গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী

ছায়া যখন কায়া 



ডাক্তার যোহান কোলকাতার এক নামী বেসরকারি হাসপাতালের সুদক্ষ স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ সে কেরালিয়ান কিন্তু ঝরঝরে বাংলায় কথা বলে
বন্ধু বিমল বলেছিল কল্যাণকে,'তুই তার কাছে বৌকে দেখাতে পারিস আমি ঠিকানা দিচ্ছি তোকে '
তার কথা শুনে কল্যান খুশী হয় খুব বাড়ি ফিরে ওর বৌ ফাল্গুনীকে জানায়
বৌ ফাল্গুনী বলে,'তবে সেখানেই চল একটু পয়সা বেশী লাগবে বটে সে লাগুক সমস্যা হবে না অমন নামী ডাক্তারের আন্ডারে থাকতে চাই আমি '
তার দুদিন পরেই কল্যান বন্ধু বিমলের থেকে ঠিকানা পেয়ে পৌঁছে যায় ডাক্তার যোহানের কাছে গায়ের রঙ তার বেশ কালো মাথা-ভরা কোঁকড়া চুল মুক্তোর মতো সাদা দাঁত চোখে রিমলেস চশমা আর হাসিটা তার ভারী চমৎকার
সব মিলে বেশ লাগলো ডাক্তার যোহানকে কল্যান আর বৌ ফাল্গুনীর বাড়ি ফেরার পথে দুজনই তার নাম-ভজনা করতে থাকলো
প্রাথমিক কিছু কথার পর ডাক্তার যোহান সারা মুখে হাসি নিয়ে ফাল্গুনীকে পরীক্ষা করলো কিছু পরীক্ষাও করতে বলল
কল্যান স্বস্তির হাসি হেসে বলল,'সে হবে আপনি আছেন যখন আমার আবার চিন্তা কি '
প্রথম সন্তান বুঝি এসেছে ফাল্গুনীর পেটে
তাই একটু চিন্তার সুরে তাকে বলল,'আপনি খুব ভালো করে দেখবেন কিন্তু '
বলেই লজ্জা পেলো
তখন স্বল্পভাষী ডাক্তার যোহান ওকে মৃদু-হেসে বলল,'আমি আর কে ' সবার ওপরে যেসাস আছেন তিনিই সব ঠিক করে দেবেন ' 
অনেক তৃপ্তির হাসি হেসে কল্যান আর ফাল্গুনী তারপর প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো
তারপর থেকে ডাক্তার যোহানের কাছে রীতিমতো চিকিৎসা শুরু হয়ে গেলো ফাল্গুনীর নিশ্চিত হওয়া গেলো সন্তান-সম্ভবা নামী জায়গার দামী ডাক্তার পেয়ে খুব খুশি ফাল্গুনী সঙ্গে ওর বর কল্যান তো বটেই
বাড়িতে বসেও ফাল্গুনী খুব ভাবে ডাক্তার যোহানের কথা তার চেহারা আর মুখের মিষ্টি কথা ভুলতে পারে না বারবার তাকে ওর দেখতে ইচ্ছা হয় কথা বলতে ইচ্ছা হয় খুব
একদিন ফাল্গুনী কি এক ঘোরে তাকে ফোন করে বসলো তেমন কিন্তু তাকে ওর দরকার ছিল না
ফাল্গুনী পরিচয় দিতেই ডাক্তার যোহান খুব খুশী সে শুরুতেই ওর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলো তার গলা শুনে ফাল্গুনী অতীব খুশী তাই নিজের কথা বলে গেলো বেশ গুছিয়ে
হঠাৎ ফাল্গুনী তাকে বলে উঠলো,'ডাক্তারের কথাতেই রোগীর অর্ধেক রোগ সেরে যায় তাই না ?’
সে হেসে বলল,'সে তো বটেই তবে সব ডাক্তার কি এক ? মনে হয় না '
ফাল্গুনী সাথে-সাথে বলল,'না,সবাই কেন হবে ? আপনার মতো হলে '
এরপর কি বলবে ভাবতে ভাবতে ফাল্গুনী বলে বসলো,'আপনার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছা আমার যদিও যাওয়ার সময় এখনো আসেনি '
ডাক্তার যোহান শুনে আপ্লুত
সে বলল তখন,'আমি আমার পরিবার ত্রিবান্দ্রমে রেখে এসেছি আপনি এলে তো বেশ হবে চিকিৎসার বাইরে কিছু কথা বললে মনটা দুজনেরই ফ্রেশ হয়ে যাবে '
'তাহলে কবে যাবো ?'
