গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

তাপসকিরণ রায়

 হ্যান্টেড কাহিনী--৫৫ 


মৃত্যু পারাপার
  

 

বৈদ্যনাথ বাবু অসুস্থ ছিলেন। তিনি হার্টের রোগী। সারা দিনের বেশির ভাগ সময়ে তাঁকে বিছানায় বিশ্রাম নিয়ে কাটাতে হয়। তার শরীর ও মন যেন আর ঠিকঠাক কাজ করছিল না। ঘরের লোকজনকে তিনি মাঝে মাঝে চিনতে পারেন না। কেবল কাছে বসা স্ত্রী, রমলাকে চিনতে পারছিলেন। এর মধ্যে ব্যাপারটা ঘটল, বৈদ্যনাথের মনে হল কিছুটা জড়ো জড়ো ভাব থেকে তিনি যেন হঠাৎ মুক্ত হলেন। এ কি ! শরীর এত হালকা লাগছে কেন ? তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন, হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছেন তিনি, স্ত্রী স্থির অদ্ভুত চোখে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। একটা হৈ-হল্লা, আওয়াজ পাচ্ছেন তিনি, সবাই তাঁর কাছে এসে জড়ো হয়েছে।  ছেলেরা তার গায়ে হাত লাগিয়ে পরক করছে, নাতি-নাতনিরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আর হঠাৎই বৈদ্যনাথ বাবু চমকে উঠলেন, দেখলেন, তিনি যে দাঁড়িয়ে আছেন! নিজের বিছানায় শায়িত  নিজের নিথর দেহটা তিনি স্পষ্ট দেখতে পারছেন ! 

অভিজ্ঞতা, এই কি অভিজ্ঞতা রে বাবা ! জীবিত কালে কত না অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি করেছেন তিনি ! আর এখন মৃত্যুর পরেও এখানেও সেই অভিজ্ঞতা--দেহ নেই কিন্তু ভাবনা স্মৃতিগুলি সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। কান্নার রোল পড়ে গেছে, স্ত্রী আছড়ে পিছড়ে কেঁদে চলেছেন। ছেলেরা চোখ মুছছে. নাতি-নাতনিরা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কান্না আসন্ন প্রায়। শরীর নেই, বৈদ্যনাথ বাবু বুঝেছেন, তবুও তিনি অঝরে কেঁদে চলেছেন। কার জন্য এ কান্না ? নিজের জন্য! নিজের মৃত্যু থেকে বড় শোক আর যে কিছু হতে পারে না।

কোমরটা খুব টাইট লাগছিল বৈদ্যনাথের, হাত দিয়ে তিনি নিজের কোমর খুঁজে পেলেন! পেট কমাবার জন্য বেল্ট এখানে লাগা থাকত, পেট কতটা কমেছে বোঝেননি তিনি তবে অভ্যাস বশত প্রায়ই তিনি ব্যাল্টটা কোমরে লাগিয়ে  রাখতেন। মনে হচ্ছে, এখনো যেন সেই ব্যাল্টটা  তাঁর কোমরে লাগা আছে।  ব্রাউন কালারের ব্যাল্টটা তিনি কোমর থেকে খুলে ফেললেন। কেন যেন মনে হল তাঁর, এটাকে সঙ্গে রাখতে হবে। এখন কার্যকারণ মনের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারছিলেন। নিজের মনই তাকে বলে দেয়!  

না, আর ঘরের ভেতরে থাকতে পারছেন না তিনি। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠলেন, এত ভিড়ে থাকতে পারছি না আমি--সাপোকেশন লাগছে আমার--আমাকে বাইরে যেতে দাও। না, কেউ তার কথা শুনতে পেল না। ঘরের বাইরে যাবার মত জায়গাও নেই। জীবিতকাল ও মৃত্যুর পরের কিছু কিছু ভাব-ভাবনা তিনি বই পত্রে পড়েছেন। তাহলে, হঠাৎ বৈদ্যনাথের মনে হল তা হলে ওই জালনা দিয়ে তিনি অনায়াসে বাইরে যেতে পারেন কি ? যেই ভাবা সেই কাজ, তিনি দেখলেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। বৈদ্যনাথ বড় পরিশ্রান্ত, মৃত্যুর আগে অনেক ধকল গেছে তাঁর ওপর দিয়ে,  আত্মা ও মন তাতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত তো হতেই পারে। তিনি ভাবলেন তাঁর মৃত শরীর ওরা খাট থেকে সরিয়ে নিলে তিনি সেখানে গিয়ে একটু শুয়ে বিশ্রাম নেবেন। এই চল্লিশ বছরের খাটটাও যে ভার বহন করে তাকে আরাম দিয়েছে। সে মায়া কি ভাবে তিনি ছাড়তে পারেন ? বিশেষ একটা পরিবর্তন নেই, স্ত্রীর কান্না প্রায় ছেড়েছেন, অবাক, এতো তাড়াতাড়ি সবাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে নাকি। তার মানে তার মৃত্যুর ফলাফল এইটুকু মাত্র! খুব ব্যথা পেলেন বৈদ্যনাথ কিন্তু তিনি তো ভুলতে পারছেন না কাউকে। এই মিনিট তিন-চার আগে তিনি ভূত হয়েছেন, সবাইকে কাঁদতে দেখেছেন--বাসনা কামনা ছাড়তে পারেননি তিনিও। রাতের পোশাক এখনো যে তার শরীরে জরানো আছে। 

