ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী-৪২
ভৌতিক রেলওয়ে স্টেশন, বেগুনকোদর
শশীভূষণ, জনান্তিক ও অর্ণব তিন বন্ধু এক সঙ্গে বিকেলের আড্ডা জমিয়ে চা-ভাজিয়ার
মজা নিচ্ছিলেন। বাইরে তখন ভীষণ গরম চলছে। গ্রীষ্মের সময় আকাশে সামান্য
মেঘ জমেছে। তবে কখন যে বৈশাখী ঝড় শুরু হবে তা কেউ বলতে পারে না। ওঁদের তিন বন্ধুর
গল্প ঘুরে ফিরে সেই অলৌকিক ঘটনার মাঝেই ঢুকে পড়ছিল। এই মাঝ বয়েসী তিন বন্ধুর হাতে অফুরান সময় থাকে। সময়ের অনেকটাই তাঁরা খরচ করেন
নানা ভৌতিক, প্যারানর্মাল সত্যাসত্য যাচাইয়ের মধ্যে দিয়ে। খোঁজ খবর নিয়ে প্রায়ই ওঁরা হ্যান্টেড প্লেসের
দিকে বেরিয়ে যান। এমনি অভিযানের প্রায় সবগুলিই চলে বেশ রাতে।
কলকাতার
ভেতরে অনেক জাগাই তাঁরা অভিযান চালিয়েছেন। বর্তমানে ওঁরা কলকাতার বাইরে নজর
রাখছেন।
শশীভূষণ
ওঁদের মধ্যে সিনিয়র। তাঁর উৎসাহটাই বাকি বন্ধুদের চে অপেক্ষাকৃত বেশী। বলা যায়
ওঁদের সব অভিযান গুলির পরিচালক হলেন শশীভূষণ।
তিন বন্ধু
মিলে বেশ পরিমাণে চা-ভাজিয়া ধ্বংস করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলেন। শশীভূষণ বললে, এই দেখ, একটা ভিডিও দেখ, এতে বেগুনকোদর স্টেশনের কথা দিয়েছে। তোদের তো বলেছিলাম এ স্টেশনের বদনাম আছে। এখানে ভূতের
ভয়ে নাকি স্টেশন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
জনান্তিক
বলে উঠলো, তার মানে আমরা সেখানে গেলে ভূতের দর্শন পাবোই ?
শশীভূষণ
বললেন, আমার তো তাই মনে হয়।
অর্ণব মনে হল ভয় পেলেন, তিনি বললেন, আরও দু একজন সঙ্গে নিয়ে গেলে
ভালো হয় না ?
জনান্তিক
বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, না, না, আমরা তিন জনই
যথেষ্ট। ভিডিওটা এবারচালা তো--জনান্তিক শশীভূষণকে বললেন।
বাইরে
বৈশাখী হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। ঝড় শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে। অর্ণব কাউকে কিছু না বলেই
ঘরের জানলা দুটো বন্ধ করে দিয়ে এলেন। শশীভূষণের
কাজের লোক,বেণু। সে ঘরের সব কাজ যথা সময়ে ঠিকঠাক করে রাখে। ও সম্ভাবনা
দেখে ঘরের লন্ঠন মুছেটুছে তৈরিই রেখেছিল। ঝড় জল শুরু হল তো লাইট চলে যাবার
সম্ভাবনা থেকেই যায়। মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই লাইট চলে গেল। ঘর অন্ধকার হয়ে
যেতেই বেণু সেটা
জ্বালিয়ে নিয়ে এলো। এ সময়টা মোমবাতি চলে না। ঘরের দরজা
জানালার ফাঁকফোকর গলিয়ে যেটুকু বাতাস ঢুকে যায় তা মোমবাতি নিভিয়ে ফেলার পক্ষে
যথেষ্ট। এই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখা আলাদা ভাবে শশীভূষণের
ব্যবস্থা। এমনটা সচরাচর কলকাতা নগরীতে দেখা যায় না বটে।
তিন বন্ধু
বিছানাতে গিয়ে বসলেন। শশীভূষণ ল্যাপটপে ভিডিও চালিয়ে দিলেন। বেগুনকোদর স্টেশনের
