ফাঁদ
‘ ধূ ধূ মাঠ,
কোথাও কোন জনমনুষ্য নাই। বহুদুরে দুই-একটি মাত্র মাটির ভাঙ্গা ঘর ছায়ার মত দেখা যাইতেছে। চতুর্দিকে ভগ্ন প্রস্তর ছড়ানো, মাঠ ঘাট
গুল্মলতায় পরিপূর্ণ।
সেই জনহীন প্রান্তরের উপর দিয়া একখানি শীর্ণ পায়ে চলার পথ বহুদুর পর্য্যন্ত
বিস্তৃত। সীতাপতি বধূর হাত ধরিয়া সেই প্রান্তরে উপস্থিত হইল...’ এই পর্য্যন্ত পড়েই বিকাশ বইটির
পাতায় একখানি পাখির পালক রেখে বইটি মুড়ে বিছানার পাশে রাখল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে ভাবল,বাস্তবিকই এই জায়গাটিও যেন সেইরকমই। ফাঁকা, কেউ কোথাও
নেই, দূরে কিছু ভাঙ্গা,
মাটির ক্ষয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি। প্রভাত কি সীতাপতি,যে বধূর হাত ধরে এই জনহীন প্রান্তরে এসে বসবাস করছে! বেশ একটু মজাই লাগল ভাবতে। তাহলে একদিন দেখতে হবে পায়ে চলার শীর্ণ পথটি কোথাও
আছে কিনা, থাকলে সে কোথায় গিয়ে মিশেছে।
মাত্র কিছু
লোকজন মিলে এখানকার বসবাস। নতুন
রেললাইনের কাজ চলছে, সামনে
একটি ইঁটভাঁটা আছে। রেলের কর্মী আর ইঁটভাঁটার লোকজনেরাই এখানে থাকে। বেশির ভাগই শ্রমিক,
দিনমজুরের দল। দু-চার জন বাবু আর একজন মাত্র অফিসার গোছের লোক। কে তাকে এখানে আসার কথা বলেছিল, এখন আর
মনে নেই। কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পক্ষে এর চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর
কিই বা হতে পারে! কিন্তু
কতদিন অন্যের উপরে নিজের ভার চাপিয়ে এভাবে থাকা যায়, তার মত কলকাত্তাইয়া বাবু আর
কতদিন এভাবে থাকতে
পারে!
অনেকক্ষণ
থেকেই মন চা –চা করছিল,
কিন্তু বন্ধুর স্ত্রীটিকে নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে বিব্রত
করতে বিকাশের মন চাইছিল না। অন্যের ওপর জোর জুলুম করা সাজে না। এপাশ ওপাশ চাইতেই দেখে রুক্মিণী
নিজেই দুকাপ চা হাতে নিয়ে এঘরে আসছে। বারান্দা দিয়ে আসার সময় কার সঙ্গে যেন কথা বলল,
তারপর ঘরে এসে জিজ্ঞেস করল—চা হোবে?
রুক্মিণী উত্তর বিহারের মেয়ে, আরা না ছাপরা না সীতামারি কোন এক
জেলার অজ এক গাঁয়ে তার বাপের বাড়ি। চেহারা অনিন্দ্যসুন্দর বললেও কম
বলা হয়। বিকাশ তার জীবনে
এত সুন্দরী মেয়ে কখনো দেখেনি। রুক্মিনীর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে অসুবিধে বোধ করে,
কেমন যেন অস্বস্তি করে। কিছু করারও নেই। প্রভাত সেই ভোরবেলা
বেরিয়ে যায়, আসে প্রায় চারটে নাগাদ।
ততক্ষণ রুক্মিণীর সঙ্গেই কথাবার্তা চালাতে হয়, যা দরকার চাইতে হয়। প্রভাতের মত সাধারণ এক চাকুরিজীবির কি করে এত সুন্দরী
একজনের সঙ্গে বিয়ে হল, বিকাশ সেই
কথাটাই শুধু ভাবে, যেন
সাধারণ মানুষের সুন্দরী কে বিয়ে করতে নেই। কিছু কিছু কথা জেনেছে বিকাশ,
প্রভাতই বলেছে তাকে। গরীব বাপের মেয়ে,
টাকা-পয়সার
জন্য বিয়ে আটকে যায়, প্রভাত তাকে উদ্ধার করেছে। এমন মেয়েরও বিয়ে আটকায়! অবাক হয়ে ভাবে সে। রুক্মিণী এসে বাধা দেয়। --কি ঘরে বসিয়ে আছেন ভাইয়া, বাহার যাও, দেখো
চারোঁ তরফ...বহোত কুছ হ্যায়...খালি ঘরে বসিয়ে থাকেন আপ জি!’
--তুমি দেখেছ?
--সব না দেখলো...কুছু কুছু দেখেছি।‘ বলেই মিষ্টি হাসি হেসে বলে –আপ্সে জ্যাদা দেখ লিয়া...
