গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৬ জুন, ২০১৮

দেবাশিস কোনার


নকল বাদশা

আমি আমার যত গৌরব ,সম্মান সব তোমাকে দিলাম দিদা , তুমি বেঁচে ওঠো , ভালো হও !
কিন্তু আমার দিদা সেই যে শয্যা নিলেন সেখান থেকে আর মুখ তুললেন না।তাঁর নাকি মন ভেঙে গেছে।এতো বড় অসম্মানের পর তিনি আবার লোকের কাছে মুখ দেখবেন ,এমনটা হয় না। তিনি নাকি চিরকাল দাপটের সাথে বেঁচেছেন ,জমিদারি চালিয়েছেন,সকলের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন আর আজ কে এক সাধারণ খড় ব্যবসাদার এসে তাকে যা নয় তাই বলে যাবে ?
 আমি মনে যাকে দিদা ডাকেন বাদশা বলে ।আমার নাম অমল।বাদশা দিদার দেওয়া ভালোবাসার নাম।আমি পড়েছি মহা মুশকিলে।
আমি কোনো দোষের দোষী নই, অথচ বাড়ির সকলেই,মায় পাড়া প্রতিবেশীরা পর্যন্ত দিদার এই হালের জন্য আমাকে দায়ী করছেন।
 আমি এখন কি করব ভাবছি । ভেবে কোনও কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।
আমার দিদা অর্থাৎ গঙ্গাবালাদাসী প্রচন্ড দাপুটে মহিলা।তিনি ছিলেন মা বাবার একমাত্র সন্তান ।দিদার মা ,যাকে আমরা বড় মা বলতাম,তিনি খুব অল্পবয়সে বিধবা হন।সে সময় কালে বিধবাদের সম্পত্তির ভাগ নেবার অধিকার ছিল না।কিন্তু তিনি নিজ গুনে সব কিছু আদায় করেছিলেন।একমাত্র কন্যার জন্য যা যা করণীয় সব কিছুই করেছিলেন।
সে সময় শিক্ষার এতো ছিল ছিল না।তবু গৃহ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কর্মনিপুন করে গড়ে তুলেছিলেন মেয়েকে।
সেই দিদা এখন শয্যাশায়ী । তার অসুস্থতার কারণ আমি অমল ।আমি যন্ত্রনায় ছটফট করছি।ভাবছি এখন কি করব ? শহর থেকে বড় ডাক্তারকে ধরে আনলাম ।
ডাক্তারবাবু এসে নারি দেখে বললেন,সব ঠিক আছে।কোন রোগ নেই ।মনের রোগ।
কিছুটা হলেও আমার দিকে আঙ্গুল তোলাটা বন্ধ হল।আমি একটানা দিন পাঁচেক দিদাকে নিয়ে এতো চিন্তিত ছিলাম যে এ ক'দিন পাপড়ির কথা মনেই পড়েনি ।
এই পাপড়িকে নিয়েই তো যত কান্ড ।এখন সন্ধ্যে সাতটা ।সবে সূর্য্য দেব ডুব দিয়েছেন।অমল দেখল আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের ভেলা যেন ভেসে চলছে।আর তাতে ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা।ঠিক এই সময়ে পাপড়ির মুখে আলো পড়লে কি দারুন যে লাগে ,কি বলবো ! বলে বোঝানো যাবে না।
এই মেয়ের বাবা নিতাই দত্ত ।খড়ের ব্যবসাদার।আগে ওনার পিতৃদেব নাকি দিদার মায়ের কাছে কর্য করে দিনাতিপাত করতেন।দিদার বাড়িতে আসতে হলে গলায় গামছা দিয়ে হাত জোড় করে আসতে হত।সে কিনা দিদাকে যা নয় তাই বলেছেন।এতো বড় সাহস ! এ যে ঘোর কলি।