বর্ণনা ও ভৌতিক গল্পের ভিডিও শুরু হয়ে গেলো--এক নারী কণ্ঠের বর্ণনা চলছে-- ‘‘পশ্চিম বঙ্গের পুরুলিয়া জেলার
বেগুনকোদর রেলওয়ে স্টেশন। লোকমুখে এখানকার অনেক ভুতুড়ে গল্প প্রচলিত আছে।
...শোনা যায় ১৯৬০ সালের কোন এক দিনে
মাঝ রাতে এখানকার স্টেশন মাস্টার ও তার স্ত্রী খুন হয়েছিলেন। তারপর দিন নাকি
স্টেশন সংলগ্ন কুয়াতে তাদের মৃত দেহ ভাসতে দেখা যায়।...এ ঘটনার পর থেকেই নাকি এখানকার অশরীরী কার্যকলাপ শুরু হয়।...সন্ধ্যের পরে ভয়ে কোন লোক এ স্টেশনের ধারকাছ ঘেঁষে না।..এমন কি রাতারাতি এখানকার রেল কর্মচারীরা ভয়ে স্টেশন ছেড়ে
পালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কোন ট্রেনই এখানে আর থামে না। লোকে বলে রাত হলেই অশরীরী আত্মারা সারা স্টেশন
জুড়ে ঘুরে বেড়ায়।...তাদের চলাফেরার আওয়াজ হয়। ফিসফিসিয়ে কারা যেন কথা বলে--আবার রাতের অন্ধকারে বেগুনকোদর স্টেশনের অন্ধকারে জ্বলে ওঠে নানা রঙের আলো। সে
সব আলো নাকি নাচানাচি করে খেলে বেড়ায়…এসব
ব্যাখ্যাতীত ঘটনার সত্যাসত্য প্রমাণ করার কেউ নেই। একদিন স্টেশনে অনেক চহলপহল ছিল। কিন্তু সে সব স্মৃতি হয়ে গেল। এখানে
ট্রেন থামে না, প্রতিদিন সন্ধের পর একাকী ভূতের
মত দাঁড়িয়ে থাকে বেগুনকোদর রেলওয়ে স্টেশন। এই স্টেশনের পাশ দিয়ে আপ-ডাউন
ট্রেনগুলি দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায়। আর একলা হয়ে সারারাত
হানা বাড়ির মত পড়ে থাকে এই পুরুলিয়া জেলার বেগুনকোদর স্টেশন...তারপর ২০১০সালে
আবার বেগুনকোদর স্টেশন যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। স্টেশন
বিল্ডিং,প্ল্যাটফর্ম, তার চারপাশের কোয়াটারগুলি আবার
রং করিয়ে দেওয়া
হয়। দু-একটা
ট্রেনের স্টপেজ রাখা হয়। দিনের শেষে ট্রেন থামে সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটায় রাঁচি চন্দ্রপুর ধানবাদ।
রেলওয়ে স্থায়ী কর্মচারীরা ভয়ে এখনও স্টেশনে
থাকে না, আজও প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আলো জ্বলে না। চারদিক সুনসান, মৃত নগরীর
মত পড়ে থাকে। এখানে কিছুদিন আগেই এক অ্যাডভেঞ্চার টিম এসে ঘুরে যায়। তাদের মতে এই স্টেশনে এখনও
অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়...’’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
শশীভুষণ ও তার বন্ধুরা ঠিক করলেন আগামী শনিবার যে দিন কিনা
অমাবস্যা রাত হবে সে দিন বেগুনকোদর স্টেশনের দিকে ওঁরা রওনা হবেন।
কথা মত
তিন বন্ধু বেলা প্রায় সাড়ে বারোটার ট্রেন ধরলেন হাওড়া স্টেশন থেকে। আপাতত ওরা
যাবেন আসানসোল পর্যন্ত। সেখান থেকে
বিকেল ছটার ট্রেনে রওনা দেবেন বেগুনকোদর স্টেশনের দিকে। বোঝা গেল ইদানীং বেগুনকোদর স্টেশন আবার আগের মত যাত্রী
ট্রেনের স্টপেজ হয়ে গেছে। শশীভূষণ ভাবলেন, তবে কি বেগুনকোদর স্টেশনে এখন আর
ভূতের ভয় নেই ?
