গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

সুবীর কুমার রায়

ভেস্তে যাওয়া পাকাদেখা

আজ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা শোনাবো, অনেকদিন আগে এক পাত্রী দেখতে যাওয়া, হয়তো বা পাকাদেখাও বলা যেতে পারে। তবে বিধিবাম, তাই শেষপর্যন্ত আর বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার সুযোগ না পেয়ে, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। না, আমি নিজে পাত্র নই, বরং বরকর্তাই বলা যেতে পারে।

ভারতীয় স্টেট ব্যঙ্কে কর্মরত আমার ভাইয়ের জন্য, উত্তর কলকাতায় আমরা চারজন একটি পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম। আমি, আমার স্ত্রী, আমার ছোট বোন, ও ভাবী পাত্র স্বয়ং। আমাদের মিঞাবিবি দুজনের পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আবার সবসময়েই দুই মেরুতে বসবাস করে, আজও করে। আমি মিষ্টি খাওয়া কোনকালেই পছন্দ করি না, চপ্-কাটলেটই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। আমার উনি আবার মিষ্টি খাওয়ার জন্যই বোধহয় এই ধরাধামে আবির্ভুত হয়েছেন। পারলে ঠাকুর পূজার নকুলদানাও তিনি সাবাড় করে দিতে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেন না। ভাবী পাত্রীর ভাবী স্বামী, ভাসুর, জা, ও ননদের পদধুলির কল্যানে তাঁরা ধন্য হয়ে যারপরনাই মিষ্টান্নর আয়োজন করবে, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি আধপেটা খেয়ে আমাদের সাথে গেলেন। তখন মোবাইলের প্রচলন হয়নি, হাতেগোনা কিছু বাড়িতে দশফুটোর কালো রঙের ল্যান্ড ফোনের দেখা মিলতো। খবরের কাগজ দেখে সম্বন্ধ, তাই উভয় পক্ষের চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে, আজ সেখানে যাওয়ার আয়োজন।

ঠিকানা জানা ছিল। নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থেকে নেমে, রাস্তার পাশে একটা দোকানে খোঁজ করে আমরা নির্দিষ্ট বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা ধরলাম। রাস্তার ডানপাশে চাষের জমির মতো বিশাল জলাজমি, বাঁপাশে সুউচ্চ লম্বা পাঁচিল, যাতে হাজার হাজার ঘুঁটে দেওয়া, সম্ভবত কোন বড় কারখানা। অনেকটা পথ পার হয়েও রাস্তার দুপাশে কোন বাড়িঘর তো দূরের কথা, একজন লোকের দেখাও পেলাম না। আরও কিছুটা পথ হাঁটার পর, একজনের দেখা পেয়ে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন, যে আর সামান্যই পথ। ঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছি জানতে পেরে উল্লাসিত হয়ে আর সামান্য পথ অগ্রসর হতেই এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জানালেন, যে তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন, তিনি কন্যার পিতা। সুবিধাই হলো, আমরা তাঁর সাথে এগিয়ে গিয়ে তাঁর বাসায় হাজির হলাম।

ছোট্ট বাড়ি, দরজা দিয়ে ঢুকে পরিপাটি করে সাজানো প্রথম ঘরটিতেই আমাদের বসানো হলো। বেশ বড় একটা খাট ও চেয়ারে আমরা চারজন ভাগ করে বসলাম। ভদ্রলোক কিন্তু নিজে না বসে, আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। যে দরজা দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম, তার উলটো দিকে বাড়ির ভিতরে অন্যান্য ঘরে যাওয়ার জন্য অপর একটি দরজা। আমাদের সবাইকে এক কাপ করে চা ও দুটো করে ভগবতী বিস্কুট দেওয়া হলো। তখনও বিস্কফার্ম বা এখনকার মতো বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি ভালো বিস্কুট বাজারে আসেনি। একমাত্র ব্রিটানিয়া ও পার্লের বিস্কুটই বাজারে সমাদ্রিত ছিল। তবু কেন আমাদের মতো মহামান্য অতিথিদের কপালে ভগবতী ভর করলো, বলতে পারবো না। ভদ্রলোক একাই  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে কথা বলে যাচ্ছেন। অপর দিকের দরজায় এক ভদ্রমহিলা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন, মাঝেমাঝেই তাঁর পাশে কিছু মহিলা এসে চিড়িয়াখানায় আসা নতুন পশু পাখি দেখার আগ্রহ নিয়ে দেখার মতো, উকিঝুঁকি দিয়ে আমাদের দেখে যাচ্ছেন। এক ভদ্রমহিলা ট্রেতে করে চার প্লেট খাবার নিয়ে আসলেন। ভদ্রলোক তাঁর হাত থেকে খাবারের প্লেটগুলো নিয়ে আমাদের এগিয়ে দিতে সাহায্য করলেন। দুটি করে সিঙ্গাড়া ও দুটি করে রসগোল্লা। ভোজনপর্ব শেষে আমরা মেয়েটিকে নিয়ে আসতে অনুরোধ করলাম। ভদ্রলোক এবার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে মেয়েকে এঘরে নিয়ে আসতে বললেন। তাঁর সম্বোধনে এতক্ষণে বোঝা গেল, যে উনি তাঁর স্ত্রী। দরজার কাছ থেকে তিনি কিন্তু নড়লেন না। দুজন ভদ্রমহিলা মেয়েটিকে আমাদের বসার ঘরে নিয়ে আসলেন। খাটের ওপর আমার স্ত্রী ও বোন বসছিল, মেয়েটিকে নিয়ে এসে সেখানেই বসানো হলো। আমার বোনই প্রথম কথা শুরু করলো। সে বললো, “আমরা কিন্তু তোমায় দেখতে বা ইন্টারভিউ নিতে আসিনি, আমরা তোমার সাথে আলাপ করতে এসেছি”। মেয়েটি যথেষ্ট শিক্ষিত, খোলামেলা কথা বলে, অনেকটা লম্বা, ও দেখতেও বেশ সুন্দর। প্রথম দর্শনেই আমাদের বেশ পছন্দ হয়ে গেল। ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হলো, তারও পছন্দ। অল্প কিছুক্ষণ একথা সেকথার পর মেয়েটির বাবা জানালেন, যে মেয়েটি ভালো গানও গায়। আমার বোন দীর্ঘদিন গান শেখে, গায়ও মন্দ নয়। সে মেয়েটিকে হারমোনিয়াম নিয়ে আসতে বললো। মেয়েটি উঠে গিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে আসলো। তার নার্ভাসনেস্ কাটানোর জন্য, আমার বোন প্রথমেই পরপর দুটো গান গাইলো। এরপর মেয়েটিও গান গাইলো, এবং বেশ ভালোই গাইলো। আমাদের বাড়িতে শুধু আমরাই নই, বাবাও গানবাজনা খুব পছন্দ করেন, কাজেই বাবাও খুব খুশি হবেন। আমরা মনে মনে মোটামুটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। আমাদের কথার ওপর ভিত্তি করে এরপর একদিন বাবা-মা এসে সম্বন্ধ পাকা করে যাবেন।

