কাক
অপরের ভ্যানরিক্সা চালিয়ে অতুল যা আয় করে, তাতে নিজের দু’বেলা পেট
ভরে খাবার না জুটলেও, নিয়ম করে
প্রতিদিন দুপুর বেলা যা জোটে তাই খাওয়ার পর,
বস্তির টালির
চালের ঘরের বাইরে সামান্য খোলা জায়গাটায় দু’-তিনটে
কাককে দিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যে তার খাবার সময়, তার বা তার গৃহিনীর থেকে কাকগুলো অনেক ভালো বোঝে। প্রতিদিন ওই সময়টায় তিনটে
কাক নির্দিষ্ট জায়গাটায় পায়ে ঘড়ি বেঁধে,
ঘাড় কাত করে, অতুলের
দরজার দিকে তাকিয়ে খাবারের অপেক্ষায় বসে থাকলেও,
একবারের জন্যও তাদের উপস্থিতি জানান
দেওয়ার জন্য ডেকে বিরক্ত করে না। খাবার দেওয়ার পরে নিজেরা খেতে শুরু করার আগেই
চিৎকার করে অনুপস্থিত ও খাবার আসরে নতুন অতিথিদের ডেকে আনে। এই করতে গিয়ে অনেক সময়
নিজেদেরই খাওয়ার সুযোগ ঘটে না। অতুল ভাবতো কাকের মতো বোকা প্রাণী পৃথিবীতে আর
দ্বিতীয়টা নেই। হয়তো এইসব কারণেই বস্তির সকলের কাছেই সে আধপাগলা অতুল হিসাবে
পরিচিত,
যদিও সে কোন প্রতিবাদ করে না।
একই বস্তির অপর একটি অস্বাস্থ্যকর ঘরে স্বামী পরিতক্তা নিঃস্ব মিনতি পাঁচ সাত বাড়ি বাসন
মেজে, ঘর মুছে, পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্ট করে সংসার চালায়। কিছুদিন
ধরে ছেলে খাসির মাংস খাওয়ার বায়না ধরেছে। খাসির মাংস সে কখনও না খেলেও, মা’র সাথে
একটা কাজের বাড়ি গিয়ে তাদের বাড়ির সমবয়সি বাচ্চাটার মুখে শুনেছে যে খুব ভালো খেতে।
মিনতির পক্ষে ছেলের এই আবদার মেটানো খুব শক্ত, এমনিতেই তার আয়ে দু’বেলা পেট ভরে খেয়ে, ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল, তার উপর আবার এই অতিরিক্ত খরচ করার কথা সে ভাবতেই পারে না।
আজ বোধহয়
সেই সুযোগ এসে উপস্থিত হয়েছে। পাশের বড় রাস্তার ওপর নগেন বাবুর মেয়ের আজ বিয়ে।
নগেন বাবু খুব ধনী, তার ওপর তাঁর
একমাত্র মেয়ের বিয়েতে খাবার আয়োজন ও নিমন্ত্রিতের সংখ্যাও অনেক। ছেলেকে সঙ্গে করে
নিয়ে গিয়ে,
যারা খাবার
পরিবেশন করছে, ও যারা বিশাল বিশাল নৌকার মতো পাত্র করে উচ্ছিষ্ট খাবার পাশের
ভ্যাটে নিয়ে গিয়ে ফেলছে, উভয়
পক্ষকেই অনুরোধ করেও কিছু সুরাহা না হওয়ায়, সঙ্গে করে নিয়ে আসা পাত্র নিয়ে ভ্যাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এইসব বর্জ্য
খাদ্য বাহকেরা বড় বড় পাত্রে বয়ে আনা উচ্ছিষ্ট খাদ্য বেশ কিছু কুকুর ও অভুক্ত
ভিখারির ভিড় কাটিয়ে পাত্র উপুর করে ভ্যাটের গভীরে ফেললেও, মিনতির ছোট্ট পাত্রে বেছে বেছে দেওয়ার সময় বা ইচ্ছা, কোনটাই
