গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯

সুকন্যা সাহা

কনফেশান বক্স......

         
সিনক্লিয়ার  রিট্রিট  কালিম্পং সাব ডিভিশানের   একটা ছোট্ট জনপদ । কালিম্পং পাহাড়ে  রোজ  সকালে  যখন  একটা   কমলালেবু রঙা ভোর   জেগে   ওঠে,দূরে  পাহাড়ের  মাথায় মাথায়   ছড়িয়ে   পড়ে সোনা রঙের  রোদ ; পাইনের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ঝিকিয়ে  ওঠে  প্রথম সূর্যের সোনালি  আলো,
মার্থা তখন  হেঁটে যায়  সিন ক্লিয়ার চার্চের দিকে ...  প্রত্যেক সকাল বেলায় জেসাসের সঙ্গে   দেখা   করতে   যায়  মার্থা ... কনফেশান বক্সে দাঁড়িয়ে জেসাসের বিশাল মূর্তির দিকে অবাক চোখে   তাকিয়ে   থাকে ... কি অদ্ভুত মায়া  মাখানো চোখ... সারা মুখে  ছড়ানো এক   অপার্থিব   আলো ... স্তব্ধ হয়ে   যায় মার্থা...
কখন যেন   তার   দুচোখ  বেয়ে  নেমে  আসে  জলের  ধারা ... ধীরে ধীরে   নেমে   আসে  কনফেশান   বক্স  থেকে  ... ফেরার  পথে  দেখা  হয় ফাদার  ডেভিডের   সঙ্গে ... কি  অদ্ভুত মানুষ   এই ফাদার  ডেভিড ... কি ধৈর্য্য ... সব্বার কথা শোনেন মন   দিয়ে ... সব সময় মুখে   লেগে আছে   এক  গাল   হাসি ...
মার্থাকে  বড্ড ভালবাসেন ফাদার ... এই অনাথ মেয়েটির  নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় দেখে   অবাক হন  তিনি ... ফেরার   পথে মার্থাকে  রোজ প্রসাদ দেন  তিনি ...

                    পাহাড়ি পথের  পাকদন্ডী বেয়ে ফেরার   সময়  মার্থা দেখতে পায় ভোরের  লাল সূর্যটা  অনেকটা  উপরে উঠে এসেছে ... পাইনের  বনে  শনশনে ঠান্ডা   হাওয়া   বয়ে   যায় ... লাল সোয়েটার পড়া  কচিকাঁচার দল দৌড়ে দৌড়ে স্কুলে যায় ... গালগুলো আপেলের  মতো লা... যেন ফুটফুটে  ফুল সব ...  মার্থার কোনদিন স্কুল যাওয়া   হয় নি ... এখন বড্ড মিস   করে  স্কুলের  দিনগুলো...
চার্চ থেকে   সে  সোজা যাবে  কালিম্পং বাজারে,  সেখানে  একটা  ফলের  দোকানে   সে  কর্মচারী ... তাকেই দোকান খুলতে   হয় ... দেরী হয়ে   গেলে  মালিক বড় কথা শোনায় ...
রাস্তার  পাশের  বুনো ফুলগুলো , সকালের  পাখিরা , পাইন বনের শনশনে  হাওয়া সব্বাই মার্থাকে গুড মর্ণিং  জানায় ... আর জেসাসের প্রতি করুাণায় আবার  চোখে   জল  আসে মার্থার ..
             খুব  ছোটো বেলা  থেকেই  কথা   বলতে পারে  না  মার্থা, শুনতেও পায় না ... কিন্তু তার  ফর্সা লালচে গাল, সিল্কের  মতো চুল, খুদে খুদে চোখ , মিষ্টি মনকাড়া ব্যবহার...  ফলের পসরা  সাজিয়ে  সে  যখন বসে প্রতিদিন , ভীড়   উপচে পড়ে তার দোকানে আর মার্থা  প্রতিদিন নতজানু হয়  তার  পরমেশ্বরের কাছে ... এই সুন্দর পৃথিবীতে   আরো একটা   দিন  উপহার  দেওয়ার   জন্য... আরো   একবার  বুক ভরে স্বাস   নেওয়ার   সুযোগ করে   দেওয়ার   জন্য...
 ছোটোবেলাতেই  মৃত্যু হয় মার্থার বাবা  মার ।  একটা কার   অ্যাক্সিডেন্টে । সেই থেকে   পিসির   কাছেই মানুষ মার্থা । পিসির বয়েস   হয়েছে  এখন। অসুস্থ। মার্থাই দেখা শোনা করে  তার । খাইয়ে  দেয় তাকে ।দুপুর  পর্যন্ত দোকানে   থাকে   মার্থা ।তারপর সূর্য   যখন উঠে  আসে  মাথার  ওপর ... পাহাড়ের  ঢাল  বেয়ে  লাফিয়ে  লাফিয়ে   নেমে   আসে   সে , বাড়ির  পথে, সিনক্লিয়ার রিট্রিটে একটা   কাঠের দোতলা  বাড়িতে  সে   আর  পিসি থাকে । সকালে  বাড়ি থেকে   বেরোনোর আগে  পিসিকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে , বারান্দায়
ইজি চেয়ারে বসিয়ে   দিয়ে  আসে , কাঠের   দোতালার  বারান্দায়  তখন  সবে ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণ পৌঁছেছে । বারান্দায়  রাখা মরসুমী  ফুলের  গাছ  আর অর্কিডের টবগুলো তখন মাথা দোলাচ্ছে   অল্প অল্প হাওয়ায় ....

