কবিতার
হিম
ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে
কান্তি ছিল আমার সব চেয়ে কাছের, হয়ত ঘনিষ্ঠতম । কোলকাতা ট্রাম
কোম্পানিতে কন্ডাক্টরির চাকরি করে কোনমতে বৃদ্ধ বাবা আর নিজের খরচ চালাত কান্তি
কিন্তু এই নিতান্ত সাধারণ পরিচয়ের বাইরে কোথাও লুকিয়ে ছিল তার এক কবিতা-পাগল
অস্তিত্ব । ট্রাম কোম্পানির কাজ আর
দুজনের সামান্য রান্না, এছাড়া কান্তির সময়
কাটত কবিতা লিখে আর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পাঠিয়ে। আমি ছিলাম তার কবিতার অনুরাগী
এবং সমালোচক । দু একটা লেখা অনামা পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পেলেও কান্তির বেশিরভাগ
কবিতাই অমনোনীত থেকে যেত । তবুও তার অস্বীকৃতি আমার মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারেনি আদৌ
। আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম তার কবিসত্ত্বার সম্বন্ধে । মনে হত নিশ্চিত একদিন কবি
হিসেবে স্বীকৃতি পাবে কান্তি ।
নানান উচ্চাশা থাকে মানুষের... অর্থ, সম্পত্তি, প্রতিপত্তি, সুন্দরী বৌ । কান্তির কোন উচ্চাশা ছিলনা । পলেস্তারা খসা নোনাধরা পুরনো বাড়ী আর ট্রাম কোম্পানির চাকরি নিয়ে
সন্তুষ্ট ছিল কান্তি । ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কেবল আমিই জানতাম তার গোপন আশার কথা ।
নামহীন সামান্য জীবনের ব্যর্থতা কান্তি ঢাকতে চেয়েছিল তার কবিতা দিয়ে ।
ভবানীপুরে কান্তিদের বাড়ীতে গেলে দেখতাম অন্ধকারাচ্ছন্ন দেড়-তলার
বারান্দার একচিলতে টিনে ঘেরা এলাকা । উত্তরদিকের সেই আশ্রয়টুকুতে কেবল দু ইঞ্চি
রোদ্দুরের আশায় পুরো শীতটা হাপিত্যেশ করে বসে থাকতেন কান্তির বাবা । খুব ফর্সা আর রোগা সত্তোরার্ধ এক বৃদ্ধ
। কোলকাতার শীতের সঙ্গে এক ভারি অসম যুদ্ধে তাঁর হাতের আঙুলগুলো শক্ত হয়ে বেঁকে
উঠত সময় সময় । আমায় দেখতে
পেলেও কোনদিন কুশল জিজ্ঞাসা করেননি । শুধু বিড়বিড় করে বলতেন,
বড় ঠান্ডা, তাই না ! যতক্ষণ থাকতাম
ততক্ষণই কান্তিদের আঁধারিয়া বাড়ী, নির্জন স্যাঁতসেঁতে
বারান্দার এককোণে বসে থাকা ওর বাবার অসম্ভব শীত কাতরতা এবং কান্তির অস্বীকৃত
কবিত্ব... সব মিলিয়ে একটা শিরশিরে ধারণার দিকে ঠেলে দিত আমাকে ।
ক্রমশঃ
আমার বাড়তে থাকা ব্যস্ততায় কান্তির সঙ্গে দেখা করার সময় কমে যাচ্ছিল । বুঝতে
পারতাম ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যাচ্ছে কান্তি । আমি ছাড়া আর কারো কাছেই সে মেলে ধরতে পারেনা নিজেকে। এরই মধ্যে
বিমর্ষ কান্তি এক আচ্ছন্ন শীতের দরজায় কড়া নেড়ে ডেকে তুলল আমায় । ভোরের কুয়াশার
হিম ঢুকে কান্তির গভীর চোখ দুটোকে অস্বচ্ছ করে রেখেছিল । তার গলার স্বর কেমন যেন
আকুল । এক ধরণের আত্মধিক্কার, আক্ষেপ আর বিলাপ
মেশান ছিল তার কথায়...