আনন্দে ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করলে সে বলল,'পরশুদিন আসুন আমার ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি ভয়ের কিছু নেই '
তার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো ফাল্গুনী
তারপর বলল,'তবে যাচ্ছি ' 
ফোন রেখে ফাল্গুনীর মনে পড়ে গেলো ওর বরের সেদিন ছুটি ওর বোনের বাড়ি যাওয়ার কথা তখন ওর আনন্দ আর ধরে না
আর একবার ফোন করে ডাক্তার যোহানের ফ্ল্যাটের অবস্থানটা জেনে নিলো লিখে রাখল ওর ডাইরিতে
আর একবার ফোন করলো ফাল্গুনী ডাক্তার যোহানকে যাওয়ার সময় জানতে
সে বলল,'বিকালের দিকেই আসুন দুপুরের পর আমি ফ্রি আছি '
খুশিতে গদগদ তখন ফাল্গুনী মনে-মনে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো
দেখতে দেখতে এলো যাওয়ার দিন সকাল থেকেই ফাল্গুনীর ফুরফুরে মন
কল্যান দেখে খুশি
জিজ্ঞেস করলো,'অত আনন্দের কারণ ?'
ফাল্গুনী হেসে জবাব দিলো,'সত্যিই যোহান বড় ডাক্তার আমি খুব ইজি ফিল করি সবসময় '
জেনে তৃপ্ত কল্যান
বলল,'আমাকে তাহলে বিমল বড় ডাক্তারের কথাই বলেছিল '
তার ঘণ্টা দুয়েক বাদে কল্যান বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো
বলে গেলো ফাল্গুনীকে,'মাকে নিয়ে সাবধানে থাকবে আর সমস্যা হলে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে নেবে আমার ফিরতে একটু রাত হতে পারে '
চলে গেলো কল্যান
তারপরেই ফাল্গুনী তাড়াতাড়ি ঘরের কাজ সারতে শুরু করলো
শাশুড়িকে বলল বেশ বিনয়ের সুরে,'আমি বিকালের দিকে এক বান্ধবীর কাছে যাবো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো আপনি চিন্তা করবেন না একদম '
সে শুনে বেশ অবাক
বলল,'এই অবস্থায় যাবে তুমি ? আমি কি যাবো সাথে ?'
'
আরে,না আপনি গিয়ে কি আর করবেন আমি তো শিগগির ফিরে আসবো বান্ধবীর ছেলের শরীর ভালো না তাই দেখে আসি '
তারপর আর সে কিছুই বলল না
শুধু বলল,'তবে সাবধানে যেও '
শেষ বাধা পেরিয়ে তখন ফাল্গুনী দিশাহারা বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকলো রিমলেস চশমাধারী সুদর্শন ডাক্তার যোহানের মুখটা
বিকালের কিছু আগে ফাল্গুনী পৌঁছে গেলো সেই নার্সিংহোমের কাছে কে এক মধ্যবয়স্ক মানুষ ওকে দেখেই কাছে এগিয়ে এলো
সে অমায়িক-হেসে বলল,'আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি ডাক্তার যোহানের চেম্বারে আসেন তো আপনি উনিই আপনাকে ওনার কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন আমার সঙ্গে আসুন '
ফাল্গুনী তখন স্বস্তির হাসি হাসল আবার একটু ভয় পেলো ডাক্তারবাবু চেনা হয়ে গেলেও সে অন্য পুরুষ ওকে কিভাবে নেবে,সে নিয়ে একটু দ্বিধা দেখা গেলো ওর মধ্যে তবে মানুষটা যে বেশ ভদ্র,সেও জানে তাই মুখে হাসি নিয়ে ফাল্গুনী তার পিছনে এগোতে থাকলো