নিতাই দত্তের বাবা কেষ্ট দত্ত ভাদ্র মাসের দিনে ধান বারি না করলে খেতে পেত না।সেই তার ছেলের ,সাহস কত ? বলে কিনা আমার মেয়ে ফেলনা নয়। আর আজকের দিনে পণ প্রথা নেই।উঠে গেছে ।ও সব পণ টন হবে না।মানে দেব না।আমার মেয়ে যে ছেলে পণ নেবে,তাকে বে করবে না।
 দিদা আগেকার দিনের মানুষ।অনেক বদলেছেন,তবু মেয়ের বাপের এতো বড় ঔদ্ধত্য তিনি মেনে নিতে পারলেন না। আমি হলাম গিয়ে তাঁর ছোট মেয়ের চতুর্থ সন্তান।ছাগলের চতুর্থ সন্তানের মতো অবস্থা আর কি।মা বাপের অনেকগুলি সন্তান হওয়ায় আমাকে মাতুলালয়ে দিদার কাছে  রেখে দেওয়া হয়।আমিও দিদার কাছে পরম আদরে প্রতিপালিত হই।
নাতি ও দিদার সম্পর্ক সংসারে সবথেকে মধুর। আমি মানে দিদার বাদশা ওরফে অমল, এই কথাটা জীবন থেকে উপলব্ধি করেছি।আমাদের মধ্যে সব কথা হত। দেখতে দেখতে বড় হলাম।একটা চাকরিও পেলাম।আমার সাথে দিদার সম্পর্কটা কখনো হয়ে যেত মা ও ছেলের মতো।কখনো বন্ধুর মতো।
আমি যখন পাপড়ির প্রেমে পড়লাম দিদাকে সব খুলে বললাম।দিদা আমাকে উৎসাহ জোগাতো ।
এগুলো ঠিকঠাকই চলছিল।কিন্তু বাদ সাধল ,দিদার সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব।
আমার জীবনে দিদা যেমন প্রথম প্রেম তেমনি পাপড়ি যেন অন্য এক আলোড়িত অধ্যায়।আমার বড় হয়ে ওঠা , শিক্ষা লাভ ,কর্মসংস্থান এসবের ভিতর আছে দিদার অনন্ত নজরদারি।আবার সেই দেখভালের সাথে সাথে আমার নিজের মধ্যের চাওয়া পাওয়া তৈরি হওয়া এবং তাকে ফুলে ফলে বিকশিত করবার মধ্যে আমার নিজস্বতা যে আছে তাকে তো আমি অস্বীকার করতে পারি না।
দিদা সে সব বুঝবেন না।তিনি উদার হলেও সেকালের মানুষ।তার মনের ভিতরে সংস্কারগুলো কি এতো সহজে যায় ? আমি যে তার সাধের বাদশা। আমাকে ঘিরে তার মনের মধ্যে গজিয়ে ওঠা আস্ফালনের বহিপ্রকাশ ঘটবে না,তা কি হয় ?
আমার তিন মামা।আমি মাতুলালয়ে ঠাঁই নেওয়াতে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছিল বোধহয়।তাছাড়া তিন মামিমা ও তাদের পুত্র কন্যাগন কেউই আমার উপস্থিতি খুব সহজে মেনে নিতে চায় নি।দিদার প্রবল জেদ আর হার না মানা মনোভাবের জন্য আমি মাতুলালয়ে এতদিন কাটাতে পেরেছি।আমার আর আপন ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না।মনে হয় এই মাতুলালয় টিই আমার আপন গৃহ।দিদাই যেন আমার মা ,আমার বাবা ,আমার সব কিছু।এই গ্রাম আমার জন্মভূমি।আক্ষরিক অর্থে তাই।শুনেছি আমার জন্ম এখানেই হয়েছিল।তখনকার দিনে মেয়েদের সন্তান হবার সময় পিতৃগৃহে পাঠান হত।আমার মামাদের বর্ধিষ্ণু অবস্থা।আর দিদা তার কনিষ্ঠা কন্যটির অভাব অনটনের কথা জানতেন।তাই তার সমস্ত সন্তানকেই তিনি নিজ গৃহে এনে প্রাথমিক লালন প্যানেল করেছিলেন।
    তো আমি অমল ,দিদার বাদশা খুব একটা যে সহজ সরল পথে এতদূর আসতে পেরেছি,তা কিন্তু নয়।আমার জীবনের পরতে পরতে কাঁটা বিছানো ছিল।সেই সব বাঁধাকে জয় করেই আমাকে টিকে থাকতে হয়েছে।
