ধারাবাহিক
হ্যান্টেড কাহিনী
কলকাতার পুতুল বাড়ির রহস্য
কলকাতার
মহাশ্মশান নিমতলা ঘাটের কাছাকাছির পুতুল বাড়ির কথা আমরা অনেকেই জানি। পুতুল বাড়ি
আজ পড়ো পরিত্যক্ত হলেও একটা সময় ছিল যখন এ বাড়ি এক অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসাবে
পরিচিত ছিল। একে বাড়ি বললেও আসলে এটা হল অতীতের বিখ্যাত খাঁটি রোমান স্থাপত্য
প্রদর্শিত এক প্রাসাদ। এই বহুতলীয় ইমারতের সর্বাঙ্গ সাজানো ছিল নানা রকমের পুতুলের
মূর্তিতে। প্রাসাদের দেওয়াল সজ্জার প্রতি স্তরেই প্রতিফলিত হয় প্রাচীন রোমান
শিল্পকলা।
শোভাবাজারের
জেটির কাছে গঙ্গার খাতকে পেছনে রেখে আহিরীটোলার হরচন্দ্র মল্লিক লেনে এই পুতুল
বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ চিহ্নিত এ বাড়ি কে বা করা তৈরি করিয়ে
ছিল এ ব্যাপারে ইতিহাস স্পষ্ট কিছুই বলেনি। গঙ্গার পাশের এ প্রাসাদ আসলে ছিল
জমিদারদের প্রমোদ ভবন। সে সময় জুড়িগাড়ি, পালকি কিংবা নৌকাবিলাসে এখানে জড়ো হত সব বিত্তবান জমিদাররা। রাত বাড়তেই পুতুল
বাড়ির সারা ঘরে জ্বলে উঠত সুসজ্জিত সব ঝাড়বাতি। প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে ধ্বনিত হয়ে
উঠত বাঈজীদের ঘুঙ্ঘুরু। আসলে এটা তো ছিল জমিদার বা বিত্তবানের আমোদ-প্রমোদ ভবন। বহুতলীয়
পুতুল বাড়ির দ্বিতল থেকে শুরু হত সব নাচঘর--বিলাসিতার রঙমহল। শোনা যায় শুধু বাঈজী নয় গরীব পরিবার থেকে কিনে বা ধরে নিয়ে
আসা মেয়েদের নিয়েও এখানে ভোগ-বাসনার তৃপ্তি ঘটান হত। প্রতিবাদী মেয়েদের অনেক সময় মেরে
ফেলা হত। এখানে খামখেয়ালী,
বদমেজাজি বাবুরা নাকি অনেক মেয়েদের নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে।
সে দিন
ছিল পূর্ণিমা রাত, এক
সুন্দরী নর্তকী দীর্ঘ সময় ধরে নেচে যাচ্ছিল। শোনা যায় সে খুব পরিশ্রান্ত হয়ে
মেঝেতে বসে পড়েছিল। কিন্তু মদমত্ত বিলাসীদল তাকে বারবার নাচতে হুকুম করছিল। শেষে
নাচতে না পারায় সেই নর্তকীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আর তখন থেকেই পুতুল
বাড়িতে শুরু হয়েছিল ভৌতিক উপাখ্যানের সূত্রপাত। সে নর্তকীর হত্যা হবার পর প্রতি
পূর্ণিমা রাতে সে নাকি নাচঘরে আবার ফিরে আসে। সে নাচে,
তার ঘুঙ্ঘুরের আওয়াজে সারা প্রাসাদ গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে !
তখনও
পুতুল বাড়ির নিচের তলায় কিছু লোক বাস করত। সন্ধ্যের পর ওপরের তলায় কেউ উঠতে সাহস
পেত না। এখানকার লোকরা বলে, অনেক
মহিলা আত্মারা নাকি বাড়ির ওপর তালার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। এখানে এক বিত্তশালী
জমিদার নাকি মহিলাদের ওপর শারীরিক নারকীয় নির্যাতন চালাত। এদের মধ্যে কারও কারওকে
খুনও করা হয়েছে। বাড়ির বারান্দার ওপর তালার কুঠুরিতে নাকি এসব আত্মারই রাতে ঘোরা
ফেরা করে বেড়ায়।
পরবর্তী
কোন এক সময় এখানে এক বড়লোক মনিবের অনেক দাসী রাখা ছিল। দাসীদের ওপর মনিবের যৌন
সম্পর্ক ছিল। কিছু দাসী মনিবের অত্যাচারের প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর সে জোর করে যৌন
সম্পর্ক স্থাপিত করত। প্রবল প্রতিবাদের জন্যে নাকি মনিব কিছু দাসীদের হত্যা করে
বাড়ির পেছনে তাদের লাশ মটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল। তারপর একটা সময় রাজাদের হস্তক্ষেপে
এইসব নারী নির্যাতন বন্ধ হয়। কিন্তু নির্যাতিতা ও খুন হওয়া নারীদের হাহাকারে
পুতুলবাড়ি একটা অভিশপ্ত বাড়িতে পরিণত হয়।
এই
অভিশপ্ত বাড়িতে রাতের বেলা অচেনা নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়। কখনও কখনও আচমকা
মেয়েলী হাসির শব্দ, চীৎকার,
কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। অনেকেই বাড়ির বিভিন্ন স্থানে সাদা
পোশাক পরা নারীর ছায়াকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে।
এ সব
জমিদারী বিত্তশালীদের ইতিহাসের পর কত কাল পার হয়ে গেলো কিন্তু আজও মাঝ রাতে মাঝে
মাঝে এখানে অশরীরী মেয়েলী কণ্ঠের কান্না শুনতে পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের
ধারণা জমিদার বা মনিবদের এই পাপের কারণে এখনো পুতুল বাড়িতে অশরীরীদের আনাগোনা লেগে
আছে। এই ভয়ঙ্কর পুতুল বাড়ি নিয়ে সত্যজিৎ রায় ও লীলা মজুমদারের বাংলা কিছু ভয়ংকর
গল্পও রয়েছে।
এভাবেই
পুতুল বাড়ি কলকাতার এক রহস্যময় স্থান হয়ে উঠেছে। গভীর রাতে তো বটেই এমন কি ভর
দুপুরেও নাকি এখনও এখানে কিছু অশরীরী আত্মার উপদ্রব রয়েছে।