নার্সিংহোম থেকে একটু দূরে বেশ শুনশান জায়গা একটা মাঠের পাশে সেই ফ্ল্যাট ফাল্গুনীর এবার একটু ভয় পেতে থাকলো  
কিন্তু ওর মুখে ভয়-ভাব দেখে সেই মানুষটি অনাবিল-হেসে বলল ওকে,'ভয়ের কিছু নেই ডাক্তারবাবুরা শান্ত জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন সারাদিন মানুষের মাঝেই তো তারা থাকেন ' 
'
তা ঠিক' বলতেই ফাল্গুনী গেটের সামনে পৌঁছে গেলো তারপর লিফটে উঠে একেবারে তিনতলায়
'
এই যে ডাক্তারবাবুর ঘরের দরজা ভ্যাজানো আছে ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে ' 
বলে নিজেই সে দরজা খুলে দিলো ফাল্গুনী সবিস্ময়ে দেখল,ডাক্তার যোহান পা-জামা আর স্যানডো-গেঞ্জি পরে ঘরময় পায়চারী করছে বেশ উদ্বেগের ছাপ তার চোখেমুখে তারপর সেই মানুষটা ফাল্গুনীকে আলতো ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে নিজের পথ ধরল
ফাল্গুনীকে দেখেই মুখে হাসি নিয়ে ছুটে এলো ডাক্তার যোহান  
সারা মুখে তখন তার মিহি-মিহি হাসি ফাল্গুনীর হাত ধরতে গেলো সে কিন্তু ফাল্গুনী তার হাত এড়িয়ে গিয়ে ঘরের ভেতরে গেলো তারপর একটা সোফা সামনে পেয়ে বসে পড়লো একটু ক্লান্তির হাসি হাসল তাকে দেখে
ওর মুখের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসলো ডাক্তার যোহান এবার সে কিন্তু বেশ হেসে ফেললো
বলল,'খুব খুশি আমি আপনি এসেছেন বলে আশা করি আপনি আমাকে সময় দেবেন সন্ধ্যা নামলেই চলে যাবেন এখন তো পৌনে পাঁচটা '
সলাজ-সুরে ফাল্গুনী বলল,'আচ্ছা '
কিন্তু কি কথা বলবে তার সাথে ?
ফাল্গুনী ভেবেই আকুল বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তার চিকিৎসার প্রশংসা করলো আর তার অমায়িক ব্যবহার চেহারার কথা কি বলা যায় ? 
ভেবে লজ্জায় হেসে ফেললো
তারপরেই ডাক্তার যোহান ফাল্গুনীকে অদ্ভুত-গলায় বলে উঠলো,'আপনি এখানে এসেছেন কেন ? কী দরকার আমার সাথে আপনার ?'
তার কথা শুনে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো ওর
ওর অবস্থা দেখে হা-হা করে হেসে উঠলো ডাক্তার যোহান তার হা-হা অনেক হা-হা তৈরি করলো নিমেষে শুনশান ঘর তার হাসির তোড়ে কেঁপে-কেঁপে উঠতে থাকলো
ভয়ে সারা ফাল্গুনী তখন সোফা ছেড়ে দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করলো ঘরের দরজার দিকে
কিন্তু ডাক্তার যোহান ওর হাত চেপে ধরল কি ভীষণ ঠাণ্ডা তার হাত একেবারে বরফ-শীতল ফাল্গুনীর মনে হল তখন ওর হাতের ওপর ভারী কিছু একটা এসে পড়লো  
সাথে-সাথে জ্ঞান হারিয়ে দরজার ঠিক আগে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো
তারপর আর খোঁজ নেই ফাল্গুনীর  
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই প্রথম রাত শুরু ওর শাশুড়ি চিন্তায় একশেষ বারবার ঘর-বার করতে থাকলো প্রতিবেশী কয়েকজনকে ডেকে ফাল্গুনীর কথা তাদের বলল তারা শুনে অবাক
কে এক জিজ্ঞেস করলো,'বাপের বাড়িতে গেলো না তো ?'