—কখন যাও, প্রভাত তো
সারাদিন বাইরেই থাকে’।
--হম তো বাহার না রহে, ঘর মে থাকি।‘বাংলা
বলার চেষ্টা করে রুক্মিণী। অর্থাৎ সে তো আর বাইরে বাইরে ঘোরে না প্রভাতের মত,
সুতরাং তার এখানকার সবকিছু না দেখার কি আছে! প্রভাতের কাছ থেকে কিছু কিছু বাংলা শিখেছে সে। কি যেন একটা
কথা বলতে গিয়েও চুপ করল, বিকাশের
দিকে একবার তাকিয়ে ঘরের বারান্দায় এল রুক্মিণী। একটু পরেই আবার বিকাশের ঘরে এসে ওর খাটের কাছে মেঝেতে
বসল। বিকাশ হাঁ-হাঁ করে
উঠল— আরে...আরে,
এ কি! এখানে কেন?’ বলল,
আবার খাটে তার সঙ্গে বসতে বলতেও পারছে না,
কিসের এক অস্বস্তি ধরে রেখেছে। অবাক হল রুক্মিণী। --কিঁউ,
আপনাকে বাড়িতে কেউ জমিন
মে বসে না? আমরা বহুত
গরীব ভাইয়া,হামাদের এত্ত বড়া ঘর নাহি । এক কামরা, উসিমে সব...খানা, বৈঠনা, সো না...সব’ । কি কথার কি উত্তর! লজ্জ্বা
পেল নিকাশ। কিন্তু মাটিতে রুক্মিণী বসে আছে বলে ওর নিজের খাটের ওপর বসে থাকতে
খারাপ লাগছিল। খালি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে ভিতরের বারান্দায় যাবে, রুক্মিণী তড়াক করে
উঠে হাত থেকে চায়ের কাপ নিল---মুঝে
দিজিয়ে ভাইয়া...ওহ্
গুসসা করেঙ্গে’। ভুরু কোঁচকালো বিকাশ--কেন, গুসসা
করবে কেন?
--আপ মেহমান যো হ্যায়’। থতমত খেল বিকাশ,রুক্মিণী
কি মনে করিয়ে দিল!
সত্যি,আর কতদিন এভাবে অতিথি হয়ে থাকা যায়! মুখে কিছু না বললেও অসুবিধে কি হয় না। একটা মেয়ে সারাক্ষণ একবাড়িতে অন্য একটা লোকের
সামনে খাওয়া-বসা, গল্প করা,
রান্না করা...এসব করতে পারে! একটা মাত্র কলঘর...তার নিজের দরকার থাকলেও বলতে পারে না। সে তো তার নিজের কেউ
নয়, বরের বন্ধু, তবে! খারাপ লাগছিল বিকাশের। দু/একদিনের মধ্যেই চলে যাবে সে। অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে নেবে।
কিন্তু মুশকিল হল, যাবে কোথায়, তেমন
নিরাপদ জায়গা আর আছে কি? কেউ না
কেউ তাকে দেখে ফেলবেই। এ একেবারে পৃথিবীর একপ্রান্তে,
কেউ বোধহয় জানেই না এই জায়গাটার কথা,
তাই এমন সহজে থাকতে পারছে। তাছাড়া সে কেন এসেছে,
কি কারণে এসেছে,এসব এখানে খুব সহজেই বুঝিয়ে বলা গেছে, প্রভাত কি তার বউ রুক্মিণী একটুও সন্দেহ করেনি। করলে বিকাশের পক্ষে মুশকিল হত।
যাবে বললেই তো যাওয়া সহজ হবে না,দেখা যাক্।
(২)
বিকেলের
আলো মরে আসছিল। জানলা দিয়ে দুরের ছোট ছোট গাছপালা, অনেক দুরের
মাটির ভাঙ্গা ঘরগুলো কেমন যেন আবছা লাগছিল,ক্যালেন্ডারের ছবির মতন। ওখানে কি কোন মানুষজন থাকত একসময়,ওই ঘরগুলোয়? জানতে ইচ্ছে করে, কারা তারা?
চলে গেছে, নাকি মরে গেছে? একটা গোটা
গ্রাম এভাবে শেষ হয়ে যায়! নাকি আরো গভীরে আছে অন্য কোন ঘটনা, কি সে?বাইরের
দিকে চেয়ে চেয়ে এইসব চিন্তাই করছিল বিকাশ। অন্যদিন প্রভাত প্রায় এইসময়েই এসে পড়ে।
আজ দেরি হচ্ছে কেন কে জানে! সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বিকাশ বলল—তুমি ওখানে গেছ,ওই ভাঙ্গা
মাটির ঘরগুলোর কাছে?’
