গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

তন্ময় বসু


চাকদে


নীল পুজো বলে কথা! আজন্ম দেখে এসেছে পর্ণা, আচারে কোথাও এককণা ত্রুটি হওযা চলবে না। গ্রামের বাড়িতে সে এক হৈ হৈ ব্যাপার ছিল, সবটাই অন্দর-মহলে মেয়েদের মাঝে। ঝাঁট-পাট, ধোওয়া-ধুয়ি যোগাড়ের, আচার বিচারের শেষ ছিল না। মা কে দেখত হতদ্যম হয়ে পড়তো, তবু ঠাকুমার মনঃপূত হত না। তার নিজের সংসারেও যতটা পারে, আরও যেন বেশী যত্নশীল হতে চায়, তাই বছর বছর, বয়সের সঙ্গে এটা ওটা করে বেড়েই চলেছে। নির্জলা উপোষ, আলাদা রান্না-বান্না। সংসারের ভেতর আরেক সংসার, ঘরের ভেতর ঘর! কৃশানুকে দেখে প্রথম প্রথম ভাবত নেহাৎ মেয়েলি ব্যাপার বলে এড়িয়ে থাকে, পরে দেখেছে এব্যাপারে সেও অনেক খবরাখবর রাখে। হবে নাই বা কেন, আফটার অল - তো গাঁয়ের ছেলে। একবার যেমন বলেছিল "জান পর্ণা, এই ভুখন্ড, যাকে এখন বাংলা বলি, পুরো না হলেও, অন্ততঃরাঢ় অঞ্চলের সময়ের ধারা এইসব প্রায় লুপ্ত সংস্কৃতির মধ্যে,নিহিত আছে। প্রকৃতি বনাম পুরুষ, লোকায়ত আচারের সঙ্গে বৈদিক সংস্কৃতি, প্রাক দ্রাবিড় অস্ট্রাল বনাম দ্রাবিড় সভ্যতার টানাপোড়েন, তন্ত্র-সাধনা বনাম ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সবাই বেঁচে আছে।" মাঝে মাঝে পর্ণা অবাক হয়ে ভাবে এসব কথা। তাদের গাঁয়ে কোনদিন শিবরাত্রি নিয়ে এত উদ্দীপনা দেখে নি। আজকাল শিবরাত্রিতে মেয়েদের যে এত ঢল নামে রাস্তা-ঘাটে, তার কোন কিছুই তাদের দেশে ছিল না। শিবের পুজো মানে গাজন আর মেয়েদের নীলপুজো। কৃশানুর কাছে শোনা 'গাজন' শব্দটা নাকি গর্জন থেকে এসেছে, শিবসৈনিক, ভক্তদের গর্জন। মানে এখন যারা মিলেমিশে 'হিন্দু'তে একাকার তারা এককালে এতটাই লড়াই ঝগড়া করত যে আজও গাজন উৎসবে সন্যাসীরা মড়ার মাথা নিয়ে নাচে, শিবের নামে জয়ধ্বনি দেয়। সকাল থেকে এমনিতেই খুব চাপে আছে। সব কাজ সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু মুখে দিতে হবে। সুগারটা আবার একলাফে অনেকটা বেড়েছে। থাইরয়েড কোলেস্টেরল তো আছেই। বেড়নোর আগে কৃশানু পই পই করে বলে গেছে 'যাই কর শরীরটার কথা মাথায় রেখ।" সব কাজ গুছিয়ে তবে শিব মন্দিরে যাবে, তেমন দুরে নয়, হেঁটেই যাবে ঠিক করেছে। গত বছর দুই এই মন্দিরটাতেই যায়। দেড়টায় খেতে আসবে কৃশানু, তার সব রেডী করতে হবে। বলেছিল ক্যন্টিনে খেয়ে নেবে, পর্ণা জোর করে বলেছে বাড়িতে খেতে, কোন অসুবিধা হবে না। এত সবের মাঝে সকাল সকাল হতচ্ছাড়ীটা বলে কি না "বৌদি, কাল কিন্তু আসব না।" একটু রাগ হলেই কাজের মেয়েটাকে পর্ণা ওই নামে ডাকে। নাম মনসা, কিন্তু বিষও নেই চক্রও নেই। পর্ণার ওকে খুব ভাল লাগে। পরিছন্ন কাজকর্ম, দুটো কথা শোনালেও, মুখে রা নেই। দোষ একটাই - যখন তখন না বলে কামাই। অপেক্ষা করে করে পর্ণা তখন অথৈ জলে। পরের দিন এলেই মুখে যা আসে তাই বলে দেয়, চেঁচামেচি। মনসা চুপচাপ কাজ সেরে, খেয়ে দেয়ে হাওয়া। ব্যস, ওই দিনটাই, তারপরে আবার যাকে তাই। " কেন রে কাল আবার কি হল? রোজ রোজ তোর গল্প আমি শুনতে পারব না। মাসে দু-দিন হয়ে গেছে, আবার! আমি মাইনে কাটব এবার। তারপর দেখি, কদিন কামাই করে বাড়িতে থাকতে পারিস।" দুজনেই জানে কেবল কথার কথা। "না গো বৌদি, তুমি জান না! কাল বছরের শেষদিন, সংক্রান্তি। কাল আমাদর পরব।" "চড়ক তো বিকেলে, সকালে কাজ করতে কি অসুবিধা তোর?" বিরক্তিতে ঝাঁঝিয়ে উঠলো পর্ণা, "একটা কিছু পেলেই হল, অমনি বলে না বলে ডুব। এভাবে কত দিন চলতে পারে!" "দুর, চড়ক নয়, আমাদের অন্য পরব আছে না, চাকদে। তুমি শোন নি আগে?" "কি? কি? চাকদে! সেটা কি পরব?" পর্ণা জিজ্ঞেস করতেই মনসা বলে "কেউ মরে গেলে আমাদের এই পরবের দিনে তার জন্য আমরা রান্না করে রাখি। সে এসে খেয়ে যায়।" পর্ণার মাথায় ঝিলিক খেলে "ওঃ! সেই তোরা মদ দিস যে পরবে?" মনসা এবার বোঝানোর ভঙ্গীতে বলে "হ্যঁ হ্যঁ, যে মদ খেত তার জন্যে মদ রাখা হয়। পাঁচ রকম তরকারি বানিয়ে, আমের ডাল, পাট শাক, মাছ, সব দেওয়া হয়। যে বিড়ি খেত তার জন্যে বিড়িও রাখা থাকে। জান বৌদি, ওরা কিন্তু খেতে আসে।" পর্ণা স্বাভাবিক বিশ্বাসে জিজ্ঞেস করে কি করে বুঝিস তোরা। "আমরা বাউরীরা ছোট থেকেই জানি, কাল সবাই খেতে আসবে। সেই জন্যেই তো এত যোগাড় করতে হবে, কি করে আসব বল?" পর্ণা খুব ভালো লাগে, মনটাও একটু ভারী হয়ে আসে। হারানো প্রিয়জন যদি এভাবে বছরে একদিন হলেও আসে! কত যত্ন করে সেও খাওয়াতো।