জনান্তিক
ও অর্ণবের মনেও একই প্রশ্ন জেগে উঠেছিল। তবু ওঁরা স্থির করলেন যখন একবার যাওয়া
স্থির করে নিয়েছেন তখন অবসর বিনোদনের জন্য হলেও একবার না হয় বেগুনকোদর স্টেশন
তাঁরা ঘুরে আসবেন।
আসানসোল
পৌঁছতে বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেল। হাতে তখনও দেড় ঘণ্টা সময় আছে। এভাবেই তারা ছ’টার
প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে রাত প্রায় এগারোটার দিকে গিয়ে পৌঁছালেন বেগুনকোদর স্টেশনে।
এখানে দু-তিন মিনিট স্টপেজ আছে। আর একটি
প্যাসেঞ্জারও নেই, ওরা তিন জনই মাত্র আছেন এই স্টেশনে নামার মত। নামলেন ওঁরা। চারদিকে ঘুটঘুটে
অন্ধকার। প্লাটফর্মের মাঝখানের শেড দেওয়া বিল্ডিংয়ের কাছে একটা
মাত্র টিমটিমে কম পাওয়ারের লাইট জ্বলছিল। কোন জনপ্রাণীর সাড়া নেই। ট্রেন চলে
যাবার পরে শশীভূষণদের মনে হতে লাগলো তারা যেন এক অজানা কোন নিষ্প্রাণ গ্রহে চলে
এসেছেন। অন্ধকারের মধ্যে দূরে মাঝেমধ্যে জ্বলে উঠছিল সব জোনাকির
দল। দূরে
কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁঝিঁ স্বরের রেস থেকে থেকে কানে এসে বাজছিল।
প্রতিবারের
মত অর্ণব ভয়ে ভয়ে প্লাটফর্মের উপরে ধীর পায়ে চলছিল। ওঁর মনে হচ্ছিল যে এখনই
হয়ত তার কানে ভেসে আসবে ফিসফিস শব্দ যেমনটা ওরা ভিডিওতে শুনতে পেয়েছিলেন। অর্ণব, শশীভূষণ ও জনান্তিকের মাঝখানটা কখন যেন দখল করে নিয়েছেন।
মাঝেমধ্যে শশীভূষণের মোবাইলের টর্চ সামান্য আলোর ফোকাস ফেলছিল। খুব ধীর গতিতে ওঁরা চারদিক দেখে দেখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। স্টেশনের অফিস ঘরএখানে আলোটা জ্বলছে। বেশ লম্বা
প্ল্যাটফর্মের পরিধি। ওদের মনে হতে লাগলো,কখন অলৌকিক কিছু তাদের চোখের
সামনে এসে প্রকট হবে। তবে এটা মানতেই হবে যে যা রটে তার কিছু তো হয় বটে। এ সব ঘটার
ব্যাপারগুলোই তো আজকে তাঁদের দেখে নেবার দিন। এর কতটা সত্য তা আজই তাঁদের কাছে স্পষ্ট হবে। এ বিশ্বাস নিয়েই তাঁরা এতদূর এসেছেন। স্টেশন লাগোয়া এখানে নাকি একটা বড় বাজার ছিল এখন নিশ্চয়ই নেই। একবার ভেঙে
যাবার পরে আবার তা তৈরি হওয়া এত তাড়াতাড়ি হয়ত সম্ভব হয়নি। স্টেশনের
পাশেই নাকি রেল কর্মীদের থাকার জন্য কিছু কোয়াটার্স তৈরি আছে। এখন বোঝার
অবস্থা নেই সে সব কোয়াটার খালি পড়ে আছে কিনা। তবে স্টেশনের সুনসান পরিস্থিতি
দেখে আদৌ মনে হয় না যে সে সব কোয়াটারগুলিতে রেল কর্মীর কেউ এখন বাস করে।
শশী বাবু
বলে উঠলেন, বলতে পারব না স্টেশনের সেই কোয়াটার
এখনও আছে কিনা !