শাশুড়ি সাথে-সাথে সেখানে ফোন করলো কিন্তু না সেখানে ফাল্গুনীর ফাল্গুনীর বাবা-মা আর দাদা চিন্তায় তখন অস্থির
দাদা বলল,''আমি বাইক নিয়ে আসছি কিছু পরেই '
নানাজনের আশঙ্কার কথা চলতে চলতে কল্যান বাড়ি ফিরে এলো শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো
শুরুতে ওর মুখ দিয়ে কোন কথাই বেরোল না তারপর একটু-একটু করে ধাতস্থ হওয়ার পর খুব কষ্টে মুখ খুলল
একঘণ্টার মধ্যে বাইক চালিয়ে চলে এলো ফাল্গুনীর একমাত্র দাদা ফল্গু
ফল্গুর মাথাতেই প্রথম এলো নার্সিংহোমের কথা
সে বলল কল্যানকে,'আমরা একবার নার্সিংহোমে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি হয়তো ফাল্গুনী কোন অসুবিধা বুঝে সেখানে গেছে '
তার কথা মনে ধরল প্রতিবেশীদের  
কল্যান অনেক ভেবে বলল,'তবে সেখানেই দেখা যাক '
তারপরেই মাকে প্রতিবেশীদের কাছে রেখে কল্যান ফল্গুর বাইকে চেপে বসলো সেও একঘণ্টার পথ
সেখানে গিয়ে কল্যান ডাক্তার যোহানের কথা বললে অনেকেই অবাক হল খুব
একজন সবিস্ময়ে বলল,'উনি কোথা থেকে এখানে আসবেন ? তিনি তো দু'বছর আগেই গায়ে আগুন দিয়ে মারা গেছেন নিজের ফ্ল্যাটে ওনাকে বাঁচাতে গিয়ে মরে তার কাকা সব অদ্ভুত তো তার কাছে আপনি আপনার স্ত্রীকে কীভাবে দেখালেন ? সত্যিই বুঝতে পারছি না কিছু ' 
আর একজন বলল ভয়ে-ভয়ে,'তবে কি তার আর ওই মানুষটার আত্মা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ?'
দুজনের কথা শুনে তখন কল্যান আর ফল্গুর অবস্থা সঙ্গিন  
খুব কষ্টে ঢোঁক গিলে ফল্গু বলল তাকে,'সেই ফ্ল্যাট এখনো আছে কি ? আমরা সেখানে কি একটু যেতে পারি ?'
'
সে ফ্ল্যাট ? এখন তো নেই মালিক নিজেই ভয়ে সরে গেছে কবে এখন সব শুনশান তবে সেখানে যাওয়াই যেতে পারে একবার কি হতে যে কি হয় অদ্ভুতুরে খেলা সব '
সে বলার পর কল্যান আর ফল্গু পা বাড়াল সেই ফ্ল্যাটের দিকে সঙ্গে নার্সিংহোমের দুজন
চারদিক অন্ধকারের মধ্যে টর্চ মেরে-মেরে পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটের মুখে এসে একজন টর্চ ফেলতেই আঁতকে উঠলো এক মহিলার নগ্ন দেহ পড়ে আছে সেখানে তার দুই হাত আর পা ছড়ানো জিভ বেরিয়ে গেছে কি বীভৎস সে দৃশ্য
কল্যান আর ফল্গু তার সাথে একেবারে কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখল-- ফাল্গুনী ! ফাল্গুনীই তো
সঙ্গে-সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়লো ফল্গু কে তখন কাকে সান্ত্বনা দেয় বেশ ভেঙে পড়েছে কল্যান তখন শুধু ওই দুজন ওদের কোনোরকমে সামলে নার্সিংহোমের কাছে নিয়ে এলো তারপর অত রাতে খবর গেলো থানায় পুলিশ এলো তার কিছু পরে ফাল্গুনীর নিঃসাড় দেহ নিয়ে গেলো থানায় সঙ্গে একেবারে বিধ্বস্ত কল্যান আর ফল্গু
দুদিন পরে কল্যান বন্ধু বিমলকে সব জানাতেই সে অবাক হল খুব
যারপরনাই অবাক হয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল,'আমি বছর দুই আগেও জানতাম তিনি আছেন এর মধ্যে কি হয়েছে আমি তো কিছুই জানি না তুই আমাকে ক্ষমা কর আমাকে কিন্তু বিপদে ফেলিস না ''
কল্যান কান্না-ভেজা গলায় তখন তাকে বলল,'আর কাউকে বিপদে ফেলে কি আর হবে যার গেলো তার গেলো ভূতুড়ে ব্যাপার সব বুঝতে যাবে সারাজীবন