আবার বসন্ত
মা তুমি
বুঝতে পারছো না কেন বলোতো?........না বুঝতে চাইছো না?..
অভি আর আমি দুজন দুজনের ভাল
বন্ধু মা..
'কি জানি বাপু তোর মতো এমন
অগোছালো মেয়ে
দেখিনি '....
এতো দিনের সম্পর্ক কি শুধুই
বন্ধুত্ব তুলি...... ?
কি সম্পর্কের কথা বলছো মা ??
দুজনে একসাথে পড়াশোনা, বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা দেখা ,শপিং করা কে
তুমি এ ভাবে নিচ্ছো কেন মা আমার মাথায় আসছে না ? আর সামনে অভির বিয়ে , এখন এ কথা
মুখেও এনোনা--
বলছি কি আর সাধে তুলি, পারবি
সহ্য করতে চোখের সামনে অভি অন্য একটা মেয়েকে জীবন সাথী বানাবে ? ?
না পারার কি আছে মা ? দেখো মা, অভি আমার
খুব ভালো বন্ধু , বিপদে আপদে দুজনেই দুজনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি তার মানে এই নয় যে ওকে বিয়ে করতে হবে, অভি জানতে পারলে কি ভাববে বলোতো ?তাছাড়া তুমিই বা ধরে নিচ্ছো কেন যে অভি আমাকে নিয়ে ঘর
বাঁধতে চায়?
আমার কথায়
রাগ করিস না তুলি , অভিকে আমিও অনেক দিন ধরে চিনি, জানি , তুই বুঝতে
না পারলে কি হবে আমি বুঝতে পারি ওর মনের ইচ্ছাটা কি , তোর প্রতি
অভির দুর্বলতা আছে , আমার চোখ মিথ্যেকথা
বলেনা...... সত্যি মা তুমি পারোও ভাবতে ??
দেখো মা , অভি আর আমি খুব ভালো বন্ধু , দুজন
দুজনকে ভালোবাসি কারন ওর সাথে আমার মেন্টালিটি খাপ খায় ,তার মানে
এই নয় যে অভিকে বিয়ে করতে হবে ?--- অভির আমার
সম্পর্ক টা আলাদা , এটাকে এ ভাবে ভেবোনা প্লীজ মা --
তোর মতন মেয়ে যদি বিশ্বে একটা থাকে..... বুঝতে পারি না তোকে আজ ও তুলি। শীত পড়তে না পড়তে অভির জন্য সোয়েটার বুনিস গাছের প্রথম ফলটা ঠাকুরের বদলে ওকে খাওয়াস ওর অপছন্দের সাজগোজ করিস না ,এটা কে কি বলে শুধু বন্ধুত্ব ? আমি নিজে দেখেছি তোর হাতের নোখ রাখা ওর পছন্দ না বলে ওর সামনে বসেই দাঁত দিয়ে নোখ কেটে
ফেললি- এ আচরণ গুলো কি তাহলে তুলি ?
মা এই আচরণ গুলো বিয়ের সম্পর্ক
তৈরি করে না ? ধুর , তখন থেকে
শুধু একই কথা ,থামোনা মা , ক্ষিদে পেয়েছে সঙ্গে ঘুমও -------
বিছানায় শুয়ে কেন যে ঘুম আসছে না আমার ,মা যে কেন বোঝেনা কে জানে, কি এমন মেলামেশার কথা মা ভাবছে -- একসাথে গল্প, আড্ডা , এমন কি হালকা মারামারিও , তাই বলে বিয়ে --- একবার তো অভি বাবলগাম খেয়ে আমার চুলে আটকে দিয়েছিলো , কি কান্না কেঁদেছিলাম কতোটা চুল কেটে ফেলতে হয়েছিল আমার , আর অভি হা
হা করে হাসতে হাসতে বলেছিল , কাঁদিস না তুলি তোর মাথায় একটা চুল না থাকলেও আমিই তোকে বিয়ে করবো ,ন্যাড়া মাথায়
সিঁদুর তোকে দারুণ মানাবে - আমি রেগে হাতের বালিশ এমন
জোরে ছুঁড়েছিলাম যে সোজা অভির জন্য আনা ভরা চায়ের কাপ মায়ের হাত থেকে পড়ে চুরমার । আমার আড়ালে
সাইকেলের পাম্প ইচ্ছেকরে বার করে বলতো হেঁটে হেঁটে
কলেজে কখন পৌঁছাবি তার চেয়ে বরং আমার বাইকে চল ? এই ধরনের আচরন তো হামেশাই করতো অভি --গতবছর দোলপূর্ণিমার
