গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

মিলি মজুমদার


মিউটেড রিটর্ট


মিষ্টার গোখলে আপনি মহিমাকে এভাবে ফেডারেশন  ভলিবল টুর্নামেন্ট থেকে বাদ দিতে পারেন না। এ অন্যায়।এভাবে একটা আনফিট কেসে ফেলবেন না প্লিজ। দেখবেন একটা সময় ও দেশের মুখ উজ্জল করবে।জেলা স্তরের খেলায় মহিমাকে দেখে আপনিই চরম উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলেন আগে অথচ আজ! খুব বিনয়ের সাথে এই কথা কটা বলেছিলেন মহিমার কোচ।  

মহিমার মনে চরম আঘাত আনে এই ঘটনায়।অনেক চরাই উৎরাই পার হতে হয়েছে অমৃতার ও মহিমার----
 তখন বাচ্চা হতে বাপের বাড়িতেই এসেছিল অমৃতা।কোল আলো করে এলো মহিমা অমৃতার বুকে।ফুটফুটে মুখ দেখে সুদর্শন বোস সাথে সাথেই মেয়ের নাম রাখল মহিমা।ছোট্ট  হাতের মুঠোয় নিজের তর্জনী ভরার হালকা চেষ্টা করতেই ডাক্তার বললেন,
মিস্টার বোস আপনি একটু আমার সঙ্গে আসুন প্লিজ বলে ডেকে নিয়ে গেলেন চেম্বারে।ডাক্তার অনিকেত গুপ্ত বললেন কি করে শুরু করব আমি নিজেই বুঝতে পারছি না মিস্টার বোস। আমি ডাক্তার আমার কাছে সব থেকে বড় কাজ হোলো বাচ্চকে সুষ্ঠুভাবে  ডেলিভারি করিয়ে পৃথিবীর আলো দেখানো।ডাক্তারের কাছে লিঙ্গ বৈসম্য কোনো ফাক্টর না।ভীষণ ভাবে চমকে উঠল সুদর্শন,কি বলতে চাইছেন ডাক্তার বাবু! সব শুনে চেম্বার থেকে ছিটকে বেরিয়ে  এল সুদর্শন, নার্সিংহোম থেকে বের হয়ে সোজা রওনা দিল মুম্বাইয়ে নিজের বাড়িতে।  বাথরুমের  শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে সাপের মতো কুন্ডলী পাকাতে থাকে সুদর্শনের শরীরটা।ভেতর থেকে হিস হিস করে ওঠে সাপের মতো সুদর্শনের জিভটা।এ আমার মেয়ে কিছুতেই হতে পারে না। ঐ একবারই দেখেছিল মহিমাকে সুদর্শন।যে কোনো একজন কে বাছতে হবে স্বামী ও সন্তানের মধ্যে এই ছিল সুদর্শনের প্রথম ও শেষ কথা।  এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড়ায় অমৃতা,শুরু করে মেয়ে নিয়ে জীবন যুদ্ধের লড়াই---
 মা বাবা আর দাদার সংসারে সে বোঝা হতে চায় না তাই মহিমার এগারো মাস বয়স হতেই মেয়ে নিয়ে  বাবার কাছে থেকে চলে আসে কোলকাতায়। কোলকাতায় বন্ধু তিস্তার সহযোগীতায় প্রাইভেট  কোম্পানিতে জয়েন করে অমৃতা। বিয়ের আগে জামসেদপুরে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি  করতো অমৃতা ,বিয়ের পর মুম্বাই চলে এসেছিল সুদর্শনের সাথে।

 নাহ... সে সুদর্শনের  কাছে কোনো রকম দাবি করেনি ,যে মানুষ সন্তান কে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়, স্ত্রী সন্তান কে ফেলে ভীরু কাপুরুষের মতো চলে যায় তার কাছে অধিকারের দাবি কখন ও  করবে না শিক্ষিতা অমৃতা।শুধু একবার গেছিল সুদর্শনের কাছে নিজের সমস্ত দরকারি কাগজপত্র আনতে আর নিজের সই করা সম্পর্কের ছাড়পত্র দিতে।আর পেছন ফিরে তাকায় নি অমৃতা। সামনে তখন কঠিন পদক্ষেপ।মহিমাকে পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করে দেয়।এডমিশনের ফর্ম ফিলাপ দেখে প্রথমে প্রিন্সিপাল বেঁকে  বসেছিলেন।অমৃতার প্রাণের বন্ধু তিস্তা এখানকার মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট এছাড়া বেশ কটা এনজিওর সাথে যুক্ত থাকায় মহিমার জীবনে পদে পদে  যতো সমস্যা এসেছে সবটা তিস্তাই সামলে দিয়েছে অমৃতার পাশে থেকে---

