গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮

সুবীর কুমার রায়

নকশাল আন্দোলন ও নকুড়মামা

সাতের দশকের প্রায় প্রথম দিক থেকেই শুরু হয়ে গেল এক নতুন বিপদ, বিশেষ করে যুবকদের বিপদ। নকশাল আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে, শুধু খুন জখমের খবরে পাতা ভরা থাকতো। সর্বত্র বোমার আওয়াজ, গোলাগুলি আর পুলিশের ঝামেলা লেগেই থাকতো। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা সহনীয় ছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছেলেরা এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লো। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা, যাদের আমরা চিরকাল অন্য চোখে দেখে আসতে অভ্যস্ত, তাদের অনেকেই এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে যোগ দিল। তারা অবশ্য একটা আদর্শ, একটা নীতি নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। সাধারণ জনগন তাদের এই আদর্শকে সমর্থনও করেছিল। কিন্তু এখন যেমন ঠাকুর দেবতা, রাজনীতি বা হাত দেখা, কিছু মানুষের জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সময়ও বেশ কিছু অশিক্ষিত, সমাজের অপাংক্তেও ছেলে এই আন্দোলনকে তাদের জীবিকা হিসাবে গ্রহন করে, নিজেদের নকশাল হিসাবে পরিচিত করেছিল। পাড়ায় পাড়ায় মস্তানি, লুঠতরাজ ও অত্যাচার ছিল তাদের এই রাজনীতি নামক জীবিকার অঙ্গ। এরা পাড়ার লাইট পোস্টের বাল্ব ভেঙ্গে, পাড়ার রাস্তাঘাট অন্ধকার করে রাখতো। এর গাছের ডাব, তার বাগানের সবজি জোর করে নিয়ে যেত। ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতে সাহস করতো না। আর এটাই ছিল তাদের মূলধন। আমাদের পাড়ায় একটা ছেলে ছিল, যার কাজ ছিল রাস্তার লাইট পোস্টের বাল্ব ভেঙ্গে দেওয়া। এই কাজের জন্য সে পয়সাও পেত। সেও নিজেকে নকশালপন্থী বলে পরিচয় দিত, এবং ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক, অনেকেই তাকে একজন বিশিষ্ট নকশাল নেতা বলে সমীহও করতো। হায় রে চারু মজুমদার, কানু স্যান্যাল, তোমরা শিব গড়তে গিয়ে এ কী তৈরি করলে?
অবশেষে সি.আর.পি. ও পুলিশের ধরপাকড়ের ঠেলায় যখন সব নকশালপন্থীরা পালিয়ে পালিয়ে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, তখন একদিন আমার নকুড়মামা, াকে আমরা নকুমামু বলে ডাকি, আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো। দিদির থেকে বছর খানেকের বড় এই নকুমামু ছিল একটু কমবুদ্ধি সম্পন্ন খ্যাপাটে গোছের। এর কথা লিখতে গেলে রামায়ণ হয়ে যাবে। নকুমামু দিদার খুব আদরের সন্তান ছিল। অনেক চেষ্টা করেও বেচারা ম্যাট্রিক পাশ করতে পারে নি, করার কথাও নয়। তবু এই নকুমামু সম্বন্ধে কিছু বলতেই হবে, তা