এবার ওঠার পালা, আমরা অনুমতি চাইলাম। আমাদের হাবভাবে ভদ্রলোকও বোধহয় আাঁচ করতে পেরেছেন, যে তাঁর কন্যাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আনন্দের আতিশয্যে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা উৎফুল্ল হয়ে আমায় বললেন, “আর একবার চা হলে হতো না”। হতো তো বটেই, আমি কখনও চায়ের অফার ছাড়ি না। তাছাড়া সিঙ্গাড়া খাওয়ার পরে মনটা কিরকম চা চা করছিল। আমি অবশ্যই এই প্রস্তাবে রাজি হতাম, কিন্তু সেই সুযোগ আমি পেলাম না। আমার হ্যাঁ বলা বা সম্মতিসুচক মাথা নাড়ার আগেই, ভদ্রলোকের স্ত্রী বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন, “আমি আর চা করতে পারবো না”। আমরা অবাক হলাম সন্দেহ নেই, কিন্তু লজ্জায় ভয়ে ভদ্রলোকের মুখের রঙ কিরকম ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সম্মতি জানাবার সুযোগ পাইনি বলে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হলো। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে অবস্থার সামাল দিতে ভদ্রলোক আবার বললেন, তাহলে একটু কফিই হয়ে যাক। কিন্তু এবার গলার স্বরের রেগুলেটরের নব কয়েক পর্দা বাড়িয়ে প্রায় চিৎকার করে তাঁর স্ত্রী বললেন, “আমি কফি করতে পারবো না, আমি কি ঝি নাকি যে বারবার চা কফি করবো”। ইচ্ছা করছিল, দুজনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতির সামাল দিয়ে গৃহশান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি, কিন্তু সেটা তো আর বাস্তবে সম্ভব নয়, সাহসেও কুলালো না। বাধ্য হয়ে আরও কিছুক্ষণ বসে সময় কাটিয়ে, আমরা উঠে পড়লাম।

ভদ্রলোক অনেকটা পথ আমাদের সাথে গেলেন ও ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, যে আমরা যেন তাঁর স্ত্রীর ব্যবহারে কিছু মনে না করি। কিন্তু আমাদের মতো তিনিও বেশ ভালোই বুঝতে পারলেন, যে জেতা গেম তাঁর হাতের বাইরে চলে গেছে। ভদ্রলোক ফিরে গেলে, আমরা নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। আমার বোন বললো, “মেয়েটির মা’র সম্ভবত মাথার ব্যারাম আছে”। আমার কিন্তু মনে হলো, আজ পর্যন্ত হয়তো অনেক পাত্রপক্ষ মেয়েটিকে দেখতে এসে খেয়েদেয়ে ফিরে গিয়ে বিভিন্ন কারণ দর্শীয়ে নাকোচ করে দিয়েছেন, তাই ভদ্রমহিলা অত ফ্রাসট্রেশনে ভুগছেন। আমার স্ত্রী কিন্তু সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়ার থেকেও বেশি দুঃখ পেলো, আশানুরূপ মিষ্টি না খাওয়ানোর জন্য।

যাইহোক বাড়ি ফিরে বাবাকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে বললাম, “তুমি লিখে দাও, যে মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে অত ভেঙে পড়লে বা উত্তেজিত হলে চলে না, ধৈর্য ধরতে হয়”। বাবা কিন্তু তাতে রাজি হলেন না, পরিবর্তে অন্যান্য অসুবিধার কথা জানিয়ে, ব্যাপারটার সেখানেই ইতি টানলেন।