                     মার্থাদের  কাঠের   বাড়িটা  সিনক্লিয়ার রিট্রিটের একেবারে শেষ প্রান্তে ... ঠিক যেখান থেকে   শুরু  হয় ঘন   পাইনের   বন । বর্ষাকালে পাহাড়ের  গা  বেয়ে নেমে আসে মেঘ ... পাইনের  পাতায় পাতায় ঝরে পড়ে বৃষ্টির  ফোঁটা হয়ে  , দু এক হাত দূরে দূরেই বর্ষার  জল পাহাড়ের ফাটল বেয়ে নেমে  আসে  দুরন্ত পাহাড়ি ঝর্ণা হয়ে ...কাঠের বাড়িটার  দোতালার তিনটে  ঘর  ভাড়া দেয় মার্থারা ... হোম স্টে  হিসেবে ... কিছু পয়সাও আসে ; সাশ্রয় হয় সংসারের । রান্না করে   দেয় মার্থা আর তার   সর্বক্ষনের সংগী  সিয়েন । সিয়েন স্থানীয় মেয়ে ; বড় ভালো। সবচেয়ে বড় কথা বোঝে  মার্থাকে ।
আর আছেন   জেসাস । যিনি মার্থার  সব   কথা বোঝেন ... শোনেন ... প্রতিদিন ...  কনফেশান বক্সে ...


               সে  ছিল  এমনই একটি দিন...থুড়ি রাত... ঘুম  আসছিল না মার্থার  দুচোখে... সিনক্লিয়ার রিট্রিটের তারাভরা আকাশটা নেমে  এসেছিল পাহাড়ের শেষ প্রান্তে  ... খাদের  গায়ে ; ঠিক যেখানে  শেষ হয়েছে   মার্থাদের বাড়িটা । সেই অপার্থিব সৌন্দয্যর্‍ দু চোখ ভরে দেখছিল মার্থা । হঠাৎ খেয়াল করে দোতালার একটা ঘরে   আলো জ্বলছে । পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে সে। হোমস্টেতে যেসব  ট্যুরিস্টরা আসে  তারা তো ঘুমিয়ে   পড়ে এ সময় । গতকালই একজন এসেছে অবশ্য । একটি ছেলে । বয়স  প্রায়  ত্রিশ পয়ত্রিশ। তামাটে রঙ। লম্বা চেহারা । ব্যাক ব্রাশ করা চুল । সবচেয়ে অদ্ভুত তার চোখের  চাউনি । উজ্জ্বল অথচ মায়াজড়ানো , স্বপ্ন মাখা । যেন কাছের  দিনের ছোঁয়াচ পার  করা চাহনি ... দূরে  নিবদ্ধ দৃষ্টি ।
বেশীক্ষণ তাকিয়ে  থাকতে  পারে নি মার্থা । পিসির  কাছে  বলেছিল  ট্রেকিং করতে   এসেছে । কালিম্পং এ কয়েকটা দিন  থেকে   একটু প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস   কেনাকাটা করে  নিতে   চায় । দরজাটা আলতো ভেজানো ছিল ; ঠেলা দিতেই খুলে   গেল । দরজার দিকে পিছন  ফিরে ছেলেটি এক মনে  ছবি আঁকছিল। সামনে  ক্যানভাস , মাটিতে পড়ে রয়েছে  তেল রঙের টিউব, প্যালেট, ব্রাশ। ক্যানভাসের  দিকে  চোখ পড়তেই চমকে  ওঠে মার্থা । এ যে তারই প্রতিকৃতি । এত সুন্দর যে... চোখ ফেরাতে পারে না সে । কখন যে সে  বসে  পড়ে ক্যানভাসের  সামনে  চেয়ারে  খেয়ালই  নেই মার্থার ... আর  একের পর এক তার ছবি এঁকে যেতে থাকে  সৌম্য । এভাবেই  কেটে   যায় সারা  রাত । এরপর  দুজনের  ভালোবাসায়  পড়তে
সময়  লাগে  নি একটুও ।  মূক বধির  মার্থার  কথা না  বলতে  পারাটা  কখনও অন্তরায়  হয়ে  দাঁড়ায় নি  তাদের   ভালোবাসায় ; আসলে  ভালোবাসার একটা   নিজস্ব ভাষা   থাকে   থাকে  নিজস্ব   বডি ল্যাংগুয়েজ । জানা  গেল আর্মি অফিসার সৌম্যর  প্রথম প্যাশান  ছবি আঁকা  , দ্বিতীয় প্যাশান  ট্রেকিং । আজন্ম  পাহাড়ের  কোলে   বড় হওয়া মার্থা  যেন  পাহাড়ি ঝর্নার মতো  মিশে  যায় সৌম্যের বুকে ... পাহাড়ি নদী খুঁজে পায় সমুদ্রকে ... পাহাড় মার্থার   রক্তে ... সে  সৌম্যকে চেনায় পাহাড়ি পথের  বাঁক, চড়াই উতরাই, অজানা বিপদ ... দুটিতে  একসঙ্গে ঘুরে আসে   সান্দাকফু ফালুটের ট্রেক রূট ।