--দিনদিন মহিমা বয়সের তুলনায় লম্বা হচ্ছে,চওড়া কাঁধ কোঁকড়া চুল।অমৃতা মহিমার পথপ্রদর্শক। প্রতি মুহুর্তে মহিমাকে বুঝিয়েছে জীবনটা অভিশাপ মনে না করে এগিয়ে চলতে হবে, ধৈর্য্য হোলো সাফল্যের সোপান ,পদে পদে সংগ্রাম করতে হবে তবেই নিজের জায়গা করে নিতে পারবে। জন্মের শুরুতে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা ,এই ব্যর্থতার শেষ থেকেই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মহিমাও মায়ের শিক্ষা ও ভাবনার ঘেরাটোপে থেকে নিজের শিরদাঁড়া নোয়াতে শেখেনিমহিমা পড়াশোনায় মোটামুটি কিন্তু খেলাধুলা  তে ভীষণ ঝোঁক।স্কুলের ভলিবল খেলাতে ভীষণ নজর কেড়েছে খেলাধুলার মাষ্টারের। এদিকে চাকরি সামলে  মহিমাকে সমাজে সম-মর্যাদায় বড় করে উঁচুতে তুলে ধরাই ছিল অমৃতার জীবনের একমাত্র লক্ষ।নামকরা ক্লাবে ভালো কোচের আন্ডারে থেকে খুব ভালো ভলিবল  খেলার ট্রেনিং নিতে শুরু করে মহিমা। মহিমার হাইট ,ট্রাইসেপের ব্যায়াম করা হাতের  মাসল , বল সার্ভিস সবাইকে টপকে যেতে থাকে-- 
রক্ত কে কি অস্বীকার করা যায়! কলমের খোঁচায় সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় কিন্তু জিন কে অস্বীকার করা যায় না।সুদর্শন জাতীয় দলের হয়ে অনেক ভলিবল টুর্নামেন্ট খেলেছে আর  প্রমোশন পেয়ে পেয়ে রেলের এখন উঁচু পোস্টে চাকরি করছে।  উনিশের কোঠার মহিমার চরম চ্যালেঞ্জ নিজেকে নিয়ে।এই ফেডারেশন  টুর্নামেন্টের খেলায় চান্স দেওয়া হবেনা মহিমা কে।কানপুর, মুম্বাই, কোলকাতা, এই তিনটি রাজ্যের মধ্যে এই খেলা।এই টুর্নামেন্টের জন্য প্রচুর পরিশ্রম, নিয়ম করে খাওয়া দাওয়া, প্রাকটিস,কোনো ত্রুটি রাখেনি মহিমা, রাখতে দেয়নি অমৃতাও।অথচ হটাৎ করেই  আজ মিস্টার গোখলের এমন সিদ্ধান্তে বুক কাঁপিয়ে দেয় অমৃতার।সরাসরি দেখা করেছে তিস্তা ও অমৃতা,কোনো ভনিতা না করেই প্রশ্ন রেখেছে অমৃতা। কি কারণে মহিমাকে চান্স দেওয়া হবে না এই টুর্নামেন্টে সোজাসুজি জানতে চাই।মিস্টার গোখলে একটু ইতস্ততঃ করে বলেন আসলে এটা ফেডারেশন  গেম।এখানে আমাদের সব কিছুই ক্লিয়ায় ডকুমেন্ট দিতে হয়।আপনারই তো সন্তান  আমি নতুন করে কি বলব। অমৃতা ও তিস্তা নিজেদের সংযত রেখে বলে, একটা সময় ১৯৭৩ সালে মহিলা ভলিবল বিশ্বকাপ শুরু হয় ,ভাবতে পারেন কতো বছর আগের কথা। অথচ কতো পিছিয়ে আছে আমাদের সমাজ!! লিঙ্গ প্রতিবন্ধী দের মর্যাদার সাথে চলতে দিন প্লীজ। একটা সময় কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াই লজ্জার ছিল।এখন কন্যা সন্তানরাই সমাজে বেশি মর্যাদাশালী ভলিবল খেলায়মহিমার মতো এতো ভালো বল সার্ভিস  খুব কম জন পারে এ কথা  যে দুজন লাইন জাজ আছেন এই দলে, ওনারাই বলেছেন।আপনিও জানেন।লিঙ্গ-প্রতিবন্ধি হয়ে জন্মানো কোনো পাপ না, লজ্জার ও না। তাকে মর্যাদার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই গৌরবের।তৃতীয় লিঙ্গ বর্তমান সমাজের কাছে সুষ্ঠু ও মর্যাদার সাথে গ্রহন করা উচিত  মিস্টার গোখলে।আইন'ত তাই বলে। আপনি  জেন্ডারের জায়গায় তৃতীয় লিঙ্গ  উল্লেখ করে দিন, তিস্তা এবার একটু জোর গলাতেই বলে। 
দেখতে দেখতে সময় চলে এলো মহিমার মুম্বাই যাওয়ার।উত্তর  মুম্বাইয়ের ন্যাশানাল স্টেডিয়ামে খেলা।দলের সাথে গেছে মহিমা। খুব জোড়াজুড়ি করেছিল অমৃতা ও তিস্তাকে মুম্বাই যাওয়ার জন্য।অমৃতার মন চায়নি যেতে,মুম্বাই নাম শুনলেই ভিতরে কেমন এক অসহ্য দহন অনুভূতি।ফাইনালে উঠেছে মহিমাদের দল।অমৃতা জানে এই টুর্নামেন্টে জয়ী হলে মুম্বাই এর ভলিবল ফেডারেশনের সম্পাদক সুর্দশন বোসের হাত থেকেই চাম্পিয়ন কাপ নেবে মহিমাদের দল। 
মহিমার কাছে পিতৃ পরিচয় কোনোদিন প্রকাশ করেনি অমৃতা।
আজ ডে নাইট ফাইনাল।ফাইনাল জিতেছে মহিমারা।কাপ হাতে উচ্ছাসে যখন দলের সবাই খুশির জোয়ারে ভাসছে মহিমা রিষ্টব্যান্ডের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট চিরকুট সুদর্শনের বাঁ হাতের সেই তর্জনীর ফাঁকে গুঁজে দিতে দিতে ঠিক সুদর্শনের মতোই সাপের মতো হিস হিস করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে আমি পদবি ব্যবহারে ঘৃণা বোধ করি আমি মহিমা শুধু মহিমা!

