গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

সুবীর কুমার রায়


 মাস্ক বিভ্রাট


শান্তশিষ্ট স্বভাবের নারায়ণবাবু মানুষটিকে আশেপাশের সকলেই খুব পছন্দ করতেন। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না হলেও, তিনি কারও কাছে কোনদিন সাহায্য চেয়েছেন, যদিও তাঁর কোন শত্রু নেই, তবু থাকলে তিনিও হয়তো একথা স্বীকার করতেন না। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই টাকার অভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও, তিনি সবসময় তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী নগদে বাজার দোকান করতেন। বাজারের সবজি বা মাছ বিক্রেতারাও তাঁকে কোনদিন ধার চাইতে ও দরাদরি করতে না দেখায়, তাঁকে বেশ পছন্দও করতেন। কতবার পছন্দের মাছ কিনতে গিয়ে দাম শুনে পিছিয়ে আসায়, মাছ বিক্রেতা তাঁকে সুবিধা মতো পরে দাম দিয়ে যেতে বলে, মাছটা নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু নারায়ণবাবুর যুক্তি হচ্ছে, তিনি নুন ভাত খেয়ে থাকতেও রাজি আছেন, কিন্তু বাকিতে কিছু কিনতে তিনি রাজি নন। ধার করে ঘি খাওয়া তিনি আদপেই পছন্দ করেন না।

এরমধ্যে শুরু হলো করোনার ঝামেলা। বিপদটার গুরুত্ব কতখানি বোঝা না গেলেও, আশেপাশের শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বেশি করে চাল, আটা, তেল, নুন, মশলাপাতি, ও বাজার করে বাড়িতে জমা করে রাখার কথা বলে সতর্ক করে জানালেন, যে যেকোন মুহুর্তে বাজার দোকান সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পরের দিনই নারায়ণবাবু বাজারে গিয়ে সমস্ত বাজার করে, এক মাছ বিক্রেতার কাছে যান। লোকটা ভালো, সঙ্গে তার ছেলেকে নিয়ে বসে মাছ বিক্রি করে, কিন্তু তিনি মাছ পছন্দ করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। বাজারের সকলেই তাঁকে চেনেন, তাই অনেকেই ছুটে এসে তাঁকে তুলে চোখেমুখে জল দিয়ে কিছুটা সুস্থ করে তুললেন। ওই মাছ বিক্রেতা তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও বেশ কিছু মাছ তাঁর মাছের ব্যাগে দিয়ে, বাজারের ব্যাগ ও মাছের ব্যাগ সমেত তাঁকে রিকশায় তুলে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সময় বললো, “সাবধানে বাড়ি ফিরে যান। সুস্থ হয়ে যখন আবার বাজারে আসবেন, তখন মাছের দাম সাতশ’ টাকা দিয়ে যাবেন। তাড়াহুড়ো করে শরীর খারাপ নিয়ে এরমধ্যে যেন মাছের দাম দিতে আসবেন না”। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নারায়ণবাবু এই প্রথম বাকিতে কিছু কিনতে বাধ্য হলেন।

রিকশাচালক তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে, তাঁর স্ত্রীকে আজকের সমস্ত ঘটনার কথা বলে ফিরে গেল। ডাক্তার দেখানো হলো এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধপত্রও খাওয়া শুরু হলো। একটু সুস্থ হয়েও কিন্তু তাঁর পক্ষে বাজারে গিয়ে মাছের দাম পরিশোধ করা সম্ভব হলো না, কারণ ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে সত্য সত্যই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের চিন্তায় অসুস্থ নারায়ণবাবু আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