দিন সন্ধেবেলায় ঠাকুর ঘরের সামনে মায়ের পায়ে আবীর দিয়ে
প্রনাম করে ঝুল বারান্দায় এসে বাকি সমস্ত আবীর আমার মাথায় কপালে ছড়িয়ে দিয়েছিলো
অভি , আমি তো তখন এই মারি কি সেই মারি -- অভি কানের কাছে মুখ এনে বলেছিলো “যা তুলি আজ তোকে আমি লাল আবীর পড়িয়ে গন্ধর্ব মতে বিয়ে করলাম ” বুকটা
ক্ষনিকের জন্য কেঁপে উঠেছিল ঠিকই - আমি ওর মাথার চুলগুলো হাতদিয়ে
এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিলাম "সে গুড়ে
বালি” , তোর মতো ছেলেকে বিয়ে করার চেয়ে
পানাপুকুরে ডুবে মরা ভালো - শুনে অভি হাসতে হাসতে
বলেছিলো পরে পস্তাবি নাতো ? আমিও হাসতে হাসতে বলেছিলাম এই তোর গন্ধর্ব মতে বিয়ে করাকে ডিভোর্স
দিলাম আমি তোকে বিনা নটিশে-- নেহাৎ মা মিষ্টি
মুখ করার জন্য নীচে ডাক পারলো নইলে হয়তো আমার চুলের বিনুনি তে খুব জোরেই টান পড়তো-- ধুর কি সব পুরোনো কথা ভিড় করছে মাথায় এখন - মার
কথাগুলো শোনার পর
থেকে মনটা কেন
এমন টনটন্ করছে, বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে চাপা কান্না ঠেলে উঠছে কেন? গলাটা
ভেতর থেকে শুকিয়ে যাচ্ছে------ আমার মনের ভেতরটা এতো তোলপার করছে কেন মা - আমি তো কোনোদিন তোমার মতো করে এ ভাবে ভাবিনি , উফ্ফ এতো কেন দমবন্ধ লাগছে , আমার চোখ দুটো কেন এতো বেইমানি করছে বলোতো ? এই নোনা
জলকি চোরা প্রেমের স্রোত ? আমি ও কি তাহলে ?--
না আর ভাবতে পারছি না, অভি এখন
কি করছে ? নিশ্চয়ই হবু বউয়ের সাথে মোবাইল এ কথা বলছে, কি কথা
বলছে ওরা ! নিশ্চয়ই আমার সাথে যে ধরনের কথা বলে অভি তার থেকে আলাদা অন্যকিছু ! উফ্ফ আর পারছি না ভাবতে, সত্যিই
চোখদুটো বশ মানছে না কিছুতেই - মা তোমরা কি করে সন্তানদের মনের কথা পড়তে পারো ? মা তুমি কি সত্যি এতো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ? একটু কাছে ঘেসে ঘুমাও না , আমার ভীষন
একলা লাগছে নিজেকে ,আমি যে আর পারছিনা মাগো- আজ হৃদয়ের মনিকোঠায় যত সুপ্ত প্রেম আছে সব উথলে চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে । তুমি ঠিক বলেছো মা আমি কিছুতেই অভির বিয়ে চোখের সামনে দেখতে পারবো না-- আগামী কাল দোল খেলা সারা আকাশ বাতাস রঙিন চাদরে মুড়ে থাকবে নইলে কালকেই চলে যেতাম পলাশপুরে মামার বাড়ি । পরশুই চলে যাবো অভির সাথে দেখা হওয়ার আগেই-----
ঘুম থেকে চোখ খুলেই তুলি দেখে অভি হাজির । মাকে আড়াল করে দেখায় হবু বউ এর এনগেজমেন্ট রিং । কেমন হয়েছে বললি না তো তুলি ? কিরে তোর আবার কি হোলো ?ঠান্ডা লাগিয়েছিস? চোখদুটোকে ফুলিয়ে রামুচাচার গাছের আমড়ার মতো মোটা করেছিস , দেখি তো
কপালে হাত দিয়ে জ্বর কতো ? মুখটা গোমড়ামুখো করে আছিস কেন? কালকে খুব লেট করেছে রাজধানী এক্সপ্রেস। খুব ক্লান্ত লাগছিল । খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই কাল আসতে পারিনি । এই কান ধরছি একটু দাঁত বার করে হেসে মাড়িটা দেখা-- কি হয়েছে তোর তুলি ?কেমন
