গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯

পার্থ রায়

মুক্ত পুরুষ


ওকে ঘিরে পুরনো অফিসের সহকর্মীদের প্রাথমিক উচ্ছাস, আহ্লাদ, চা-সিগারেট পর্ব কিছুটা প্রশমিত হতে অবিন এক ফাঁকে স্টেশন ইনচার্জ সুনীলকে জিজ্ঞাসা করল, “আমি যে ঘরটাতে থাকতাম, সেখানে এখন কে থাকে?”
প্রায় ফাঁকা
অবিন একটু হেসে বলল, “সেটা আবার কি রকম?”
ট্রাফিকের এক সাব-ইন্সপেক্টর থাকত। মাস দুই প্রোমোশন পেয়ে কোলকাতায় আই. বি তে চলে গেছে। কেন রে? একটু ফ্রেশ হবি?”
একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “হু। মন্দ হত না
সুনীল বলল, “আরে বস, এত হেজিটেশন কিসের? চাবি তো আমার কাছে। পারলে একটু স্নান করে নে, ভাল লাগবে। আমরা কাজটা এগিয়ে রাখছি। তুই পরে দেখে দিস।চাবিটা দিয়ে আরও একটু কাছে এসে চোখ ছোট ছোট করে বলল, “চিল্ড বিয়ার এনে রেখেছি। নিরামিষাশীদের তো হার্ড চলে না
দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে ধীর পায়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিল অবিন। কি অদ্ভুত! কাকতালীয় ভাবে পাঁচ বছর আগে এইদিনে এই ঘরেই সহকর্মীরা ওকে ফেয়ারওয়েল দিয়েছিল। তিন পেগ হুইস্কি গলধঃকরণ করার পরে সুরাপানে আনাড়ি অবিন গোধূলিকে মেসেজ করেছিল, “আজ মন খারাপ। খুব খারাপ। মদ খাচ্ছিউত্তর আসে নি।
খুব বেশি দিন এখানে পোস্টিং ছিল না অবিন, এক বছর কয়েক দিন। ডিউটি আওয়ারস আর সপ্তাহান্তে কোলকাতার বাড়ি যাওয়ার দিনগুলো বাদ দিলে দশ বাই বারোর এই ব্যাচেলর্স কোয়ার্টার অবিনের একান্ত নিজস্ব পৃথিবী। যে পৃথিবীতে সিগারেটের রিং গড়তে গড়তে নিজের ইচ্ছে মত লাল নীল সবুজ হলুদ রঙা অচিন দেশে পাড়ি দেওয়া যায়। কখনও শৈশবের গন্ধ মাখা ফড়িং, কখনও স্কুল বেলার সহপাঠীদের মুখ, ভূগোল স্যারের রক্তলাল চোখ, কখনও এসে পড়ে পাঁঠার মাংসের লোভে বাবার হাত ধরে এক কিশোরের রবিবারের বাজার পরিক্রমা। আর ছিলে তুমি গোধূলি।
একটা সিগারেট ধরিয়ে অবিন বাথরুমের পাশের জানালাটা খুলে দিল। ওয়্যারলেস টাওয়ারের উল্টোদিকে কনস্টেবল ব্যারাক থেকে রেডিও এফএমে রবীন্দ্র সঙ্গীত গান ভেসে আসছে, “যে তোরে পাগল বলে, তারে তুই বলিস নে কিছু
উমমম, অবিন তোমার গায়ে সিগারেটের গন্ধ। আমার প্রিয় পুরুষালি গন্ধঅবিনের বুকের কাছে ঘন হয়ে এসে গোধূলি বলত।  
টানবে একটু?”
যাহ! পাগল। একদম পাগল
তাহলে অন্য উপায় আছে। আমার ঠোঁট থেকে প্রিয় গন্ধটা যথেচ্ছ ভাবে নিতে পারো
বুকের ওপর চুড়ির রিনিরিনি শব্দে ফর্সা গোলগাল হাতের কিলের সাথে শুনেছিল, “পাজি, অসভ্য একটা
অবিনের কিছু প্রিয় নামের মধ্য একটা। গোধূলি নামটা ওর দেওয়া।
দরজা খুলে লম্বা বারান্দায় এলো। ওই তো সন্ধ্যামালতি গাছটা। সাদা রঙের ফুলে গাছ ভরে আছে। পাশেই কাঠ বাদামের গাছটাও আছে। কিছুটা তফাতে কাঠ গোলাপ ফুলের গাছ। তার পাশে উঁচু দেয়াল। এক দুপুরে ওই দেয়াল ঘেঁষেই তো আদরে উন্মত্ত দুটো ইয়া বড় সাপ। শরীরের ভেতরে কেমন একটা তাপ অনুভব করেছিল অবিন।
