গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী


সৃষ্টিশীল


নাপিত সৃষ্টি শীল সৃষ্টিশীল কথাটার মানে জানতো না । 
আর তাই তাকে পথে-ঘাটে ছেলেরা সৃষ্টিশীল বললে ক্ষেপে উঠত খুব । নিজের আর ছেলেদের বয়সের ফারাক না বুঝে কাঁচা-কাঁচা খিস্তি দিয়ে দিতো । তাতে বাতাসে সৃষ্টিশীল আরও ভাসতো ।
ব্যাপারটা খুব লক্ষ্য করে কিশোর । 
নপাড়ার তরুণ যুবক । তার খুব খারাপ লাগতো শুনে বাপের বয়সী মানুষের মুখে অমন খিস্তি শুনে । ছেলেদের কাউকে-কাউকে সে সৃষ্টিশীল না বলতে বলে । কিন্তু কেউ কথা রাখেনি । সেই যাকে তাই ।
কিশোর অন্য সেলুনে চুল কাটায় ।
কিন্তু গত রবিবার তার মনে হল,চুল না কাটাই আমার সৃষ্টিশীল কথাটা সৃষ্টি শীলকে বলে আসা উচিৎ । বুঝলে সব ঠিক হয়ে যাবে । 
এ ভেবেই কিশোর গেলো সৃষ্টি শীলের সেলুনে গেলো ।
তাকে দেখে বেশ খুশি সে ।
অমায়িক-হেসে বলে উঠলো,'আমাকে তবে মনে পড়লো আজ ? সে হোক । ফাইন করে চুল-দাড়ি কেটে দেবো আজ । তারপর থেকে পাগলার সেলুনে যাবেই না ।'
আমতা আমতা করে কিশোর তাকে বলল,'তা নয় গো,কাকু । আমি একটা ব্যাপারে এসেছি । তোমাকে আমার বোঝানো দরকার । সময় আছে ?'
সৃষ্টি শীল শুনে বেশ অবাক কিশোরের কথা শুনে ।
খানিক অপলকে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,'বলেই ফেলো তবে ।'
বলেই সে চেয়ারে বসা একজনকে বলল,'একটু বস । আমি ব্যাপারটা বুঝে নিই ছেলেটার থেকে লেখাপড়া কিন্তু বেশ জানে । কপাল খারাপ,তাই আজো চাকরী পেলো না ।'
এবার কিশোর হাসি-মুখে একটা বেঞ্চের ওপরে বসে পড়লো । সৃষ্টি শীল আগ্রহের সঙ্গে তখন তার দিকে চেয়ে আছে ।
তারপরেই কিশোর মুখ খুলল ।
'
হ্যাঁ,কাকু বলেই ফেলি তবে । তুমি সৃষ্টিশীল বললে রেগে যাও খুব । আমি দেখেছি অনেক । বাজে গাল দিয়ে ফেলো । আমার তখন খুব খারাপ লাগে । তুমি তো তোমার নাম ভাবো । আসলে সৃষ্টিশীল মানে জানো ?' 
উপস্থিত অনেকেই কিশোরের কথায় হেসে ফেললো ।
সৃষ্টি শীল এবার মুখভার করে বলল,'তুমিও শুনেছ তবে ? কি যে খারাপ ব্যাপার । এই পঞ্চাশ বছর বয়সে ওইসব বাচ্চারা পিছনে লাগলে কেমন লাগতে পারে,বল তো ? তা তুমি এবার আমাকে বুঝিয়ে দাও ।'
'আসলে কাকু ওরা তোমার নাম আর পদবীকে একসাথে জুড়ে দিয়েছে । নিজেরাও জানে না বুঝি ওরা কত বোকা । সৃষ্টিশীল মানে হল যার মাধ্যে সৃষ্টির ক্ষমতা আছে । নিত্য-নতুন সৃষ্টি করে । ভগবানের কথা বলতে পারো । তার চেয়ে বড় সৃষ্টিশীল কে আর আছে । তুমিও তার মতো । কত সুন্দরভাবে নিজের কাজটা কর । লোকে প্রশংসা করে খুব তোমার ।'
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কিশোর অনাবিল-হেসে সৃষ্টি শীলের দিকে তাকাল । আর সৃষ্টি শীল তো নতুনভাবে তার পরিচয় পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তখন ।
বলে উঠলো,'আমি তবে আর রাগ করবো না বোকাদের কথায় । বাজে কথা আর মুখেও আসবে না আমার । এ বয়সে বলা কি ঠিক ?'
উপস্থিত চারজন তখন কিশোরের বুদ্ধির খুব তারিফ করতে থাকলো ।
একজন বলে বসলো,'এই আনন্দে আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি ।'
আর একজন বলল,'তুই একা সব করিস না । আমি টায়ের ব্যবস্থা করি তবে ।'
তারপরেই সৃষ্টি শীল 'জয় মা' বলে সেই অপেক্ষারত লোকের চুল কাটতে শুরু করলো । তার সারা মুখে তখন খুশির তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে ।
চা এলো । সাথে বিস্কুট । কিশোর বেশ আনন্দের সঙ্গে খেলো ।
উঠে আসার আগে কিশোর বিনয়ের সুরে সৃষ্টি শীলকে বলল,'তবে কাকু আমার পাগলাকাকুই থাক । সে তোমার থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও ভালোই চুল-দাড়ি কাটে । আমার বাবা খুশি হয় মানে বেশ । তাই না,কাকু ?'
সৃষ্টি শীল আনন্দে গদগদ হয়ে বলল কিশোরকে,'সে ঠিক আছে । আজ যে উপকার করেছো আমার তাতে পরের প্রশংসা আমার খুব সইবে । এসে দেখে যেও আমাকে । তাহলেই হবে ।'
কিন্তু তার দুদিন পরেই কিশোর দিল্লী যাওয়ার ফ্লাইট ধরল । বৃদ্ধ কাকার ডাক আর বাবার সম্মতি । 
এখন থেকে কাকার কাছেই থাকবে কিশোর । তার হার্ডওয়্যারের ব্যবসা ওকে দেখতে হবে । তাই আপাতত দেখা করা সম্ভব নয় । আর ছেলেদের কথায় কি সৃষ্টি শীল কি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে,সেও দিল্লী বসে বোঝা সম্ভব নয় কিশোরের । তবে ঘোর বিশ্বাস এরপর সৃষ্টি শীল বদলে যাবেই । বুঝিয়ে দিয়ে ছেলেদেরও বদলে দেবে সে ।