           একসময় ছুটি শেষ হয়ে  আসে   আর্মি অফিসার সৌম্য  চক্রবর্তীর । জরুরী তলব আসে  ডিউটির  , যেতে হবে  সিয়াচেন গ্লেসিয়ার ।কয়েকদিন থেকেই কালিম্পং পাহাড়ের মুখ ভার ; আকাশ ছেয়ে   আছে   ঘন  কালো মেঘে , থেকে থেকে  ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি  আর   হালকা হাওয়া ... যেন আসন্ন বিদায়ের  প্রস্তুতি নিচ্ছে  প্রকৃতিও ...যাওয়ার আগে  সৌম্য বিদায় চাইতে আসে মার্থার কাছে ... দুজনে  দুজনের  চোখের  দিকে  তাকিয়ে   থাকে  নিষ্পলক... সময়ও যেন কথা হারিয়ে ফেলে স্তব্ধ হয়ে   আছে ... এক একটা  মূহূর্ত যেন   একটা  যুগ । সৌম্য ইশারা্য বলে   মার্থাকে  তোমায়  একটা উপহার  দিতে  চাই মার্থা । আমার ঘরে   রাখা   আছে ; কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর তুমি উপহারটা দেখবে ।আর যদি ফিরে আসি সিয়াচেন থেকে আমি যে
ঘরে  থাকতাম সেখানেই সংসার পাতব তোমায় নিয়ে ।  সৌম্য চলে যাওয়ার পর  সেদিন সন্ধ্যায় মার্থা উঠে  আসে   দোতালার   ঘরে । ঘরের ঠিক মধ্যিখানে  একটা  বিশাল ক্যানভাস , পাতলা কাপড় দিয়ে ঢাকা । কাপড়টা   সরাতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় মার্থার । একটা যীশাসের অপূর্ব মূর্তি আর  তার সামনে   কনফেশান বক্সে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে ... ছবিটার নাম কনফেশান বক্স ...

                বেশ কয়েকমাস   পর মার্থার নামে  একটা চিঠি আসে। গোলাপী খামে । সৌম্য লিখেছে   আমার অনিশ্চিত  জীবনের   সঙ্গে   তোমায় জড়াতে  চাই না মার্থা। তাই চললাম। আমায় ভুল বুঝো না। পারলে  ক্ষমা করে দিও । সেই থেকে দোতাল্রার ঘরটা  খালিই পড়ে থাকে , ওই ঘরটা   আর হোম স্টে হিসেবে  ভাড়া দেয় না  মার্থা ...  ঘরের মধ্যিখানে   সেই বিশাল ছবি  কনফেশান বক্স। মার্থা   এখন  এখানেই সকালের   প্রার্থনা  সারে ...