‘অনি রে, বড় অন্যায় হয়ে গেল । কী ঝোঁকে যে কাল বলে ফেললাম... বাবা, সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে ওই রোদটুকু আঁকড়ে আছেন, এবার একটু আমার কথা ভাবুন । আমারই বা কি আছে ! ট্রাম কোম্পানির চাকরি,
বৌ-ছেলেপুলে নেই । ঝুঁকে পড়ে মাথা রাখার মতো কোন কাঁধই নেই ।
নিজের বলতে দিনে দিনে অন্ধকার হয়ে আসা এই প্রায় ধ্বসে-পড়া বাড়ী । প্রতিদিন রাতের বেলা
কিংবা মিইয়ে আসা ছুটির দুপুরগুলোয় অদৃশ্য ঠাকুর্দা, বড়দাদা এবং আরো
অনেকের ফ্যাসফেসে গলার আওয়াজ শুনতে পাই । তাঁরা রোজ
বলেন... তোর বাবার কাছ থেকে চেয়ে নে ওই জায়গাটুকু । রোদ্দুর তো তোরও প্রয়োজন ! রোজ
রোজ ট্রামের ঘন্টির দড়ি টেনে ক্ষয়ে যাচ্ছিস । এই বাড়ীর ঠান্ডা আর সব প্রকাশ না
পাওয়া কবিতার হিম তোর ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে একটু একটু করে ।
বিশ্বাস কর অনি, আঘাত করতে চাইনি
শুধু আমার যন্ত্রণাগুলো শেয়ার করতে চাইছিলাম কিন্তু বাবার মুখটা হঠাৎ কেমন কাতর আর
ফ্যাকাসে হয়ে গেল । বললেন... আমার বাপ-ঠাকুর্দার কন্ঠ শুনেছো । হয়ত ঠিকই শুনেছো । সমাজের না পাওয়ার দলে
পড়ি আমরা,
বংশ পরম্পরায় এই রোদ্দুরটুকুই যা হস্তান্তর হয়ে এসেছে এতদিন । হয়ত ঠিকই বলেছেন ওঁরা ।
কথা বলতে বলতে আমার হাত চেপে ধরল কান্তি... অনি, যেতে পারবি আমার সঙ্গে? আজ শেষ রাতে দেখলাম
বিছানায় বাবা... একদম ঠান্ডা।
কান্তির বাবা মারা গেলেন আর তারপর থেকে কান্তিকে দেখেছি স্বেচ্ছায়
ওদের বাড়ীর সেই একচিলতে বারান্দা আঁকড়ে পড়ে থাকতে । আমার জ্যোতিষ্ক চমকাচ্ছিল ।
পদোন্নতি, বাড়ী গাড়ী, টাকা পয়সা
সবই বাড়ছিল সংখ্যায় এবং আয়তনে । কান্তির বসবাস ছিল তার নিজের জগতে । সময় আর
ব্যস্ততার চাপে দেখা হতনা তেমন তবে আমি গেলেই চঞ্চল হয়ে পড়ত কান্তি, বলত... আগে বুঝতাম না কিন্তু এখন টের পাই জানিস, এই বাড়ী আর আমার অসফল কবিতাগুলো কি ভীষণ ঠান্ডা ।
প্রচন্ড
ব্যস্ততায় প্রায় বছরখানেক দেখা হয়নি কান্তির সঙ্গে । কান্তি একলাই হোয়াটস আপ করত
মাঝে মাঝে । এক সকালে কান্তির মেসেজ
পেলাম । গোষ্ঠগোপাল দাসের বিখ্যাত গানের এক কলি... বন্ধু,
তুমি আসিও খবর পাইয়া । মন আকুলি বিকুলি করে উঠল । পরের রবিবারেই
গেলাম । একবছরে কিছুই বদলায়নি । বাড়ীটা সেই একই রকম নোনাধরা, স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা । পড়ন্ত বেলার একতিল রোদ্দুরের জন্য চেয়ার টেনে
লড়াই করছিল কান্তি আর ভারি অদ্ভুৎ, অপ্রাকৃত ভাবে
কান্তিকে দেখাচ্ছিল ঠিক তার বাবার মতো । চোখের নীচে পুঁটুলির মতো ফোলা আর দুটো