ঘরের বাইরে থেকে জানলা দিয়ে বৈদ্যনাথ বাবু বারবার ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। নাতি-নাতনিরা কাঁদছে,  তাদের মুখে 'দাদু, দাদু' শব্দ লেগে আছে। তিনি এক বার নাতি-নাতনির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ালেন, বললেন এই যে আমি এখানে আছি-- 

কিন্তু কিছুই শুনতে পায়নি তারা, কিছুই দেখতে পায়নি তারা। বৈদ্যনাথ জানেন,  এমনটাই হয়। তবে হ্যাঁ, আত্মারা মনের জোরে অনেক কিছু তৈরি করে নিতে পারে। ভূতের জোর  মনের মধ্যে থাকে  আর তার মধ্যে মন নিবিষ্ট থাকে  শুধু তাদের দেহ থাকে না।  মনের জোর দিয়ে আত্মারা অনেকটা ধোঁয়াশা দেহ ধারণ করতে পারে। ভূত এক্টোপ্লাজম সৃষ্টি করে তার মনের  জোর থেকে,  এক্টোপ্লাজম থেকে তারা  নিজেদের ভৌতিক দেহ সৃষ্টি করতে পারে। তখন জীবিত মানুষরা ভূতকে দেখতে পায়  এবং তা দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে। 

বৈদ্যনাথ ঠিক করলেন তিনিও  এক্টোপ্লাজম দিয়ে শরীর তৈ তাই করবেন, স্ত্রীকে দেখা দেবেন, নাতি-নাতনিদের  সামনে শরীর ধারণ করে কথা বলবেন, ওদের সঙ্গে খেলে বেড়াবেন। তাঁর ইচ্ছে,  রোজ ঘরে এসে  সবাইকে দেখা দেবেন এবং জীবিত লোকের মত  সবার সঙ্গে বাস করবেন। তিনি জানেন ভূতেদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। মরে যাবার পরে নিজের লোকরা মৃত লোককে দেখে ভয় পাবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবু সদয় ভূত হয়ে যাওয়া বৈদ্যনাথ ভাবলেন, চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি ?

হঠাৎ বৈদ্যনাথ দেখতে পেলেন, ঐ তো তাঁদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, অমল বাবু আসছেন। তার মানে অমল বাবু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডেথ সার্টিফিকেট দেবেন। তারপর বৈদ্যনাথের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে এবং অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা হবে। জালনা দিয়ে তাকালেন বৈদ্যনাথ, ছেলেদের সঙ্গে ডাক্তারের . কিছু কথা হবার পরে ডাক্তার তার মৃতদেহে হাত লাগালেন। তিনি হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন, গলার টেথিসস্কোপ নিয়ে বারবার দেখতে লাগলেন, খাট থেকে সবাইকে উঠিয়ে দিয়ে মৃত বৈদ্যনাথ বাবুর বুকে ডাক্তার  ধীরে ধীরে, জোরে জোরে  চাপ দিতে থাকলেন এবং প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে পাম্প করার মত করে তিন-চার বার প্রেশার দিলেন। তারপর হঠাৎ কক করে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো, আর এ কি হল ! বৈদ্যনাথ ভ্যানিস হয়ে গেলেন। তবে কি আর তার কোন অস্তিত্বই রইল না ? এবার ডাক্তার বাবু চাপা স্বরে বললেন, বৈদ্যনাথ বাবু এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন। সামান্য পরেই বৈদ্যনাথ ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। এ কি তিনি বেঁচে আছেন নাকি ! তবে কিছু সময় আগের ঘটনা যা তিনি উপলব্ধি করে ছিলেন সে সব কিছুই কি শেষ ? তবে কি এ সব কিছুই ছিল অলীক-স্বপ্ন ? ভ্রম মাত্র ছিল ?

  ধরনের ঘটনার কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। তবে হার্টফেল রোগীদের ক্ষেত্রে নাকি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।  মানে, রোগী খানিক সময়ের জন্য মৃত্যু লোকে বিচরণ করে আবার ফিরে আসতে পারে।  

সমাপ্ত