদের অপমান করিস না।

তালগাছ কি করে এলো, সে কথা তো ভালো করে বলতে পারবি।গোঁয়ার গোবিন্দ মধু নাপিত বলল, না না একবার দিয়ে দেখে নিতে হবে সবাই মিলে। সবাইকে কি ভুতে ধরবে নাকি?

এমন সময়ে কাকা বলল বুঝিস না একবার আমরা দশজন মিলে গোমাই গ্রামে বরযাত্রী গিয়ে কি বিপদে পড়েছিলাম। যে ঘরে রাতে ছিলাম সেটা ভূতের ঘর। সেই ঘরে থাকতে দিয়েছিল আমাদের, পোড়ো বাড়িতে।রাতে দেখি দেয়াল থেকে রক্তধারা পড়ছে। সেই রক্তপাত হয়েছে অনবরত।  আমরা একটা টেবিলের উপর বসে ছিলাম। তার জন্য রক্ত কোথা থেকে এলো, এতো রক্ত।

 পরদিন আমরা বললাম ওদের, ওই বাড়িতে ভূত থাকে বলেছিলেন বটে। তবে আমরা মনে বুঝেছিলাম যে আমরা 10 জন আছি, হয়তো কিছু হবে না। আমরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম আপনাদের কথা। চরম শিক্ষা হয়েছে আমাদের। হেমন্ত কাকা বলল গোঁয়ার গোবিন্দ গিরি করলে হবে না। বুঝতে হবে সবাইকে। ভূত না মানলেও ভৌতিক ঘটনা কিন্তু কিছু আছে।

 যেটা আমরা অনেক প্রমান পেয়েছি।কথায় কথায় কথা বাড়ে। ভুতের কথা শুনে সাধন বর্গী বলল হ্যাঁ আমিও একবার দেখেছিলাম বটে সেই কি ভীষণ দর্শন। বুঝলে বাবুদের পুজো বাড়ি আদিরের ভেতর। দিনের বেলায় গিয়েছি।তাও অন্ধকারে আর দুটো হাত বাড়িয়ে ধরতে এসেছিল আমাকে। আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি কি ছিল সেটা। বাপ রে... বুড়ো নাকু দাদু চুপ করে বসে রিহার্সাল দেখতেন তিনি এতক্ষণে কথা বললেন। তিনি বললেন আমার বয়স 100 পেরিয়ে গেছে। তবু তোদের এখনো ভালোবাসি। তোদেরকে ভালোবাসি বলে আমি রিহার্সাল দেখতাছি। আমার কাছে ভূতের গল্প শোনা গল্প নয়। সত্যি কথা। একবার আমাকে মাঠে নিয়ে গিয়েছিল নিশিতে। যদি সারারাত দুনিতে জল করেছি মাঠে। সারারাত জমিতে সেই জল করার সময় জলে জলময় ছিল মাঠ। কি করে হলো। খরার সময়। আমার নিজের দেখা ঘটনা। তাহলে বলছিস ভূত  বুঝি নাই। আকুর কথাই সত্যি হবে দেখবি কাল সকালে গিয়ে বুঝতে পারবি।নাকু দাদু বলল আমি কি বলছি শোন সবাই সবাই মিলে একসঙ্গে যাই হ্যাজাক জ্বেলে।

 হ্যাজাকের  আলোতে আমরা তালগাছটা কে দেখে আসি চ... 

চারটে হ্যাজাক জ্বেলে 30 জনা মিলে মাঠে গিয়ে দেখল সত্যিই তালগাছটা দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশে একটা তাল বাগড়া পোঁতা।  তাহলে ডাল পাতা আছে। সবাই মিলে দেখে বলল আচ্ছা আমরা তো আশ্চর্য হয়ে গেলাম এখানে তো কোন তালগাছ  ছিল না।

 কাল সকালে এসে একবার দেখব এই গাছ আছে নাকি। চ   চ পালাই... 

 

তারপর রাতে ফিরে এসে যে যার বাড়ি চলে গেল ভয়ে।

 ভয়ে কাটল সে রাত। কোনোরকমে বাড়ির লোকদের না বলে সবাই জেগে রইল ঘুম আর এলো না চোখে।

 

কোন রকমে রাত কাটিয়ে সবাই হাজির হল সেই রায় পুকুরের মাঠে। রায় পুকুরে মাঠ থেকে এইবার সবাই একসাথে গরগরে মাঠ যাবে। সকলের ভয় করছে তবু তারা এগিয়ে গেল। যা হোক দিনের আলোতো বটে। যেতে যেতে গরগরে মাঠে এসে গেল। গরগরে মাঠে গিয়ে দেখল সব ফাঁকা।

 

 সেই তালগাছ নাই সেই তাল বাগরাও নাই...

ফাঁকা মাঠ।নাকু দাদু বললেন, রাম রাম....