গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

সুবীর কুমার রায়


অনুশোচনা


জানি না ছেলেবেলায় অনুশোচনা হয় কী না। আমায় কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বারংবার অনুশোচনার জ্বালায় দগ্ধ হতে হয়েছে। যতদূর স্মরণ করতে পারি, এটাই বোধহয় আমার জীবনে প্রথম অনুশোচনা, যা এখনও আমার পিছু ছাড়েনি।
তখন আমি সম্ভবত সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। এখনকার মতো সেইসময় ছেলেমেয়ের হাতে পয়সা দেওয়ার চল্ ছিল না, আমার বাড়িতে তো ছিলই না। মাকে পটিয়ে পাটিয়ে লাট্টু, গুলি, লালতুলো (বুড়ির চুল, বা হাওয়া মিঠাই), ল্যাক্টো বনবন্ লজেন্স্, আনারকলি বিস্কুট, টিনের বাক্স করে বিক্রি হওয়া শন পাপড়ি, ইত্যাদি কেনার সামান্য পয়সা কখনো সখনো পাওয়া যেত বটে, কিন্তু অসচ্ছল সংসারে ইচ্ছা থাকলেও, তাঁর পক্ষে অধিকাংশ সময়েই আবদার মেটানো সম্ভব হতো না। বাবা ছিলেন অত্যন্ত রাগী, কাজেই তাঁর কাছে পয়সা চাওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। তাছাড়া আমিই তো একা দাবিদার ছিলাম না।
আমাদের বাড়িতে একটা অচল আধুলি দীর্ঘ দিন ধরে পড়ে ছিল। সেটাকে চালাবার চেষ্টাও করা হয়নি, ফেলেও দেওয়া হয়নি। কালক্রমে সেটা আমার পকেটে আশ্রয় পেলেও, এবং সেটা ভাঙিয়ে অনেক কিছু কেনার রঙিন স্বপ্ন দেখলেও, রোগা জিরজিরে শরীরে অচল পয়সাকে সচল করার চেষ্টা, সাহসে কুলায়নি।
একদিন শীতকালে বাবার সাথে কি কারণে মনে নেই, তাঁর অফিসে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে সঙ্গে করে সেই ব্যাঙের আধুলি সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলিনি। বদ্ধ অফিস ঘরে আমি হাঁপিয়ে ওঠায়, তিনি একজন চতুর্থ শ্রেণীর অল্পবয়সি কর্মচারীকে অফিসের উলটো দিকে কার্জন পার্কে আমায় একটু ঘুরিয়ে আনতে বলেন। তখন দুপুর বেলায় কার্জন পার্ক মানুষের ভিড়ে জমজমাট ছিল। অনেকে মনে হয় বাড়ির বাচ্চাদের নিয়েও ঘুরতে এসেছেন।
কর্মচারীটি পার্কের এক জায়গায় বসে আমার দিকে লক্ষ্য রাখছিল। আমি চারিদিকে খানিকটা দূর পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ এক অতি বৃদ্ধ চিনেবাদাম বিক্রেতাকে আবিস্কার করলাম। মলিন পোশাক পরিহিত, বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধটি, বিরাট একটা ঝোড়ায় করে চিনাবাদাম বিক্রি করছেন। আমি বোধহয় এতদিন এনার অপেক্ষাতেই ছিলাম, এতটুকু সময় নষ্ট না করে, বুকভরা সাহস নিয়ে তাঁকে আট আনার বাদাম দিতে বললাম। তখন আট আনার বাদাম একজনের পক্ষে হজম করা সম্ভব ছিল না, আমার পক্ষে তো নয়ই, তাছাড়া খুব কম লোকই বোধহয় আট আনার বাদাম কিনতো। তাই বৃদ্ধ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, পয়সার বাদাম দেবো। আমি পয়সা ভাঙাবার ঝুঁকি না নিয়ে, আট আনার বাদাম চাইলাম। অচল আধুলি গছিয়ে বিশাল এক ঠোঙা চিনাবাদাম নিয়ে, আমি মুহুর্তের মধ্যে অনেক লোকের ভিড়ে হারিয়ে গেলাম।
এবার শুরু হলো অনুশোচনা, নানারকম দুশ্চিন্তা ভয়। লোকটাকে ঠকানো ঠিক হয়নি, এতোটা বাদাম নিয়ে আমি কি করবো, আধুলি রহস্য উন্মোচন করে বাদাম ফেরৎ দিতে যাওয়ার বিপদ, কপর্দকহীন আমার পক্ষে কাউকে বাদামের ভাগ দেওয়ার সমস্যা, সর্বোপরি বাদাম বিক্রেতা এতক্ষণে আমায় খুঁজতে বেড়িয়ে পড়েছেন কী না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছুটা বাদাম গলাধঃকরণ করে, ঠোঙা সমেত প্রায় সমস্ত বাদাম মাঠে গাছের আড়ালে
ফেলে দিয়ে প্রমাণ লোপ করে, মুখ মুছে, বহুদিনের সাথী আধুলিটা পকেটছাড়া করে, আমার লোকাল গার্জেনের কাছে ফিরে এলাম।
সারাটা পথ আধুলির শোক ও ওই বৃদ্ধকে অহেতুক ঠকানোর অনুশোচনা নিয়ে বাবার সাথে বাড়ি ফিরলাম। না, সেই অনুশোচনা আমার আজও যায়নি। সেই বৃদ্ধ অবশ্যই আজ আর বেঁচে নেই, তবু তাঁর কাছে আজ এই বয়সে এসেও ক্ষমা ভিক্ষা করছি। তাঁর আত্মা শান্তি লাভ করুক।