জনান্তিক
বললেন, আর সেই কুয়াটা ? যেটা ভৌতিক ঘটনার উৎস যেখানে একদিন এখানকার স্টেশন মাস্টার ও
তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল।
অর্ণব কোন
কথাই বলছেন না, ভয়ে তিনি যেন ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে
যাচ্ছেন। ওঁরা দূর থেকে
লাইটের কাছাকাছি এসে টিকিট ঘরের জালনা দেখতে পেলেন। ওটা বন্ধ। রাতে এখনে বোধ হয় কেউ থাকে না। ওরা আরও কাছে এগিয়ে গেলেন। একটা ঘরের
দরজার ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে, স্টেশন মাস্টার। দরজায় তালা নেই, মনে হল বাইরে থেকে একটু ফাঁকা
রয়ে গেছে। তবে কি
স্টেশন মাস্টার রাতে এই ঘরে থাকেন।
জনান্তিক
বললেন, চল না, ওই দরজা খোলা থাকলে আমরা গিয়ে
দেখি কেউ আছে কিনা !
অর্ণবের
জড়সড় অবস্থা, তাকে যেন ঠেলেধাক্কে নিয়ে
যাওয়া হচ্ছে। অভিযানে প্রতিবার যেটুকু ব্যাঘাত আসে সেটা তাঁর কাছ থেকেই আসে। ভয়ে
তিনি আড়ষ্ট হয়ে আছেন। অনেক সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওকে নিয়ে অনেক বার
বন্ধুরা সমস্যায় পড়েছেন। তাহলে ওই দরজা ঠেলে কে আগে ঘরের ভেতরটা দেখবে? শশীভূষণ তিন বন্ধুদের মধ্যে বেশি সাহসী। শশীভূষণ দরজার পাশে গিয়ে প্রথমে ডাক
দিলেন, কে আছেন ঘরে? কোন উত্তর
নেই। আবার তিনি ডেকে উঠলেন, কেউ কি আছেন ঘরে ?কোন সাড়াশব্দ নেই। তার মানে এখন দরজা ঠেলে দেখতে হবে সেটা খোলা না বন্ধ। দরজায় ভালো করে ধাক্কা
দিলে ধাক্কার শব্দে হয়ত ঘরের ভেতরের লোকটা জেগে উঠবে।
শশীভূষণ
ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজার এক পাট কিছুটা খুলে গেল। তাও ভেতর থেকে কোনও রকম
সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কি করবে এবার ওরা ? জনান্তিক বললেন, জোরে ধাক্কা দিয়ে দেখা যাক। শশীভূষণ
তাই করলেন—ভেজান দরজার পাটে জোরে তিনি ধাক্কা লাগালেন। দরজার পাট খুলে গিয়ে পাশের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলো। তাতে বেশ জোরে একটা শব্দ হল, ওরা নিজেরাই সে শব্দে চমকে
উঠলেন।অর্ণব ভয় পেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, দুই বন্ধু তাকে ধরে দাঁড় করালেন। ঘরের ভেতর থেকে এখনও কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ আছে
বলে মনে হচ্ছে না।
শশীভূষণ
বললেন, চল আমরা ঘরের ভেতরে যাই--অর্ণব তাঁর দুই বন্ধুকে জোরে আঁকড়ে ধরে আছেন। ভয় পেয়ে তিনি বলে উঠলেন, না না ভেতরে গিয়ে হবে কি ?