 তিস্তা মহিমার কাতর আবেদনের কাছে হার মেনে পিতৃপরিচয় জানিয়েছিল অমৃতার আড়ালে মহিমার আঠার বছরের জন্মদিনের দিন-----জীবনের  বাকি সবটাই মায়ের ডায়েরি থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানাই ছিল। 
 জীবনে এই প্রথম মহিমা মার কাছে গোপন করবে মিস্টার সুদর্শন বোস কে এই চিরকুট দেওয়ার কথা। চিরকুট টা মায়ের ডায়েরি থেকে কেটে আনা,নামহীন ,শুধুপাঁচটি শব্দ লেখা

 শিরদাঁড়া হীন প্রানীকে সরীসৃপ  বলে”----

রাতে টিভিতে খবরটা দেখার পর অমৃতা ও তিস্তা দুজনেই ব্যাকুল মহিমার জন্য।অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারে নি নেটওয়ার্ক প্রবলেমের জন্য।বহু রাত জেগে কেটেছে অমৃতার জীবনে ,আজকেও ঘুম নেই একটুও চোখে।আজকের রাতটা একদম অন্য রকম।ভীষণ  জাগতে ইচ্ছে করছে।ছাদে উঠে দেখে পাটখোলা  আকাশে চতুর্থীর চাঁদ।হালকা সাদা মেঘ চড়ে বেড়াচ্ছে সারা আকাশময়।মায়াময় চারিদিক। 
কঠিন অমৃতার আজ নিজেকে ঐ ভেসে যাওয়া মেঘের মতো হালকা লাগছে---- 

 মহিমাও নেটওয়ার্ক প্রবলেমের জন্য রাতে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি মা ও তিস্তা আন্টির সাথে।মহিমার জীবন তরীকে  উথাল পাথাল ঢেউ থেকে রক্ষা করেছে সজাগ নাবিকের মতো এই দুই নারী,কথা বলার জন্য মন উজাটন হওয়া তো স্বাভাবিক----

ওয়াশ রুমের আয়নাতে এই প্রথম নিজের মুখটা এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মহিমা, প্রতিবিম্বে যেন সুদর্শনে মুখের ছাপ!উফফ! ফেসওয়াস দিয়ে বারবার  মুখ ধুতেই থাকে ধুতেই থাকে ,না এ আমি কিছুতেই হতে দেব না,চোখ ঠিকরে বেরিয়ে  আসে আগুনের হলকা।অসহ্য লাগছে আজকে এই সুদর্শন বোসের মুখের আদল! বাথরুমের এক কোনে এসিডের বোতল! খুলতে গিয়ে চলকে পরে হাতে, বুকের জ্বালার কাছে এ  জ্বালা কিছুই না মুখে উপরে ঢেলে দেয় সব এসিড টুকু! গলে গলে পরছে সুদর্শনের মুখের আদল! কি বিভৎস ! না!না!না! ------
দুঃস্বপ্নপীড়িত গোঙানি তে ঘুম ভেঙে যায় মহিমার---
চোখ মেলে দেখে এক টুকরো রোদ এসে পরেছে হোটেলের  পর্দার ফাঁক দিয়ে গায়ের উপর যেন পরম মমতা মাখা মায়ের কুসুম রংয়ের  আঁচল।রিংটোন বেজে ওঠে মোবাইলে। মায়ের ফোন এলে শুধু এই রিংটোন টাই বাজে---আমি ভয় করব না ভয় করব না, দু বেলা মরার আগে মরব না।