সরে শোও, অসভ্যতা করবে না
তোমার বুকের গন্ধ নেব
নো, এই মাত্র কিচেন গুছিয়ে তোমার কাছে এসেছি। ঘামের গন্ধ
হোক। তোমার ঘামের গন্ধটাও আমার প্রিয়। তা হঠাৎ একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করার হেতু কি? জানালে বাধিত হবো
কেন পাশে শুলেই কি সব সময় ওসব করতে হবে? পাশাপাশি শুয়ে গল্প করা যায় না?”
গল্পের দরকার নেই। আমার আজকে নাইট ডিউটি আছে। ঘুমাতে দাও
ওলে বাবালে, বাবুর বুঝি গোসা হল। ঠিক আছে জড়িয়ে ধরে শুতে পারো। এর বেশি আর এক আনাও বেশি কিছু নয়
এই ঘরে নিরিবিলি দুপুরে অথবা রাত নিশীথে দুজন খোলস ছাড়া মানব মানবীর উন্মত্ততা কি ওই সাপ দুটোর থেকে কম ছিল?
অজস্র প্রলাপ, আলাপ, ফিস ফিস কথা, ছেলেমানুষি, অভিমান আর পাগলামির জালে আটকে আছে অবিন। কেমন যেন এক হাহাকারের অনুরণন খালি ঘরে চার পাশ থেকে ওকে ঘিরে ধরছে। চন্দন গন্ধে এসে মিশছে এক বিষাদময় শূন্যতা।
ঘরের এক কোনে আয়নাটা মলিন ধুলোর হাল্কা আস্তরণ নিয়ে দেয়ালের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবিন নিয়মিত ওটাকে মুছে ঝকঝকে রাখত। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে শেভ করত, ক্যাপের অশোক স্তম্ভ বাম চোখের ঠিক ওপরে আছে কিনা দেখে নিত।
পায়ে পায়ে আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাত দিয়ে পরম মমতায় কিছু অংশের ধুলো মুছে দিতে এক পুরুষের মুখ। কে ও? এ কোন অবিন? এক অধিকার চাওয়া অধৈর্য অবুঝ অবিন যে তার প্রেমিকাকে এতটুকু স্পেস দিতে নারাজ। ওর ভেতরে প্রেমিক স্বত্বার সাথে সহবাস করেছে এ কোন পুরুষ? বিশ্বাস হারানো এ কোন অবিন? নিজের চেহারা নিজের কাছে অসহ্য লাগল।
নগ্ন অবিন এক মুক্ত পুরুষের মত শাওয়ারের ধারার নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। দুচোখ উপচে আসা ধারা, শরীর বেয়ে নামা ধারার সাথে মিশে গিয়ে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছিল সব মলিনতা, সব কলুষিতা। হৃদয় সমুদ্রের গভীরে ডুবে যেতে যেতে অনেক নিচে দেখতে পেল তিনটে অপরূপ পদ্মের মত ফুটে আছে তিনটে নাম গোধূলি, সাঁঝবাতি আর মল্লার।
***
এখানে কাজ শেষ। কোলকাতায় ফেরার পথে গাড়ির জানালায় বসা অবিনের মনে হল এক সময় ও যখন বাড়ি ফিরত ওর মনে হত ও প্রিয়জনদের কাছে ফিরছে ঠিকই কিন্তু আরও তিনজন প্রিয়মুখ যেন বিষাদগ্রস্ত হয়ে বলছে, “তাড়াতাড়ি ফিরে এসো তুমিভোরের নরম আলো আর স্নিগ্ধ বাতাসের মুখে আজ সেই মন খারাপি বার্তা অনুপস্থিত। ওরা জানে না অবিন নিজের মধ্যেই সেই অরূপরতনের খোঁজ পেয়েছে। শেষ নিঃশ্বাসটা ছাড়ার আগে পর্যন্ত সযত্নে বয়ে যাবে। বুকের বাদিকে আলতো করে ছুঁয়ে অস্ফুটে বলল অবিন, “ভাল থেকো গোধূলি। ভাল থাকিস সাঁঝ, মল্লার। এই তো আমি আছি সব সময়