নাহলে নকশালদের সম্বন্ধে ধ্যান ধারণাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। চোখে খুবই কম দেখে, কথা বলতে গেলে আটকে যায়, যাকে আমরা তোতলা বলি আর কী, সারা শরীরে ছুলি, পৃথিবীর কোন বিষয়ের কোন খবর রাখে না, পড়াশোনার দৌড় তো আগেই বলেছি। নকুমামু ও সুকুমার রায় সৃষ্ট গঙ্গারামের মধ্যে কে বেশি মেধাবী, তা নিয়ে মতবিরোধ থাকতেই পারে। যাহোক্, এ হেন নকুমামুও নকশালপন্থী ছিল। যদিও নকশালবাড়ি কোথায়, নকশালদের বক্তব্য বা নীতি কী, সে জানতো না। সে শুধু এটা জানতো— “চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যানযদিও চীন দেশটা ঠিক কোথায় এবং তার চেয়ারম্যান-ই বা কে, সে সম্বন্ধে তার স্বচ্ছ ধারণার অভাব ছিল। তার পিছনে এই নিয়ে আমরা খুব লাগতাম।
একবার আমি আর আমার ছোট ভাই মামার বাড়ি গেছি। দাদু-দিদা যে ঘরে থাকতেন, তার পাশের ঘরে দুপাশের দুটো চৌকির একটায় আমি ও ভাই রাতে শুয়েছি, অপরটায় নকুমামু। একটু আগেই নকুমামুর সাথে মাও সে তুংকে নিয়ে কথা হয়েছে। আমি ভাইকে ম্যাও ম্যাও করে বেড়ালের মতো ডাকতে বললাম। আমার কথা মতো ভাই কয়েকবার ম্যাও ম্যাও করতেই, নকুমামু একটানে মশারির দড়ি ছিঁড়ে বিছানা থেকে উঠে এসে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, খোকা, খুব সাবধান। এসব নিয়ে ইয়ার্কি ঠাট্টা করবি না। আমি কিন্তু মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক বুঝি না। খুন করে করে আমার হাত পেকে গেছে। আমি বুঝি স্রেফ শেষ করে যাও। এমন ভাবে সে কথাগুলো বললো, যেন আগে সে অনেককে শেষ করেছে। প্রিয় পুত্রের চিৎকার শুনে দিদা পাশের ঘর থেকে বলতে শুরু করলেন— “ও যেটা বিশ্বাস করে তা নিয়ে তোরা কেন কথা বলছিস? অনেক রাত হয়েছে এবার ওকে ঘুমতে দে। তোরাও ঘুমো 
মেজমামা একটি বিদেশি কোম্পানিতে উচ্চ পদে কাজ করতেন এবং তাঁর চেষ্টায় নকুমামুও এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায়। ছেলে ভালো চাকরি করে, বয়স হয়েছে, লেখাপড়া হয়তো খুব একটা করেনি, কিন্তু পাত্র হিসাবে খারাপ কোথায়? সোনার আংটি আবার বাঁকা, আর তাই নকুমামুর বিয়ে নিয়ে দিদা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিয়ে ঠিকও হলোদিদা খুশি, নকুমামুও খুশি, বাকি সবাই চিন্তিত। সব বিয়েতেই পাত্রের সাথে কেউ না কেউ বিয়ে বাড়িতে রাতে থাকে। সঙ্গ দেওয়া এবং নানারকম ঝুটঝামেলা, মানে ব্যাগিং থেকে পাত্রকে রক্ষা করার জন্যই রাতে থাকা। সাধারণত বন্ধুবান্ধব, সমবয়সি ভগ্নিপতি, বা ঐ জাতীয় কেউ পাত্রের সাথে রাতে থাকে। কিন্তু নকুমামুর সাথে থাকার মতো কোন বন্ধু না থাকায়, বা আর কেউ সেরকম যোগ্য বিবেচিত না হওয়াতেই বোধহয়, এই বিপজ্জনক, দুঃসাহসিক, দুর্লভ কাজটার ভার এই হতভাগ্যের ওপর বর্তালো। নিজেকে কিরকম ব্ল্যাক ক্যাট, ব্ল্যাক ক্যাট মনে হওয়া সত্ত্বেও এই জাতীয় জেড প্লাস ক্যাটাগরির ভি.ভি.আই.পি.-র সাথে রাতে একা থাকতে সাহস হলো না। শেষ পর্যন্ত অনিলদাকে অনেক বুঝিয়ে, আমার হেল্পার কাম সচিব হিসাবে সঙ্গে থাকতে রাজি করালাম।