অর্ণবকে
শান্ত করিয়ে এবার টর্চের আলো জ্বেলে খুব সন্তর্পণে বন্ধুরা ঘরের ভেতর এগিয়ে যেতে
লাগলেন। হঠাৎ ঠং করে
একটা শব্দ হল, বন্ধুরা থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।
অর্ণবের বোধহয় জ্ঞান হারাবার অবস্থা এগিয়ে আসছে। প্রতিবারের মত ওর মুখ দিয়ে
কেমন গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল। শশী বাবু ঘরের চারদিকে টর্চ মেরে দেখলেন। ঘরের
এক দিকে একটা টেবিল ও চেয়ার পাতা রয়েছে। হতে পারে স্টেশন মাস্টার এসে দিনের বেলা
তার ডিউটি এখানে বসে করে যান। এদিকে জনান্তিকের মোবাইলটর্চের ফোকাস ঘরের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরের
একেবারে এক কোনার দিকে একটা এলমনিয়ামের সস্পেন, হাতা, খুন্তি, চামচ পড়ে আছে। এছাড়া আর
যার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল সেটা হল, একটা ইঁদুর। ওই এই হাতা খুন্তি নেড়ে গেছে হবে। আর তারই শব্দ একটু আগে ওরা পেয়েছিলেন। ঘর দেখা
হয়ে গেল। এটা রাতের
জন্য পরিত্যক্ত ঘর। মনে হয় রেল কর্মচারীরা অবসর সময়ে এখানে এসে চা বানিয়ে খেয়ে
যায়।
ঘর থেকে
ওঁরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন বাইরে। একটা সম্ভাবনা ওঁদের মনে নাড়া দিচ্ছিল বটে। এমনও হতে পারে বহুদিন আগের এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ও তাঁরস্ত্রী এই ঘরেই বাস করতেন। আর হবে
এখানেই তারা খুন হয়েছিলেন। এরপর বন্ধুরা ক’পা এগিয়ে যেতেই তাঁদের থেকে
সামান্য দূরে মনে হল একটা কুয়ো রয়েছে। অর্ণব এবার ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, এটাই বুঝি সেই কুয়ো হবে যেটা থেকে স্টেশন মাস্টার ও তার স্ত্রীর শবদেহ
পাওয়া গিয়েছিল। অর্ণবের কথার মধ্যে ভয়ের একটা কাঁপন ধরা পড়ছিল। তিন বন্ধু
এবার কুয়োর দিকে এগিয়ে গেলেন। বাঁধানো একটা কুয়ো তার মুখের কাছ অবধি পৌঁছবার
আগেই তাঁরা ঝপাং একটা শব্দ শুনতে পেলেন। আবার অর্ণব কেঁপে উঠলেন। তাঁর মুখ থেকে
কাঁপা শব্দ বেরিয়ে এলো। ওরা সন্তর্পণে এগিয়ে গেলেন কুয়োর পারে। জনান্তিক ও শশীভূষণ কুয়োর ভেতর উঁকি মেরে দেখলেন। অন্ধকার, ঘন অন্ধকার ছেয়ে আছে। খালি চোখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। শশীভূষণ ও জনান্তিক প্রায় একসঙ্গে দুজনের মোবাইল টর্চের আলো ফেললেন কুয়োর
ভেতর। না কুয়োর
তলদেশ পর্যন্ত টর্চের ফোকাস পোঁছাচ্ছে না, কুয়াতে আদৌ জল আছে কিনা তাও বোঝার উপায় নেই। কুয়োর অনেকটা গভীরে জল থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে। হয়ত এ কুয়োর আর
ব্যবহার হয় না। এদিকে আবার কুয়োর মধ্যে শব্দ হল, কিছু একটা জলে লাফ দিল বলে মনে হল। কিসের শব্দ হতে পারে এটা ? শশিভূষণের মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো। জনান্তিক বললেন, হতে পারে কুয়োর মধ্যে ব্যাং কিংবা সাপ আছে।
এই কুয়ো
কিংবা ঘর এসব নিয়ে কি ব্যাখ্যা ওঁরা দাঁড় করাতে পারবেন ? বর্তমান সময়ে একটি মানুষও তো এখানে নেই যে ওঁদের বলে দিতে পারবে ওই ঘরেই
থাকতেন সেই স্টেশন মাস্টার ও তাঁর স্ত্রী যাকে হত্যা করা হয়েছিল ? আর ওই কুয়োই কি সেই কুয়ো যা থেকে
স্টেশন মাস্টার ও তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল?