ভেতরে ঢোকা, চিপসানো গাল । হাতে হাত ঘষছিল কান্তি আর আঙুলগুলো
বেঁকে উঠছিল অবিকল তার বাবার মতো । বুঝলাম কান্তি খুবই অসুস্থ । আমাকে দেখে তার মুখে সেই পুরনো অমলিন
হাসি । বলল... মেসেজ পেয়ে এলি ? কাল অবধি চালিয়ে
নিচ্ছিলাম সব, আজ ভোরে মনে হল বোধহয় সময় হয়ে গ্যাছে ।
প্রিয়সঙ্গীকে হারানোর সম্ভাব্য বেদনা আমার চোখের জল ঠেলে তুলছিল
ওপরে । ফিসফিসে গলায় কান্তি বলল, আমার একটা কাজ
করে দিবি অনি ? কান্তি হাফাচ্ছিল, তার চোখদুটো আগের থেকে তীক্ষ্ণ অনেক । একই রকম স্বরে সে বলল, এখন আর কবিতা লিখিনা । এখন চোখের সামনে রোজ নিজের নিয়তিকে দেখি । শেষদিন অবধি আমাকে এই
বাড়ী আর বারান্দার সঙ্গে লড়াই করতে হবে ইঞ্চি ইঞ্চি রোদ্দুরের জন্য আর আমার
কবিতাগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে আরো ।
কান্তির
চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি । বলল, সব জেনেও কবিতাগুলোকে
প্রাণে ধরে নষ্ট করতে পারিনি । ওগুলো তুই রেখে দিবি তোর কাছে ? যেকটা দিন আছি ওগুলো থাক
তোর কাছে, তারপরে ফেলতে হলে ফেলবি, রাখতে হলে রেখে দিবি এক সামান্য বন্ধুর উপহার হিসেবে । কান্তির কথাগুলো
কখনো প্রলাপ,
কখনো রহস্যময় বলে মনে হচ্ছিল আমার । সারাজীবন ধরে কবিতা লিখে
স্বীকৃতি না পাওয়া, সামান্য আয়ে মনুষ্যেতর জীবন যাপন করতে
বাধ্য হওয়া, অপারগতা আর এক পুরনো বাড়ীর নোনাধরা দেওয়াল,
বারান্দার অন্ধকার কোণে জমে থাকা বহুযুগের হিম কি তার মাথার
সুক্ষ শিরা, তন্তুর মধ্যে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত করেছে
কোনভাবে !
এর
দুদিন পরে মারা গেল কান্তি । শেষকৃত্য সেরে বাড়ী ফিরতে কান্তির কবিতাগুলোর কথা মনে
হল, যেগুলো তার কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলাম সেদিন ।
স্নান সেরে, এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে খুললাম সেই
কবিতার তোড়া ।
বসন্তের হাওয়ায় ছোঁয়াচলাগা উষ্ণতা । কান্তির চলে যাওয়া যেন ভেতর
থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে আমায় । কবিতাগুলো পড়তে পড়তে অনেকদিনের জানা,
পুরনো হয়ে যাওয়া একটা সাধারণ প্রশ্ন ধাক্কা দিচ্ছিল আমার মনে... কবিতা কি
বরাবরই মানুষকে এমন পাগল, অহেতুক করে দেয়! ছাড়াও
যায়না আবার ধরে থাকাও যায়না !
চা শেষ । ব্যালকনির থেকে বয়ে আসা হাওয়া যেন শোক ভোলানোর প্রলেপ
দিচ্ছিল আমার শরীরে, হঠাৎই মনে হল এক অচেনা
হিম স্রোত যেন কবিতার পান্ডুলিপি থেকে বেরিয়ে আমার হাত বেয়ে কাঁধ, কাঁধ বেয়ে গলা আর বুকে ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ ।