গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯

সুধাংশু চক্রবর্তী

আলোর বলয়


সেদিন অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল সুদীপের। সাধারণত রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যায়। আজ অফিসে প্রচুর কাজের চাপ ছিলো। তাই একটু বেশী রাত হয়ে গেল। কখন এগারোটা বেজে গিয়েছে টের পায়নি। শীতের রাতে এগারোটা মানে গভীর রাত। আশেপাশের বাড়িগুলোয় সবাই জানলা দরজা দিয়ে সুখের নিদ্রা যাচ্ছে। সুদীপের সঙ্গী বলতে এখন কয়েকটা নেড়ি কুকুর। প্রতিদিন যাতায়াতের সূত্রে সুদীপ ওদের পরিচিত। ওরাই লেজ নেড়ে সুদীপকে অভ্যর্থনা জানালো। দূরে কোথাও একটা কুকুর চিৎকার করে ডেকে উঠলো। সুদীপ ভয় না পেলেও চমকে গেল। সহসা শহর জুড়ে লোডশেডিং হয়ে গেল। ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে গেল চতুর্দিক। সুদীপ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করতে যাচ্ছে যখন কেউ একজন তখনই ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরলো! 
কে!

কোনো জবাব নেই। সুদীপ অন্ধকার সয়ে আসা চোখে তারার আলোয় দেখে ছায়াছায়া একটা মূর্তি। জ্বলজ্বলে চোখ দুটোয় অদ্ভুৎ একটা আকর্ষণ আছে! তারজোরেই চোখদুটো ওকে প্রবলভবাবে টানছে! যেন কিছু বলতে চাইছে ওকে! সহচর কুকুরগুলো কেঁউ কেঁউ রব তুলে নিমেষেই ছুটে পালালো অন্ধকার ছিঁড়েখুঁড়ে। ব্যাপারটা আচমকা ঘটে যাওয়ায় সুদীপ হতভম্ব হয়ে যায়। সহসা অনুভব করে প্রচণ্ড একটা ভয় ওকে কষে চেপে ধরতে চাইছে। ও আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেকে সংযত করে নিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে অন্ধকারে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো, ‘কে? কে তুমি?’

এবারও কোনো জবাব নেই। জবাবের অপেক্ষায় থাকতে হলো না ওকে। তার আগেই অদ্ভুৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেল। ছায়াছায়া মূর্তিটা ছোট্ট একটা আলোর বলয় হয়ে ঝপ্‌ করে ঢুকে গেল ওর বুকের ভিতর। পরমুহূর্তে প্রবল ঝাঁকুনিতে ওর গোটা শরীর কেঁপে উঠলো ঝন্‌ঝন্‌ করে। এরপরই অদ্ভুৎ এক নিস্তব্ধ পরিবেশে ডুবে গেল সমস্ত চরাচর। ধাতস্ত হতে হতে সুদীপ শোনে, কে যেন ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘ভয় পাস না দীপ। আমি আছি না তোর সঙ্গে? যতক্ষণ সাথে আছি কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তোর।

দীপশুনে আবার চমকে যায় ও। কে! চমকে যাবারই কথা। আজ অনেককাল বাদে কেউ একজন এই নামে আবার ওকে ডাকলো। যিনি একসময় আদর করে এই নামে ওকে ডাকতেন, তিনি যে বছর পাঁচেক আগেই......বাবা! ক্ষতি করবে কেউ বলছেন! কিন্তু কেন? কোন ক্ষতির কথা বলছেন বাবা! ওর তো তেমন কোনো শত্রু নেই! তাহলে কে ওর ক্ষতি করতে চাইবে!

সহসা বুকের ভিতর ঢুকে পড়া আলোর বলয়টা অসম্ভব ছটফট করতে শুরু করলো সমস্ত শরীর জুড়ে। পরক্ষণেই গোটা শরীরে অদ্ভুৎ একটা শক্তি ছড়িয়ে পরতে থাকলো একটু একটু করে। যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে একটু একটু করে। তাই বুঝি এতক্ষণ যে-ভয় ওর গলা চেপে ধরেছিলো সেই ভয়টাও ধীরেধীরে উবে গেল কর্পুরের মতো। মনের ভয়টুকু নির্মূল হয়ে যাবার পরই সুদীপের মনে হলো, এই পৃথিবীতে যেন ভয় পাবার মত কিছুই আর নেই! কে যেন ভয়ের জগত থেকে অনেক দূরে কোনো এক নির্ভয় জগতে নিয়ে গিয়েছে ওকে। এখন চাইলে মত্ত হাতিকেও আদর করতে পারে গলা ধরে। বাঘের মুখেও অবলীলায় হাত ঢুকিয়ে দিতে পারে ও। খপ্‌ করে মুঠোবন্দী করতে পারে বিষধর সাপের উদ্যত ফণা। 

এসব ভাবনায় ডুবে ছিলো বলে একটা ব্যাপার খেয়াল করেনি সুদীপ। ওর অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ নিঃশব্দে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। সুদীপ জানতেও পারছে না ওরা চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলতে চলেছে ওকে। আচমকা এক জোড়া হাত ওকে চেপে ধরলো পিছন থেকে। তাতেই ভাবনা থেমকে বাস্তবে ফিরে এসে সুদীপ দেখে একদল ষণ্ডামার্কা মানুষ ঘিরে ধরেছে ওকে। প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই আরও দুজন এসে এমন করে চেপে ধরলো ও যাতে এক তিলও নড়তে না পারে। কথাটা তখনই মনে এলো ওর। 