চুপচাপ ?আমাকে বলবি না? দেখ তোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনা এটা তুই ভালো করেই জানিস।মনকে শক্ত করে তুলি - কিছুতেই যেন অভি বুঝতে না পারে গতকাল সারারাত আমার মনের ভেতর কি ঝড় গেছে ----মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বলে তুলি ,
আংটি টা খুব সুন্দর হয়েছে অভি তবে সবুজ পাথর হলে আরো ভালো মানাতো --তুলি তুই তো বলিস শ্যামবর্ণ গায়ে সবুজ পাথর মানায় না তাহলে ? আমার মতো কি তোর হবু বউ কি যেন
নাম ? হু, চন্দ্রানী কি শ্যামবর্ণা ? ছবি দেখালি যখন তখন তো খুবই
ফর্সা লাগলো। আর কমাস পরে নতুন জীবন কেমন লাগছে তোর অভি ? খুব ভালো রে তুলি ---কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা ঠিক শ্রাবন
মাসের রিমঝিম বৃষ্টির মতো কখনো কখনো উত্তরে ছাট কখনো দক্ষিণে তো কখনো পূবে
পশ্চিমে এক ঝলক ঠান্ডা বৃষ্টি মেশানো বাতাস গায়ে লাগলে যেমন অনুভূতি ঠিক
সেইরকম -জোর করে মুখে উচ্ছাস ধরে রাখে তুলি , বুকের ভেতরের ধিকিধিকি ভালোবাসার আগুন হাসি দিয়ে চাপার চেষ্টা করে চলে মনের সাথে মুখের। এখন চলি তুলি ,একটু অফিসিয়াল কাজ সারবো ল্যাপটপে
।যেমন গতরাতে তুলির বুক ভেঙে বৃষ্টি হয়েছিল তেমনি ভোরবেলায় বৃষ্টি হওয়ায় সারাদিন কাটাকাটা মেঘ আকাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। তাই সন্ধ্যা বেলাতেও একটা ঠান্ডা ভাব ছাদে।দোল পূর্নীমার চাঁদের সাথে আজ মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে সমানে ,কেমন যেন উদাস করা হাওয়া চারিদিকে ,মালতি আর মাধবি লতা গাছ ফুলে ভর্তি । ম ম করছে গন্ধে , জোৎস্না
এসে পড়েছে ফুলের উপর , আজ বুকের ভেতরটায় গতরাতের মতো উথালপাথাল নেই ঠিকই কিন্তু কোথায়
যেন ভারী পাথর চাপা লাগছে বুকে । আজ অভি ঠিক চন্দ্রানীর বাড়ি যাবে, নিশ্চয়ই পাঞ্জাবীর পকেট ভর্তি
আতর মাখানো আবীর থাকবে । চন্দ্রানী বাধা দেবে না অভিকে ঠিক ই প্রশ্রয় দেবে আবীর মাখানো তে ----- জোৎস্নার
চাঁদোয়ায় শরীর ঢেকে আতরের গন্ধে মাতাল হবে ওরা। ছাদে শুয়ে অবসাদে
চোখ লেগে আসে তুলির । কত সময় পার হয়েছে কে জানে তুলি চোখ মেলে দেখে অভির কোলে ওর মাথা আর আংটি টা তুলির ই অনামিকায় পড়ানো। দু চোখ বেয়ে জলের ধারা তুলির, অভি কানের
কাছে মুখটা এনে বলে ,গতবছর এই তিথিতে তোকে গন্ধর্ব মতে বিয়ে করেছিলাম আবীর মাখিয়ে, আজ
একবছরের পূর্ণ লগ্নে আবার লাল আবীরে ভরিয়ে দিলাম।কিন্তু চন্দ্রানীকে
এই ভাবে কষ্ট দেওয়া সইবে আমাদের অভি ? একগাল হেসে অভি বলতে থাকে ও তো
আমার বন্ধুর প্রেমিকা দিল্লীতে থাকে ,তোকে জাগানোর
জন্যে এই পথ বাছতে হয় আমাকে ।এই পথের পরিচালক সয়ং আমার মাতৃসমা দিদি আর তোর মা মানে আমার হবু শাশুড়ি মাতা ---- আজ আর তুলি
কোনো কথা বলে আবেগটা নষ্ট করতে চায়না ----চোখের পাতা ভারী
হয়ে আসে অভির ঠোঁটের স্পর্শে----।