গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

কেকা সেন



নোনতা

রূপা, সমুদ্রের পাশ থেকে গাড়িটা যাওয়ার সময় জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিল খানিকটা। সমুদ্রের নোনায় মেশা  সূর্যের রক্তিমটাকে শরীরের উন্মুক্ত অংশে মাখবে বলে। কিন্তু তার আর উপায় কোথায়? তার বাতিকগ্রস্ত অতি কেয়ারিং হাসব্যান্ড সংগে আছে যে! 
-আরে আরে কি করছ রূপা, তাড়াতাড়ি বন্ধ কর জানালা। ঠান্ডা লেগে যাবে। আর চাদরটা খুললে কেন আবার?
-আরে বাবা সমুদ্রে কারও ঠান্ডা লাগে না।
-না না জেদ কোর না, সর তুমি
বলেই গাড়ির কাঁচ তুলে দেয় রূপার বাতিকগ্রস্ত স্বামী দেবরাজ।

সকাল সকাল হোটেলে পৌছে রূপা ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে লাগল। দেবরাজ ব্যস্ত নিজস্ব জিনিসপত্র গোছগাছে। রূপা-দেবরাজের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্তি আজ। সমুদ্র রূপার পছন্দের, তাই এখানে আসা।
ইলেকট্রিক কেটলিটা ঢোকাওনি ব্যাগে?  প্রশ্ন দেবরাজের
না, ভুলে গেছি। হোটেলেই আছি, চা অর্ডার করে দিলেই হল! 
-উফ! তুমি যে কি কর না! মা, বারবার বলে দিয়েছে বাইরে গেলে এভাবেই চা খাবে!
-তুমি কি সবসময় মায়ের সব কথা শোন, সোনা? তো এটা নিয়ে ভাবছ কেন?
চল, অর্ডারটা আমিই করে দিচ্ছি বলে রূপা ইন্টারকমে অর্ডারটা  করে দিল।
চা খেয়ে ওরা পায়ে পায়ে সমুদ্রের বালি মাখতে বের হল। আজ কতদিন পর একটা স্বাধীন হাওয়া গায়ে মাখছে রূপা। পাঁচ বছর পর! সেই বিয়ের পর হানিমুনে ভাইজাগ। তাও একেবারে এক অচেনা ব্যক্তির হাত ধরে। বিয়েটা অবশ্য বেশ তড়িঘড়িতেই হয়েছে রূপার। বিশেষ কারনে বিশেষ ব্যাবস্থায় বিয়ে। সমুদ্রের দিকে চেয়ে রূপা একটা বড় করে নিঃশ্বাস  নিল। 
-চল, স্নানে নেমে পড়ি!
-কি যে বল! কিছু আনিনি!
-তাতে কি? সামনেই হোটেল!
-আমি অমনি করে স্নান করতে পারব না
-থাকো তবে তুমি বলে সমুদ্রের দিকে হাঁটা দিল রূপা।
-এই রূপা, কথা শোন, যেও না!
আজ আর রূপা থামবে না, পিছনেও চাইবে না। ঢেউ যে তাকে ডাকছে অনবরত। আকাশ ছোঁয়া সমুদ্রে রূপা নিজেকে ঢেউ এর তালে ভাসিয়ে দিল।

বিকেলবেলা দুজনে মার্কেটিং বেজায় ব্যস্ত যখন, তখনই দেবরাজের মোবাইলটা বেজে ওঠে। " একটা মোবাইল পাওয়া গেছে স্যার,সমুদ্রের ধারে বালিয়াড়িতে। আপনার নম্বরটাই রিসেন্ট কল ছিল, তাই আপনাকেই বললাম। উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যান। ফোন খোলাই থাকবে, কল করবেন। আমি সমুদ্রের ধারে মোনালিসা হোটেলে আছি, স্বর্গদ্বারের কাছেই এটা। নাম, আয়ুধ মহম্মদ খান।" বলেই ফোনটা কেটে গেল। 
-এই রূপা তোমার মোবাইল কোথায়?
-কেন, ব্যাগে!
-বার কর একবার
তন্ন তন্ন করে ব্যাগ খুঁজেও মোবাইল পাওয়া গেল না আর।
-সমুদ্রের ধারে বসে মায়ের সংগে কথা বলেছিলাম একবার, তারপর ফুচকা খেতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় আর খেয়াল নেই
-এইজন্য বলি তাড়াহুড়োটা একটু কম করতে, দেখলে কি হল! এখন চল একজন পেয়েছেন মোবাইলটা।  আমাকে ফোন করে  জানালেন এক্ষুনি।
-কি?                                          
-হ্যা, সে আবার মুসলিম,  আয়ুধ খান!
নামটা শুনেই বুকের মধ্যে হাজার ঢেউ খেলা করতে শুরু করল!
কি, কি নাম বললে?
-আয়ুধ আয়ুধ
নামটা শুনেই পরম যত্নে মনের গভীরে বন্দি লাল নীল প্রজাপতিগুলো ডানা মেলে উড়বার চেষ্টা করতে লাগলো। কোন আয়ুধ জানবার, দেখবার ইচ্ছা প্রবল হতে থাকলো রূপার।
বেশী কসরত করতে হল না, মোনালিসা হোটেলের বাইরেই আয়ুধকে পাওয়া গেল।
লম্বা চওড়া ফর্সা টিকোল নাকের আয়ুধ। যার মাউথ অরগান সুরে রূপার  মন মেতেছিল ফাল্গুনী হাওয়ায়। সবকিছু ছেড়ে  একদিন হারিয়ে যেতে চেয়েছিল অজানা পথে, সেই তার অনেক যত্নের গোপন আদরের আয়ুধ। একবার তাকিয়েই আর চোখ ওঠায়নি রূপা।
-গুড ইভিনিং মি: আয়ুধ। এই আমার স্ত্রী আর মোবাইলটা এনারই। আপনি আমায় কল করুন ওখান থেকে, দেখে নিন।
-না তার আর দরকার নেই মিস্টার: ..
-দেবরাজ, দেবরাজ রায়।
-হ্যা দেবরাজবাবু, যা দেখার দেখে নিয়েছি আমি। এই নিন আপনার মোবাইল মিসেস রায়।
কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা নিল রূপা।
-অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আয়ুধবাবু
-আমাকে বাবু বলবেন না, শুধু আয়ুধই বলুন ধন্যবাদ কিসের আমি অন্যের জিনিস ভোগ করি না, ধাতে সয় না!
-মানে! ঠিক বুঝলাম না!
-দেবরাজ, মোবাইল পেয়ে গেছি আমরা, এবার তবে যাই
-হ্যা হ্যা চল"
 একরকম টেনে হিঁচড়েই দেবরাজকে নিয়ে আসে রূপা। 

