গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৬ জুন, ২০১৮

আফরোজা অদিতি


করিমন বিবি


    সকাল থেকে দেখা নাই করিমনের। শুক্রবার হলেই কামাই। আগে এমনটি ছিল না। এখন মাসে সাত-আটদিন তো আছেই। জিজ্ঞেস করলে, কী; না মাথা ঘুরে, লো প্রেসার, ডাক্তারের ধারে গেছিলাম; স্যালাইন নিতে কইছে; নিতে গেছিলাম। এরকমের হাজার রকম বায়নাক্কা চলছে।

    এখন ফেসবুকের যুগ; ফেসবুকেই কথা চালাচালির যুগ! করিমনের ফেসবুক নেই, তাই সে আপডেট দিতে পারে না। মোবাইল আছে আজ মোবাইল করেনি। এদের সিণ্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন মিসেস মিমি। কাজে না আসলে অন্য লোককে দিয়ে কাজ করাবে তাও পারেন না তিনি।  নিজেদেরই কষ্ট করতে হয়। ধমকি-ধামকি দিয়েও দেখেছেন কোন কাজ হয় না। বেতন কাটার ভয় দেখিয়েছেন তাতেও ভয় পায় না।

    পরদিন করিমন এলে কেন আসেনি জিজ্ঞেস করলে কোন কথা বলে না করিমন। প্রশ্নের জবাব  না দিলে মেজাজ বিগড়ে যায় মিসেস মিমির। রাগ করলেন; শেষে শুনতে পেলেন তার যে স্বামী চলে গিয়েছিল; দশটা বছর খোঁজ নেয়নি, সেই স্বামীর অসুখ। তাকে নিয়েই শতেক ঝামেলা- ডাক্তার, কবিরাজ, হাসপাতাল করতে করতে কাজের বাড়ি কামাই। করিমন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘খালাগো, একখান গরু ছিল তাও হেই ব্যাডার জন্যি বেচি দিলো আমার শাউড়ি মাগি।

মিসেস মিমি আর কিছু বললেন না। একটু পরে পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিঙে গিয়ে শুনতে পেলেন, করিমন কাঁদছে ইনিয়েবিনিয়ে আর বলছে সুয়ো মাগের ষোল আনা, দুয়োর নামে ছাই / এক চোখা ভাতারের মুখে বাসি আখার ছাই।মিসেস মিমি লক্ষ্য করেন ওর কণ্ঠস্বরের বিদ্বেষ-বিতৃষ্ণা-বিক্ষিপ্ততার ধকধকে আগুন। ওদের এই আগুন কোন কিছু ভস্ম করতে পারে না, শুধু দগ্ধ হয় নিজেই!

ষাটে পা দিলো যেই
আফরোজা অদিতি

    মানুষটির  ষাটে পা। সেই পঁচিশ থেকে এ-বাড়িটির সঙ্গে সম্পর্ক। নতুন বউ নিয়ে উঠেছিল নতুন এই বাড়িতে! বাবা করেছিল এই বাড়িটি। এখানে আসার পর থেকে ওঠা-বসা-কাঁদা-হাসা সব তার এ বাড়িটিতেই। এখানে ভালো-মন্দে মিশিয়ে একমুখী ট্রেনের সদস্যদের সঙ্গে ছিল ওঠা-বসা-কাঁদা-হাসা। ওরা  ভালোই ছিল। ষাটে পা দিলো যেই, আঁধার নামলো সেই। মানুষটির আশপাশটা বদলে গেল চোখের পলকে।  

    একদিন সকালে বাইরে গিয়ে আর ফিরতে পারলো না মানুষটি। ভুলে গেছে বাড়ি যাওয়ার পথ, ভুলে গেছে ঠিকানা। এক-ওকে-তাকে জিজ্ঞেস করেও হদিস পেল না বাড়িটির। হদিস পাবে কী করে ? মনের ভেতরে বাড়ির জলছাপটাই যে হাতড়ে পাচ্ছে না। বাড়িটি যেন ভ্যানিস হয়ে গেছে মন থেকে।

    ওদিকে তার একমুখী ট্রেনের সঙ্গীরা বড্ড চিন্তিত। গেল কোথায় মানুষটা! থানায় ডায়েরী, কাগজে- টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন। নাহ্‌! কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তারা। হঠাৎ একদিন চেনা-জানা একজন প্রায় ধরেবেঁধে নিয়ে এলো তাকে। ট্রেন-সঙ্গীদের একজন তার প্রিয় জলচৌকিটা দিলো পেতে। কিন' সেই মানুষটি দোটানায়- বসবে ? কী বসবে না! চোখ দুটোতে শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে বিস্ময়! চোখের ভেতর তার সাদা বলাকার সারি। বলাকারা উড়ছে, ক্রমশ নীল ঢেকে যাচ্ছে তাদের ডানায়! একসময় স-ব অন্ধকার। বলাকারা উড়ছে না তার চোখে। বিষণ্ণ নিষ্প্রাণ চোখদুটোয়  শুধুই অন্ধকার!