দিন পনেরো পরে স্ত্রীর কথা অগ্রাহ্য করেই তিনি বাজারে চললেন ঋণ পরিশোধ করতে। বাইরে গিয়ে তাঁর বহু বছরের চেনা শহরটাকে কেমন যেন অপরিচিত মনে হলো। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় কোন টোটো বা রিকশা নেই, মানুষজনও প্রায় নেই বললেই চলে। যে ক’জন মানুষকে দেখা যাচ্ছে, তাদের সকলের মুখেই মাস্ক বাঁধা, সহজে চেনার উপায় নেই। তাঁর মনে হলো মাস্ক ছাড়া তাঁর রাস্তায় বেরোনোটা উচিৎ হয়নি। তিনি ঠিক করলেন ফেরার সময় মাস্ক কিনে নিয়ে যাবেন। অন্যান্য দিন যেটা বিশেষ দেখা যায় না, আজ দেখলেন রাস্তার দুপাশে কিছু সবজি বিক্রেতা সামান্য কিছু সবজি নিয়ে মুখে মাস্ক বেঁধে বসে আছে। দু’-চারজন মাছ নিয়েও বসেছে। নিজেকে মাস্কহীন অবস্থায় নিজেরই যেন কিরকম অস্বস্তিবোধ ও লজ্জা করতে লাগলো। নারায়ণবাবুর আজ মাছ বা বাজার, কোনটারই প্রয়োজন নেই, তাই দ্রুত পা চালালেন। এমন সময় রাস্তার বাঁপাশ থেকে মুখে বেশ শক্তপোক্ত মাস্ক পরা একজন চিৎকার করে বললো, “বাবু কেমন আছেন? মাছ লাগবে নাকি? নিয়ে যান, একবারে টাটকা মাছ আছে”। নারায়ণবাবু লক্ষ্য করলেন, যে তাঁর পরিচিত সেই মাছ বিক্রেতা আজ এখানে বসে মাছ বিক্রি করছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে তাকে বললেন, “আজ এত লোক মাছ ও সবজি নিয়ে রাস্তার দুপাশে কেন বসেছে”? উত্তরে মাছ বিক্রেতা মাস্কের ভিতর থেকে অস্পষ্ট গলায় জানালো, “বাজারে সবাইকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তার দুপাশে বসেছে”। নারায়ণবাবু আর কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে সাতশ’ টাকা বার করে দুবার গুণে নিয়ে তার হাতে দিয়ে বললেন, “শরীরটা সুবিধের নেই বলে কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোইনি। আজ তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম, সেদিনের মাছের দামটা রেখে দাও”। মাছ বিক্রেতা হাসি মুখে টাকাটা পকেটে রেখে দিলো। নারায়ণবাবু একবার বললেন, “টাকাটা গুণে নাও”। উত্তরে মাছ বিক্রেতা বললো, “কি যে বলেন বাবু, আপনার মতো মানুষ আমাকে কম টাকা দিয়ে ঠকাবে”?

এই মাস্ক বিক্রেতার মাস্কটা তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে, এরকমই একটা মাস্ক কেনার জন্য তিনি ওষুধের দোকানের দিকে পা চালালেন। বাজারের কাছে এসে অভ্যাসবশত মাছের বাজারের কাছে গিয়ে তিনি আঁতকে উঠলেন। তাঁর পরিচিত মাছওয়ালার ছেলেটা কাছা পরে সামান্য কিছু মাছ নিয়ে বসে আছে। তিনি ভাবলেন, বাড়িতে এরকম একটা অঘটন ঘটেছে, অথচ ওর বাবা তো কিছু বললো না? দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “তোর এরকম পোশাক কেন, কে মারা গেছে”? ছলছল চোখে ছেলেটা উত্তর দিলো, “বাবা মারা গেছে”। নারায়ণবাবুর চোখের সামনে গোটা পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো। চোখে অন্ধকার দেখে তাঁর মাথাটা কিরকম ঘুরতে শুরু করলো। কোনরকমে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কি করে মারা গেল? কবে মারা গেল”? ছেলেটি উত্তর দিলো “গত শনিবার রাতে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে, আগামী রবিবার কাজ। বাবা আপনাকে খুব ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন, আপনি তো আমাদের বাড়ি চেনেন, ওইদিন আপনি যদি একবার আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন, তাহলে বাবার আত্মা শান্তি লাভ করবে”।

মানিব্যাগ হাতড়ে ছেলের হাতে সাতশ’ টাকা দিয়ে, তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। মনে মনে ভাবলেন, এমাসে আর মাস্ক কিনে কাজ নেই, যেটুকু টাকা পড়ে আছে, সামনের রবিবার ফুল ও ধুপকাটি কিনতে চলে যাবে। যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে আগের সেই মাছ বিক্রেতা বসার জায়গাটা আড়চোখে একবার দেখলেন। জায়গাটা ফাঁকা, দুটো কুকুর নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমচ্ছে।