--আমাদের বিহারে নিজের ঘরই ত ভাঙ্গা আছে,আবার দুস্রা
কে ভাঙ্গা ঘর কেনোদেখব? সব তো একই
আছে...ই জায়গা যেমন আছে,আমরাকে ঘর তো ওইসে হি ...তো কেনো যাব!’ যেন
প্রশ্ন করে বিকাশকে।
--সারা জিন্দগী ত এমনি ভাঙ্গা কাটল, তো নয়া কি আছে জি?
আপনি দেখ কে আসুন, লেকিন
আপনাদের কি সব বড়া বড়া লোক আছে,বহুত পয়সাওয়ালা? গরীব নাই
কোই? জিন্দগী ভি তো এমনি
আছে ভাইয়া,
কভি টুটা-ফুটা, তো কভি রওশন। ...দেখো, এখানে রেল লাইন আছে,
বাজার আছে, আদমী লোগ আতে
যাতে হ্যাঁয়, আবার কিসি জগহ দেখো একদম সুনা...একদম সুনা, সুখা পড়া হুয়া...ইয়ে সব দেখতে ভালো লাগে? আপনার মন মে ...দুখ নহি লগতা!...আপনি কি ইয়ে সব দেখনে কে লিয়ে আসেছেন...ক্যা ভাইয়া?’
একনাগাড়ে
অনেক কথা বলে চুপ করল রুক্মিণী। বিকাশ চুপ করে আছে, কোন কথা বলছে না দেখে আবার বলল সে---আমি জানে আপনি এখানে কেনোআসেছেন। আপনে কেনো এমন করলেন? যো দুখী
ভাইয়া, কেনো উকে ঔর দুখী
বানাবে। কেনো
মারলে উকে? সুখ কে লিয়ে বহোত কম চিজ লাগে,বহোত কম...ওটা কেন নিয়ে লিবে? অগর নিবে
তো পালাবে কেন? আপনি জানে, কি উয়ারা আপনাকে ধরিয়ে দিবে...সেজন্যে
আপনি পালাবে, তো লিয়া
কিউঁ? বুরা মত মানিয়ে ভাইয়া,যো লেতে
হ্যায়, বহ তো দেতে নহি...তো লেনা ভি নহি চাহিয়ে।‘
‘আমি বহুত দেখেছি, আপসে ভি
জ্যাদা...ইয়ে,আপনি ইখানে যো সুনা দেখছেন, আমার অন্দর উস্সে ভি সুনা, খালি পড়ে আছে। আপ মুঝে ক্যা দেখাবে,মত দিখাও মুঝে। আমি সব জানি, জগহ ভি জানি, সব আদমী কো ভি জানি। আদমী বহোত
শয়তান আছে!
--প্রভাত কি বলেছে তোমাকে,সব বলেছে?
-আমি জানতে পারি, হামি আদমী দেখলে বুঝতে পারি,আপনার মুখে দাগ আছে ...উ আমাকে
বোলে নাই...আমি নিজে জানি।‘
-কি জান, তুমি?’ রুক্ষ হয়ে উঠল বিকাশের গলার
স্বর।
--এহি,কি আপনার ডর লাগছে আমাকে...আপনি দোস্তকে বিস্ওয়াস করছেন না...কাল সুবহ আপনে চলিয়ে যাবেন, নেহি তো...’
-না হলে কি?
কঠিন চোখে
তাকাল রুক্মিণী,নহি তো,আমি ধরিয়ে দিবো...
--কাকে চেন তুমি এখানে?কাকে বলবে আমার কথা? তুমি
কতদিন এসেছ এখানে, কাউকে চেন,
যে তুমি বলবে?’
ক্রুর
হাসি হাসল রুক্মিণী,রেল
কোম্পানী ঔর ইঁটভাঁটার কাম করে আদমী লোগ সব পাক্কা
চোর আছে। ওহি
আদমী সব কে পকড়বার
জন্য লোক আছে
সরকার সে, জাসুস জানে আপনি, জাসুস...ওহি কাম
করে আমার আদমী,আপনে
দোস্ত...ওহ চোর,
ডাকু, বদমাশ পাকড়ায়...আপনার অগর বিশ্বাস না হোচ্ছেতো
পুছে নিবেন। আমার আদমী সব চোর-বদমাশ আদমীকে ধরে লিয়ে ঐ দূর ভাঙ্গা ঘর
মে ছোড়কে আতে
হ্যাঁয়...একেলা...মরনে কে লিয়ে। সব মর যাতা...সব। খানা নহি,আদমী নহি,পানি নেহি...কুছু না মিলে। বিসোয়াস না হোলে পুছে নিবেন...’ । চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে যায় রুক্মিণী।
এ কোন
ফাঁদে পা রাখল বিকাশ! দুরের
ভাঙ্গা ঘরগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। অন্ধকারের দিকে চেয়ে ঘরগুলোকে আরো দুরের মনে হয়। ধূ
ধূ প্রান্তর যেন আরো শূন্য...জনহীন।
আবছা অন্ধকারে দিকে চেয়ে নিঃসাড়ে বসে রইল বিকাশ...।