এবার
ওঁদের ফিরে যাবার পালা। এই জায়গা যাচাই করে কি দেখতে পেলেন ওঁরা ? কিছু অলৌকিকতার উপস্থিতির
সম্ভাবনাকে একেবারে নাকচ করে দিতে না পারলেও ওঁদের মনে হল আজকের এই যাত্রা নিষ্ফল
হয়েছে বলতে হবে। তাই ওঁদের মন ভারাক্রান্ত। ওঁরা এখন দ্রুত পা চালিয়ে পার হয়ে যাচ্ছেন বেগুনকোদর
স্টেশনের দীর্ঘ প্লাটফর্ম। যেতে যেতে জনান্তিক হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলেন, বললেন, ওই দেখ, দেখ, দূরে কতগুলো আলো কেমন নাচানাচি করছে না! বন্ধুরা সে দিকে তাকালেন। অর্ণব, ওরে বাবা, বলে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখছেন, আলোর খেলা। শশী বাবুর
মনে হচ্ছে সত্যি তো আলোর এমনি ভেলকি একেবারে স্বাভাবিক বলে তো মনে হচ্ছে না। ওঁরা
তিন বন্ধু এবার আলোর উৎস সন্ধানে এগিয়ে যেতে লাগলেন। অর্ণবকে যেন জোর করেই তাঁরা ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন।
স্টেশনের শেষ প্রান্তে বেশকিছু ঝোপঝাড় জঙ্গল, তারই মাঝে বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। আলো থেকে অন্ধকারই এখানে বেশি। জোনাকির
জ্বলা-নেভা আলোগুলো এখন স্পষ্ট ওদের চোখের সামনে ধরা পড়ছে। তাদের ধারে কাছের
আলোগুলো জোনাকির এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু
দূরে আরও দূরে যে আলো জ্বলছে নিবছে সে গুলোকে এখন অদ্ভুত রহস্যময় কিছু বলেই মনে
হচ্ছে। তবে এর
ব্যাখ্যা প্যারানরমাল কিছু বলে পোক্ত ভাবে দেওয়া যাবে না। হতে পারে
জোনাকির জ্বলা-নেভা আলোগুলো ঝোপঝাড় গাছপালার আবডাল ফাঁকফোকর গলিয়ে আলাদা আলাদা প্রকাশে
তাঁদের চোখে নানা রঙ হয়ে ধরা পড়ছে!
ফিরে
আসছিলেন ওঁরা। এখানে
আসার উদ্দেশ্য ছটাক খানেক পূরণ হয়ত হয়েছে। কিন্তু মনের সন্তুষ্টি আসেনি। ফিরে আসতে আসতে স্তব্ধতার মাঝে নিজেদের পায়ের
শব্দ, আশপাশের বাতাসের শব্দের সঙ্গে মিশে কোন অলৌকিক শব্দের সৃষ্টি করছিল। অর্ণব তাতেই বারবার আঁতকে
উঠছিলেন। ওঁর কাছে
শব্দ, আলো, দূরের গাছপালা জঙ্গল থেকে উঠে আসা আওয়াজ--এসব কিছুই অলৌকিক বলে মনে হচ্ছিল।
বেগুনকোদর
স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বন্ধুরা নিচের রাস্তায় হেঁটে চলেছেন। কিছু একটা
মনে হতে, ওঁরা হঠাৎ শেষবারের মত নিঝুম স্তব্ধ স্টেশনটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আচমকা
ওঁদের সামনে ভেসে উঠলো বেশ কিছু কালো কালো ছায়া, ওরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম জুড়ে যেন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্ধুরা
আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছায়ার দৃশ্য দেখে যাচ্ছেন। তার মধ্যেই হঠাৎ সবকিছু
অন্ধকার হয়ে গেল, নেই, আর কিছু নেই, শুধু অন্ধকার নিস্তব্ধ নিরালায়
যেন স্টেশনটা মাঝরাতের গভীর ঘুমে নিমগ্ন হয়ে আছে।