এখন আমার তিন মাতুল পৃথকভাবে বসবাস করেন।আমি আর দিদা একসাথে থাকি।মামারা চাষের আয় থেকে দিদাকে কিছু ভাগ দেয়।বাকিটা আমার চাকরির মাইনে থেকে হয়ে যায়।কিন্তু জানেন,আমি কখনো দিদার থেকে আমাকে পৃথক করে ভাবতে পারি না।সেই জন্মের সময় থেকে একসাথে আছি তো ।
আমি জানি না পাপড়ির বাবা নিতাই মামার সাথে দিদার কেন মনোমালিন্য হল ? দিদা তো আমার ভাল চায়,মঙ্গল চায়। আমি ভীষণ সমস্যায় পড়লাম।মান রাখি না কুল রাখি ? আমার জীবনে যতখানি স্থান দিদার , পাপড়ির স্থান এখন তার থেকে কম কিছু না।পাপড়িও আমাকে সুখে দুঃখে জড়িয়ে থেকেছে।আমার ভালো মন্দে আমাকে অভয় দিয়েছে।আমাকে দিকনির্দেশ করেছে।বাস্তবে ওর নির্দেশেই আমি এখন যে চাকরিটা পেয়েছি,তার ফর্ম পড়েছিলাম।ওকে আমার জীবনে ভীষন প্রয়োজন।দিদা সবই জানেন।আমিই বলেছি।আর সে সব জেনেও দিদা কেন যে পাপড়ির বাবাকে ওসব বলতে গেলেন , তা জানি না !

আমি ঠিক এই মুহূর্তে অথৈ সাগরে ভাসমান।বসেছিলাম বাড়ির বাইরে মামাদের গোয়াল ঘরের দাওয়ায়।একমনে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনছিলাম।ভাবছিলাম ওই আকাশের কত ঔদার্য ! কত দুঃখ , কত লাঞ্ছনা,গ্লানি সহ্য করে ও আজও অম্লান।আমিও আকাশ হব।মানুষের অহং, লোভ,লালসা,ক্রোধ, হিংসা,বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে ভেসে থাকব একা।তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই । ওহ, মুক্তি ! মুক্তির অপার আনন্দে আমি ভেসে যাব।
এমন সময় কাজের মাসি এসে আমাকে ডাকল,বাদশা ভাগ্নে ,মা তোমাকে ডাকছেন।
আমি দেরি না করে হন্তদন্ত করে ছুটে গেলাম দিদার কাছে।
দিদা বলল, তুই আমার নকল বাদশা।মন খারাপ করিস নে ভাই । বে তোর ওই কন্যের সত্যেই হবে।বাজনা না বাজুক,ঘোড়া না আসুক।তবু তোর বে আটকাবে না।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, তোমাকে যারা অপমান করে , তাদের সঙ্গে আমি সম্পর্ক রাখব না দিদা ।
তুই তাকে ছেড়ে যে থাকতে পারবি নে ভাই।আমি কি সেটা জানি নে ।
আমি বললাম , না দিদা , আমি পারবো, তুমি আর আমি ।
আমার দিন যে ফুরিয়ে এলো ভাই,আমি আর ক'দিন।তোকে যে সারা জীবন কাটাতে হবে রে হান্দারাম ! আমার জন্যে তুই কেন তাকে ত্যাগ করবি ? তার কি দোষ ?
সত্যি আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।দিদা আমাকে এতটাই ভালোবাসেন।আমার জন্য তিনি মান সম্মান সব কিছুকেই বলিদান দিতে চান ।টাকার চেয়ে যে সুদ মিষ্টি।আমি যে তার নাতি।নিজের সন্তানের থেকেও প্রিয় ! এ সম্পর্ক নিখাদ।কোনও স্বার্থের দর কষাকষি নেই।এখানে আছে শুধু গভীর ভালোবাসা।মায়া এবং এক অমোঘ বন্ধন।