তাদের নেই। বাধ্য হয়ে মিনতি আর সকলের মতো ভ্যাট থেকেই কিছু পরিস্কার খাবার নিজের
পাত্রে তুলে নেবে ভেবেছিল, কিন্তু উচ্ছিষ্ট
খাবার সংগ্রহ নিয়ে সকলের কলহ, মারামারি ও কুকুরের তেড়ে আসা দেখে সে সাহস না হওয়ায়, খালি হাতে
ছেলের হাত ধরে সজল চোখে ঘরে ফিরে আসে।
আজ মাসের
মাইনে পেয়েই মিনতি ছেলের জন্য খাসির মাংস কিনতে যায়। তার প্রয়োজন মাত্র পঞ্চাশ
গ্রাম। এমাসে অতিরিক্ত আঠাশ টাকা খরচ সে যেভাবে হোক সামলে নেবে। কিন্তু মাংস
বিক্রেতা পঞ্চাশ গ্রাম মাংসের কথা শুনেই চিৎকার করে তাকে চলে যেতে বলে। অন্যান্য
খদ্দেররা কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করে না, বরং মিনতির চাহিদার পরিমাণ শুনে হেসে ওঠে,
কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে, “আজ তোমার বড় খদ্দের এসেছে হে” বলতেও ছাড়ে না। মিনতি কাকুতি মিনতি করে জানায়, যে এর
বেশি কেনার সামর্থ তার নেই। ছোট ছেলেটাকে দেখিয়ে জানায় বাচ্চাটার বায়নায় সে মাংস
কিনতে এসেছে, দয়া করে
তাকে ওই অল্প পরিমাণ মাংস দেওয়া হোক,
সে টাকা নিয়ে এসেছে, যা দাম লাগে দিয়ে দেবে।
অবশেষে দয়াপরবশ হয়ে তাকে পঞ্চাশ গ্রাম মাংস দিয়ে বত্রিশ
টাকা দিতে বলা হয়। আর পাঁচজনের মতো ইচ্ছামতো পছন্দের জায়গা থেকে মাংস বেছে নেওয়ার
কথা তো সে ভাবতেই পারে না, কিন্তু আর
সকলের নীরবতা তাকে মাংস বিক্রেতার অশোভন আচরণ ও বেশি টাকা দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা
থেকেও পিছিয়ে আসতে বাধ্য করে। দোকানের সামনে অতুল তার ভ্যানরিক্সায় বসে বিড়ি টানতে
টানতে সব লক্ষ্য করলেও, আধপাগলা অপবাদ তাকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখলো।
রান্না করতে গিয়ে মিনতি বুঝতে পারে গরীব হওয়ার অপরাধে সে
অতি অল্প পরিমাণ মাংস কিনতে, ও অল্প
পরিমাণ মাংস কেনার অপরাধে সে মাংসের পরিবর্তে মাংসের ছাঁট ও কিছু অখাদ্য অংশ, অতগুলো লোকের চোখের সামনে দিয়ে বেশি দামে নিয়ে আসতে
বাধ্য হয়েছে। খাওয়ার পাতে শিশুটি অখাদ্য ছিবড়ে ফেলে, অন্যান্য দিনের মতোই মা’র সাথে তৃপ্তি করে ফেনমাখা ভাত আলুসিদ্ধ দিয়ে খেয়ে নেয়।
অতুল আজ কাককে খাবার দিতে গিয়ে তাদের অন্যান্য কাকদের
চিৎকার করে ডেকে আনা দেখে প্রথম মনে হলো কাকেরা বোধহয় বোকা নয়, আসলে তাদের শরীরের ভিতর একটা হৃদয় বলে জিনিস আছে, যেটা হয়তো
অন্যান্য অনেক প্রাণীর মতো মানুষের শরীরেও নেই।