রাত্রিবেলা ডিনার সেরে ক্লান্ত মনে বিছানায় শরীর ফেলে দেয় রূপা। অবসন্ন মনে যখন সবকিছু এলোমেলো,  তখনই শুরু হয় দেবরাজের ভালোবাসার খেলা। 
-আজকে আমায় রেহাই দেওয়া যায় না! রূপার কাতর কণ্ঠের জবাবে দেবরাজ বলে--
-কিছুতেই না, আজ আমাদের বিশেষ দিন,আমি কোনও বারন শুনবো না তোমার।
রূপার নিঃশব্দ অশ্রু বলে ওঠে -- কোন রাতে তুমি ছেড়েছ... .মন বোঝনি তুমি...শরীর ছিঁড়েছ। বালিশ ভেজা যন্ত্রণায় রাতের অন্ধকার আরও গভীর হয়। 
অনেক ভোরেই বিছানা ছাড়ে রূপা। একাই বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রের মুহুর্মুহু ডাকে। সূর্যের লালিমা একটু একটু করে অন্ধ আকাশে যখন প্রাণের ছবি আঁকছে, ঠিক সেই মূহুর্তেই পিছন থেকে ডাক আসে--- কেমন আছ মাধু?
চমকে উঠে পিছনে ফিরে আয়ুধকে সামনে পায় রূপা। সেই চেনা গন্ধটা বাতাসে অনুভব করে রূপা, বুক ভরা শ্বাসে বলে-- আপাতত ভাল।
-বেশ! খুশী হলাম আমি! আমার মাধু আজও মন থেকে আমারই আছে জেনে!
-কে বলল সে কথা?
তোমার চোখ আর আমার অনুভব!
-ভুল জানলে তুমি, তোমার মাধুরী পাঁচ বছর আগেই মরে গেছে!
-ভুল বোঝাচ্ছ তুমি আমায়!
-ছাড় এসব কথা, এখানে কি কাজে আয়ুধ কুমার!
-স্যান্ড আর্ট নিয়ে কাজ করছি এখন, ভালো সাড়াও পেয়েছি! সামনেই জাপান যাব এই কাজেই।
-, তো খুব ভাল খবর! বিয়ে করেছ?
-না, কোন মাধুরীকে পাইনি আর খুঁজে
-বাজে বোক না, পাঁচ বছর আগে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি শুধু তোমার জন্য, আসনি তুমি সেদিন মিঃ ভিতু আয়ুধ কুমার!
-কি করব আমি? তোমার বাবা আর আমার মা দুজনেই আত্মহত্যার হুমকি দিল আমায়। হিন্দু- মুসলিম বিয়ে তাঁরা প্রাণ থাকতে মানতে পারবেন না। দুটো প্রানের বিনিময়ে কি আমরা সুখী হতে পারতাম?
এখনও কি সুখে আছি’! নিজের অজান্তেই অস্ফুটে কথাটা বেরিয়ে পড়ে রূপার।
-এখন চল না রূপা, সবকিছু ভুলে নতুনভাবে শুরু করি!
দূর থেকে রূপা রূপা  ডাক শোনা যায় দেবরাজের।
-তা আজ আর হয় না আয়ুধ কুমার! তুমি চলে যাও। দেবরাজ আসছে। আমায় রূপা হয়েই থাকতে দাও। নতুন করে রূপার গায়ে আর মাধুরীর ছোঁয়া আসবে না। ফিরে যাও তুমি তোমার জায়গায়।
ছলছল চোখে আয়ুধ পিছনে পা ফেলতে থাকে।
সমুদ্রের দিকে এগোতে থাকে মাধুরী। চোখের নোনতা স্বাদ কখন যেন সমুদ্রের নোনতায় মিশে যায়। সূর্যের গনগনে আঁচে রূপা রূপালি আভায় চকচকে হয়ে ওঠে।