দিন ধরেই শুনছে শহরময় কিছু অমানুষের দৌড়াত্বের কথা। পুলিস আজও ধরতে পারেনি ওদের একজনকেও। লোক মুখে শুনেছে ষণ্ডামার্কা লোকগুলো নাকি মাঝরাত্রে কাউকে একলা পেলেই আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সর্বস্ব লুটপাট করে পালিয়ে যায়। প্রতিবাদ করতে গেলে ওরা নাকি জানেও খতম করে দিতে পিছপা হয় না!  

এই তো, দিন পনেরো আগে শুনেছিলো তেমনই এক ঘটনা। একটা মাঝবয়সী মানুষকে ওরা খুন করে পালিয়েছে সর্বস্ব লুঠ করে। মানুষটা ওদেরই পাড়ায় থাকতেন। পাড়ারই মোড়ে একটা কাপড়ের দোকান চালাতেন। তখন বিয়ের ধুম পড়েছিলো শহরে। সেকারণে অই মানুষটার কাপড়ের দোকানে ভিড় লেগে থাকতো অনেক রাত পর্যন্ত। সেদিন দোকান বন্ধ করতে করতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিলো।

মানুষটা দোকান বন্ধ করে বিক্রিবাট্টার টাকাকয়টা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন দোকানেরই একজন কর্মচারিকে সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গে বেশ কিছু টাকা থাকায় কর্মচারিটিকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। দুজনে হেঁটেই ফিরছিলেন । ষণ্ডামার্কা লোকগুলো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এসে আচমকা ঝাঁপিয়ে পরেছিলো তাদের ওপর। দুচার ঘা খেতেই কর্মচারিটি পালিয়ে বেঁচেছিলো দোকানী মানুষটাকে একলা ফেলে রেখে। দোকানী মানুষটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলো টাকাপয়সা বাঁচানোর জন্য। টাকাগুলো কিছুতেই তুলে দিতে চাননি ছিনতাইবাজদের হাতে। ওই জেদাজেদির ফলেই মানুষটাকে অকালে প্রাণ হারাতে হলো গুণ্ডাগুলোর হাতে। পরদিন সকালে পুলিস এসে লাশ তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। খানাতল্লাশিও করেছিলো।কিন্তু সবই বিফলে গিয়েছে। গুণ্ডাগুলোর টিকিও ছুঁতে পারেনি পুলিস।

সুদীপ ভয়ে কুঁকড়ে যেতে যেতেই অনুভব করলো কে যেন ওকে ভিতর থেকে দ্রুত উত্তেজিত করে তুলছে। পরক্ষণেই কে যেন ওকে মারমুখি হয়ে ছিনতাইবাজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহায্য করলো, ‘আয় জানোয়ারের দল। আজ দেখবো তোদের কত ক্ষমতা।

কথাগুলো বলেই সুদীপ এলোপাথাড়ি লাথিঘুসি চালাতে থাকলো গুণ্ডাগুলোর শরীর লক্ষ্য করে। ওর হাতে মার খেয়ে গুণ্ডাগুলো পালিয়ে বাঁচলো। ওরা পালিয়ে যাবার পর বাবার গলা আবার বেজে উঠলো সুদীপের কানের পাশে, ‘আর ভয় নেই। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়িতে যা দীপ। তোর মা এবং বৌমা যে এক বুক উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছেন তোর ফেরার পথ চেয়ে।

সুদীপ প্রশ্ন করলো, ‘আমি যে বিপদে পড়বো তুমি সেকথা জানলে কীকরে বাবা?’
তোর মা যে আমাকে ডেকে সবসময় বলেন, ‘ওকে চোখে চোখে রেখো তুমিতোর মায়ের কথা ফেলতে পারি না যে
তারমানে তুমি আজও মাকে এতটা ভালোবাসো!   

সুদীপ দেখলো জবাব পাবার আগেই আলোর বলয়টা ওর শরীর থেকে বেরিয়ে এসেই দ্রুত মিলিয়ে গেল রাতের আকাশের তারাদের ভিড়ে। সুদীপ দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে। তারায় তারায় গিজগিজ করছে স্বচ্ছ আকাশ। ওদের মধ্যে বাবাকে খুঁজে পাবার ব্যর্থ চেষ্টা চালালেও একসময় ব্যর্থ হয়ে দ্রুত পা চালালো বাড়ির দিকে। রাত ততক্ষণে আরও গভীর হয়েছে।  বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখে ওর ফেরার আশায় মা দাঁড়িয়ে আছেন জানালায় মুখ রেখে।

ঘরে ঢুকেই চমকে গেল মায়ের কথায় । তোর বাবার ওপর আমার প্রচুর ভরসা। তবুও না বাড়ি ফেরা ইস্তক মন যে মনতে চায় না দীপ।সুদীপ দেখে মায়ের মুখের সামনে বার বার জ্বলে উঠছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  দুটো আলোর বলয়! জোনাকি কিনা বুঝতে পারছে না।