বলিদান
দীননাথকে খড়্গ হস্তে ছাগশিশুটির দিকে অগ্রসর হতে দেখিয়া তাহারই চার বৎসরের
শিশু কন্যা দীপশিখা রুদ্ধশ্বাসে ক্রন্দন করিতে করিতে আধো আধো বুলিতে কহিলো – কিন্নরীকে হত্যা
করিও না পিতা । কিন্নরীকে হত্যা করিও না । উহাতে তোমার পাপ হইবে । কিন্নরীকে হত্যা
করিতে হইলে পুর্বে আমাকে হত্যা করিতে হইবে ।
শিশুকন্যার ক্রন্দনে দীননাথের হৃদয় বিগলিত হইলো বটে তবে তাহা মুহূর্তকালের
জন্য । সে থমকাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিলো ক্ষণকালের জন্য । সেই অবসরে খড়্গখানি তাহার
হস্তচ্যুত হইয়া ভূলিণ্ঠিত হইলো । দীননাথ সেইমুহূর্তে ভাবিয়া দেখিলো যে, সে একটি কশাই মাত্র
। নিষ্পাপ জীব হত্যা করিয়া অর্থ উপার্জন করা তাহার গ্রাসাচ্ছাদনের একমাত্র অবলম্বন
। সে যখন জ্ঞানপূর্বক জীব হত্যার ভার গ্রহণ করিয়াছে ,
তখন তাহার পাপ হইবে না । দীননাথ এইমতো ভাবিয়া
আত্মতুষ্টি লাভ করিয়া নিজ মনে বিড়বিড় করিলো ,
‘পৃথিবীর যাবতীয় সুখ-সুবিধা কেবলমাত্র মনুষ্যগণেরই প্রাপ্য । অতএব
ছাগশিশু কিন্নরীকে হত্যা করিয়া আমি কোনো পাপ কর্ম করিতেছি না ।’
দীননাথ ইহা ভাবিয়া নিজ চারিপার্শ্বে রক্ষার প্রাচীর গড়িয়া তুলিলো । ছাগশিশুটি
অনতিদূরে হাড়িকাষ্ঠে গলা ডুবাইয়া করুণ স্বরে ‘ব্যা-ব্যা’ রব তুলিতেছে ।
ইতিমধ্যে কতিপয় ক্রেতা আসিয়া দীননাথকে তাগাদা দিয়া কহিলো –
ওহে
দীননাথ , বৃথা কাল হরণ না করিয়া ছাগশিশুটিকে কর্তন করো । আমরা মাংস ক্রয় করিয়া দ্রুত
গৃহে গমন করি ।
লজ্জিত দীননাথ ভূলুণ্ঠিত খড়্গটি দ্রুত হস্তে তুলিয়া ধরিলো । তাহা দেখিয়া
শিশুকন্যা দীপশিখা পুনরায় ক্রন্দন করিয়া কহিলো –
কিন্নরীকে হত্যা করিও না পিতা । উহাকে হত্যা
করিলে আমিও বাঁচিবো না ।
দীননাথ কন্যাবাক্য অগ্রাহ্য করিয়া ছাগশিশুটির নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলো । শানিত
খড়্গখানি মস্তকের ওপর তুলিয়া ধরিয়া চক্ষুমুদিয়া ভক্তিপূর্বক স্বীয় ঈশ্বরকে যখন
স্মরণ করিতেছে তখনই ক্রেতাদের মধ্যে গুঞ্জন রব উঠিলো । দীননাথ তাহা শ্রবণ করিয়া
ভাবিলো বৃথা কাল হরণ করিলে ক্রেতাগণ বিরূপ হইয়া ফিরিয়া যাইবে এবং আমাদিগকে অনশনে
দিন কাটাইতে হইবে । এমত ভাবিয়া উদ্যত খড়্গখানি ছাগশিশুটির গণ্ডদেশ লক্ষ্য করিয়া
সবলে আঘাত হানিতে গিয়া দেখিলো তাহারই শিশুকন্যা দীপশিখা মস্তক রাখিয়াছে হাড়িকাষ্ঠে
এবং ছাগশিশুটি আশ্রয় লাভ করিয়াছে তাহার বক্ষে !