বিয়েবাড়িতে হইচই, খাওয়া দাওয়া চলছে। নকুমামু বরাসনে প্রচন্ড গাম্ভীর্য নিয়ে বসে, পাশে আমি ব্ল্যাক ক্যাটের মতো চারিদিকে তীব্র নজর দিয়ে প্রহরারত। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে হিটলারের পরে আর বোধহয় কেউ নকুমামুর মতো এত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে নি। মাঝেমাঝেই কন্যাপক্ষের লোকজন আমাকে খেয়ে নেবার জন্য অনুরোধ করছে। ইচ্ছা থাকলেও যাবার উপায় নেই।
এরমধ্যে এক ভদ্রলোক এসে হাত জোড় করে নকুমামুকে বললেন, নমস্কার, আমি সম্পর্কে আপনার মামাশ্বশুর হইনকুমামু তার ব্যক্তিত্বের রেগুলেটারের নব্ দু-তিন ঘর বাড়িয়ে গম্ভীর ভাবে ঘোষণা করলো, দুঃখিত, আমি কিন্তু আপনাকে প্রণাম করতে পারছি না। ভদ্রলোক নরম গলায় বললেন, আরে না না, তার দরকার নেই, তবে আমি কিন্তু বয়সে ও সম্মানে আপনার থেকে বড়। আপনার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছি, তাই আলাপ করতে এলামনকুমামু আরও গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞাসা করলো, আমার সম্বন্ধে আপনাকে কে কী বলেছে? কথাবার্তায় পরিবেশ ক্রমশঃ জটিল  হচ্ছে দেখে, আমি প্রসঙ্গ বদলে অবস্থার সামাল দিলাম।
একসময় বিয়ে শুরু হলো। পুরোহিত নকুমামুকে তার সাথে মন্ত্র পাঠ করতে বললে, নকুমামু গম্ভীর হয়ে মন্ত্রের মানে জানতে চাইছে এবং কখনও কখনও তার মূল্যবান মতামতও ব্যক্ত করছে। এভাবে একসময় বিয়ে শেষ হলো। বরযাত্রীরা সবাই ফিরে গেল। আমি আর অনিলদা পবিত্র কর্তব্য পালন করার জন্য বিয়ে বাড়িতে থেকে গেলাম। এবার শুরু হলো স্ত্রী আচার। একটা ছোট ঘরে রাজ্যের মেয়েরা নকুমামুকে ঘিরে ভিড় করে আছে। এই ভয়ঙ্কর সময়টাকে সামলানোর জন্যই আমাদের এখানে থাকা, অথচ অনিলদা সুযোগ বুঝে কোথায় কেটে পড়েছে। একঘর মেয়েদের মধ্যে বর ছাড়া আমি একমাত্র পুরুষ। মেয়েরা বোধহয় আমার এ ঘরে থাকার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বার বার বলছে, মেয়েদের মধ্যে তুমি কী করছো? যাও, গিয়ে খেয়ে নাও। আমি আর কী করি, বাধ্য হয়ে বললাম, নকুমামুর সাথে একসঙ্গে খেতে যাবমেয়েরা জানালো আজ মামা-মামিকে আলাদা করে খেতে দেওয়া হবে, কাজেই আমি যেন খেতে চলে যাই। আমি নকুমামুর ঠিক পিছনটায় দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় নকুমামুর শাশুড়ি একটা কাচের গ্লাশে করে দুধ নিয়ে এই ঘরে এসে, নকুমামুকে তাঁর কোলে বসতে বললেন। নকুমামু কিছুতেই তাঁর কোলে বসতে রাজি নয়।
