গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৬ জুন, ২০১৮

দীপলেখা মুখার্জ্জী


প্রজাপতি

সারাদিনের কাজকম্মো সেরে লক্ষী যখন বিছানায়  শুলো তখন রাত ১১টা। মনটা কদিন ধরেই খারাপ, শাশুড়ির মুখঝামটা, স্বামীর মারধোর সেতো সেই বছর সাতেক ধরেই চলছে।মারকে 
আর ভয় পায়না, ছোটবেলা থেকেই, মা বাবা দাদা দিদি সবাই ওকে ছোটবড় ভুল করলেই মারধোর করে এসেছে। ইদানীং সকলে 'পাগলি' 'পাগলি' বলে খেপায়, এটায় ওর বড় কষ্ট! লক্ষী জানে, ওর মধুসূদন দাদা ওকেই শুধু দেখা দেয়।

বিছানায় শুয়েই জানালার দিকে চোখ গেল! এতো বড় একটা চাঁদ উঠেছে, বড় একটা যেন রূপোর থালা।  চাঁদটা যেন ওকে দেখে হাসছে, না না  পাগলি বলে মজা করছে। 'আমি পাগলি না' বলতেই তারের ওপর বসা রাতপাখি গুলো হেসে উঠল, সাথে তালগাছ গুলোও, ঠকঠক করে পাতার হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। কেঁদে ফেলল লক্ষী। দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি শুধু বাঁশিই বাজাও মধুসুদন দাদা, আর তো কষ্ট সহ্য হয় না। একটা সন্তানও দিলে না, তবু তো সে আমার কষ্ট বুঝতো! " লক্ষী স্পষ্ট দেখল, মধুসূদন দাদা, বাঁশি থামিয়ে তাকে ইশারায়   দরজা দেখালো। লক্ষী এক গাল হেসে, উঠে বসে লাল ওড়নাটা গায়ের উপর ফেলে বাইরে এসে দাঁড়াল।চরাচর ভেসে যাচ্ছে জোৎস্নায়। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ।  

পাশের ঘরে বিছানায় ওর স্বামী ঘুমচ্ছে আফিং খেয়ে, এই নেশার কারনেই আজ পর্যন্ত মা হতে পারল না লক্ষী। মদ,গাঁজা, আফিং সব খায়। পাড়ার লোক, আত্মীয়স্বজন সবাই দোষ দেয় লক্ষীকে। কোন শুভকাজে 'বাঁজা' বলে ডাকে না। 

মধুসুদনদাদার ডাকে সাড়া দিয়ে এই রাত দুপুরে লক্ষী চলতে লাগল,আলপথ ধরে। এসে দাঁড়ালো একটা লাইটপোষ্টের সামনে, সকালে এখানে তারের কাজ হচ্ছিল, এখনো লম্বা মইটা রাখা আছে, তরতর করে উঠে পড়ল মইয়ে করে লাইটপোষ্টের মাথায়।তাদের গ্রামের পুরোটা দেখা যাচ্ছে, এত ওপর থেকে। চোখ জুড়িয়ে গেল, তার আনন্দে হাওয়া, পাখি, তালগাছ, ধানক্ষেত  সবাই হাসতে লাগল মনে হল যেন উৎসব।  এমন সময় মধুসূদন দাদা ওর কানে কানে বলল, দুটো তার ধরে ঝুলে পর, সব কষ্টের শেষ হয়ে যাবে। তোর জন্য কেউ কাঁদবে না। কেউ না। চোখবন্ধ করে মনে করল, বাবা, দাদা,দিদি,স্বামী না! কেউ না,কেউ তাকে কোনোদিন ভালবেসেছে,তার মনেই পরল না। শুধুমনে পড়ল রহিমের কথা। সেই তাদের পাড়ায় আসা কাবুলিওয়ালা, যে তাকে একদিন আদর করেছিল লুকিয়ে, বলেছিল, "লখস্মী, তোকে আমি খুব ভালবাসি " আর বলেছিল "টাকা জমিয়ে বাড়ির সামনে ফুলের বাগান করবে, তাদের শুখা ধরতিতে চাষ করতে অনেক টাকা চাই।"--মনে পরতেই চোখে জল এল লক্ষীর, চোখ খুলে বলল, মধুসূদন দাদা আমার একটা শেষ ইচ্ছে রাখবে গো? পরের জন্মে আমি যেন একটা প্রজাপতি হয়ে জন্মাই। শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি থামিয়ে হেসে ঘাড় নাড়ল। শেষবারে মতো লক্ষী চঁাদ দেখল, গ্রামটা দেখল, মধুসূদন দাদার দিকে তাকিয়ে হাসল, খপ করে ধরে ফেলল তার দুটো। প্রচন্ড জোরে একটা শব্দ হল, বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আলো ঝলকে উঠল। পাখি গুলো ভয়ে চিৎকার করে উঠল।সকলের জন্য ফেলনা,  লক্ষী আলো ছড়িয়ে মিলিয়ে গেল, পৃথিবী থেকে। ব্যাস আর কিচ্ছু না। কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হল না কিছুর।পৃথিবী চলতে লাগল তার আর্হ্নিক গতি, বার্ষিক গতির ছন্দে। 

বহু দূরে আফগানিস্তানের একটি  বাগানে একটা মস্তবড় লাল ডানাওয়ালা প্রজাপতি দেখে, রহিমের বিবি রুকসনা, রহিমের কাছে বায়েনা করল ওটা ধরে দিতে। রহিম প্রজাপতি ধরার জাল আনতে গেল।