আসলে ওদের বাড়ির প্রথা, শাশুড়ি বাবু হয়ে বসে, দুই কোলে মেয়ে ও জামাইকে বসিয়ে এক গ্লাশ দুধ দুজনকে খাওয়াবেন। আমি ব্যাপারটা বুঝে নকুমামুকে কোলে বসতে বললাম। আমি এটা বুঝেছিলাম, যে শাশুড়ি কখনও জামাইকে নিয়ে ইয়ার্কি ঠাট্টা করবেন না। নকুমামুকে আমার নির্দেশ দেওয়াই ছিল, যে আমি না বললে সে যেন কোন কিছু না খায় বা করে। এটা তো সত্যি, যে যুদ্ধ ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে সমস্ত কিছুই ন্যায্য ও নির্দোষ। তাই এরকম একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্রে, তাও আবার ভিনদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমায় একটা অন্যায় কাজ নির্দোষ হিসাবেই মেনে নিতে হলো। সবার অলক্ষ্যে ঝুঁকে পড়ে হাত দিয়ে ইশারা করায় অসুবিধা থাকায়, পিছন থেকে প্রায় বারো বছরের বড় নকুমামুকে সবার অলক্ষে পা দিয়ে মৃদু আঘাত করলাম, কিন্তু ও বুঝলো না। বাধ্য হয়ে তখন বলতেই হলো, নকুমামু, উনি যা বলছেন করমস্ত মেয়েরা হইচই করে উঠলো তুমি এ ঘর থেকে যাও তো বাছা। ছোটদের এ ঘরে থাকতে নেইআমি আবার বললাম, নকুমামু উনি যা বলছেন করোগ্রীন সিগনাল পেয়ে নকুমামু উৎসাহিত হয়ে প্রায় লাফ দিয়ে তার শাশুড়ির কোলে বসে পড়ে দুধের গ্লাশটা নিয়ে চোঁ চোঁ করে দুধ খেতে শুরু করলো। শাশুড়ির অপর কোলে তাঁর মেয়ে, অর্থাৎ আমাদের নকুমামি বসে ওই গ্লাশের অর্ধেক দুধ, যাকে নকুমামুর প্রসাদ বলা যেতে পারে, খাওয়ার অপেক্ষায়। বিপদ বুঝে আমি পিছন থেকে আবার কয়েকবার মৃদু পা চালিয়ে নকুমামুকে দুগ্ধ পান থেকে যখন বিরত করতে সমর্থ হলাম, তখন গ্লাশের নীচে, সামান্যই অমৃত পড়ে আছে। প্রথা মাফিক নকুমামি সেইটুকু দুধ পান করে ধন্য হলো। একসময় জানা গেল, বর-কনেকে ঘরে খেতে দেওয়া হবে। রাতও অনেক হয়েছে, তাই আমিও খেতে গেলাম। আগেই লক্ষ্য করেছি, কাপ আইসক্রীম হয়েছে। যাবার আগে নকুমামুকে বার বার সাবধান করে গেলাম, সে যেন আইসক্রীম কাপের ঢাকনাটা না চাটে। আমি জানি পাতলা কাগজের ঢাকনা খুললে তাতে আইসক্রীম লেগে থাকবেই, এবং নকুমামু অবশ্যই সবার সামনে সেটা চেটে খাবে। যাহোক, বরযাত্রী হিসাবে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে, কপাল দোষে শেষ পাতে ঠান্ডা খাবার খেয়ে এসে দেখলাম, ওদের খাওয়াও শেষ। ওদের বাড়ির রীতি অনুযায়ী, দুজনকে এক ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। এতক্ষণে আমার মুক্তি, আর এতক্ষণে আমি একটা ঘরে শুতে গিয়ে আমার অ্যাসিস্টেন্ট, অনিলদার দর্শণ পেলাম। 
এই নকুমামুর ধারণা ছিল যে, সে খুব বড় নকশাল নেতা। যদিও তার সম্পর্কে সকলেই জানতো। তার বৌভাতে সম্ভবত তার কোন বন্ধু, ইয়ার্কি করে কিছু বই উপহার দিয়েছিল। রাতে নকুমামু তো সেই বই নিয়ে মহা হৈচৈ শুরু করে দিল। ক্রমে ক্রমে শোনা গেল তার কোন বন্ধু তাকে বিয়েতে রেড বুকউপহার দিয়েছে, সেগুলোকে সাবধানে যত্ন করে রাখতে হবে। তখন এই রেড বুক নিয়ে সবাই খুব মাতামাতি করতো, বিশেষ করে যারা নিজেদের নকশালপন্থী বলে প্রচার করে গর্ববোধ করতো। কিন্তু রেড বুক জিনিসটা কী, খায় না মাথায় দেয়, খুব কম লোকই জানতো। রেড বুকের থেকে হলুদ বই এর কদর ও পাঠক অনেক, অনেক গুণ ছিল। দিদার হাবভাবে মনে হলো, ছেলের রাজনৈতিক উথ্বান দেখে তিনিও খুব গর্বিত। রেড বুকের মাহাত্মে, ফুল শয্যা কন্টক শয্যায় পরিণত হলো। পরদিন সকালেও এই রেড বুক নিয়ে সারা বাড়ি তুলকালাম হবার পর দেখা গেল, সেগুলো কতগুলো চীনা ম্যাগাজিন। আমাদের এখানে যেমন সিনেমা, স্বাস্থ্য, রান্নাবান্না, বা মেয়েদের সাজগোজ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা রাস্তাঘাটে, স্টল, বা ফুটপাথে দেখা যায়। সম্ভবত কোন ফুটপাথ বা স্টল থেকে সংগ্রহ করে তাকে তার কোন বন্ধু উপহার দিয়ে গেছে। তবে বইগুলোতে কী লেখা আছে, জানতে গেলে নকুমামুকে হয় কোন চীনাম্যানের কাছে যেতে হবে, তা নাহলে সটান চীন এ যেতে হবে, কারণ আদ্যপ্রান্ত চীনা ভাষায় লেখা।
যাহোক্, যেকথা বলতে গিয়ে এত কথা এসে গেল, এহেন নকুমামু হঠাৎ আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর, বাইরে আড্ডা মারতে যাবার আগে নকুমামুকে নিয়ে একটু মজা করার ইচ্ছা হলো। বাবাকে কে একজন একটা চামড়ার খাপে ভরা ইঞ্চি সাত-আট লম্বা, একটা মজবুত ছুরি দিয়েছিল। বাইরে যাবার আগে নকুমামুকে দেখিয়ে ছুরিটা প্যান্টের ভিতর গুঁজে বললাম, তুমি গল্প কর, আমি একটু ঘুরে আসছিনকুমামু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ওটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? বললাম, কাছাকাছি যাব, চেম্বার নিয়ে যাবার দরকার নেই, এটাই যথেষ্টনকুমামু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে ভাবলো আমি খুব বড়সড় একজন নকশাল নেতা। আড়ালে গিয়ে ছুরিটাকে বার করে রেখে আমি আড্ডা মারতে চলে গেলাম। 
দুপুরে ফিরে এসে শুনি আর এক কান্ড। নকুমামু কার একটা নাম বলে মাকে জিজ্ঞাসা করছে যে সে কোথায় থাকে, তার সাথে একবার দেখা করতে যাবে। মা তো মহা বিপদে পড়েছেন। এর আগে একবার বরাহনগর এলাকায় কী সব উলটোপালটা বকে সে বেধরক মার খেয়েছিল। মেজমামা অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায়, তাকে চরম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। শেষে মা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে শান্ত করে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত করলেন।
নকুমামু বাবাকে খুব ভয় পেত। সে আর আমার দিদি বোধহয় বছর খানেকের ছোট বড়। ফলে ছোটবেলায় বোধহয় কখনও সখনও সে মার বুকের দুধ খেয়েছে, এবং সেটা বোধহয় দিদা বা মার কাছ থেকে শুনেছে। ফলে একটু উত্তেজিত হলেই আমাদের বলতো, তোদের মা আমার মার মতো। তার দুধ খেয়ে আমি বড় হয়েছি। যার রক্ত পান করেছি, তার ছেলেদের কিছু বলতে পারি না। বুকের দুধ কী ভাবে রক্তের আকার নিল, সেটা সেই বলতে পারবে। কিন্তু একথা সত্যি, যে তার রক্ত পানের দৌলতে আমরা তার হাত থেকে প্রাণে বেঁচেছি। যাহোক্, বাবা নকুমামুকে এটা সেটা বলতে বলতে হঠাৎ বললেন, আমি একবার টেগার্টকে হাতের মুঠোয় পেয়েও মারতে পারি নি, সে কোনরকমে পালিয়ে বেঁচেছিলটেগার্ট যে কে, নকুমামুর জানার কথা নয়, কিন্তু সে আরও অবাক, কারণ একই বাড়িতে এতগুলো জলজ্যান্ত বিপ্লবীর কথা সে ভাবতেও পারে না। আমি হঠাৎ কথার মাঝে বলে বসলাম, তুমি টেগার্টকে গাঁড়াসা দিয়ে যেবার মারতে গিয়েছিলে, সেই ঘটনাটার কথা বলছ? আমার কথা শুনে বাবা এমন হেসে ফেললেন, যে ব্যাপারটা লঘু হয়ে গেল। বাবা হাসতে হাসতে বললেন, তুই আর কোন অস্ত্র খুঁজে পেলি না, একবারে গাঁড়াসা? এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমাদের একটা অস্ত্র ছিল, বাবা-ই তৈরি করিয়েছিলেন, কাঠের হ্যান্ডেলে লোহার ধারলো একটা মোটা প্লেট বা ব্লেড লাগানো। সেটাকে কেন গাঁড়াসা বলা হতো জানি না, তবে সেটা দিয়ে গরুর খড় কাটা হতো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে নকুমামুকে বললাম, আমরা যতই নকশালী করি না কেন, এই মতবাদ দেশকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মাও সে তুং চীনের সর্বনাশ করে ছেড়েছে। মাও সে তুং খারাপ করেছে, একথা মাও সে তুং স্বয়ং স্বীকার করলেও করতে পারেন, কিন্তু নকুমামু কিছুতেই মানতে রাজি নয়। আমি বললাম, জেন ইয়াচিং এর লাষ্ট ডেজ অফ্ চায়নাপড়ে দেখ। অরিজিনাল বইটা না পেলে অনুবাদটা অন্তত পড়ে দেখ। তাতে পরিস্কার বলা আছে, মাও সে তুং কী ভাবে দেশের ক্ষতি করেছে। তুমি রুবেল ভদোভস্কির রাশিয়া মাই রাশিয়াপড়েছো? না পড়ে থাকলে পড়ে দেখ। অরিজিনাল না পাও অনুবাদ পড়ে দেখ, তাতে লেনিন সম্বন্ধে কী বলেছে। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ লেনিন কী ভাবে নিজ হাতে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে জানতে পারবে। এমন ভাবে কথাগুলো বললাম, যেন আমি সত্যিই ঐ সব লেখকের ঐ সব বইয়ের অরিজিনাল কপি পড়েছি। লেখকও কাল্পনিক, বই এর নামগুলোও কাল্পনিকবাস্তব, নকুমামু আমার পাণ্ডিত্য দেখে অবাক। দেশ-বিদেশের এত অরিজিনাল বই পড়া ভগৎ সিং বা চন্দ্রশেখর আজাদের মতো একটা ভাগ্নে পেয়ে সে গর্বিত। নকুমামু অত্যন্ত বিনয়ী, তাই একবারও সেই আপ্ত বাক্য স্মরণ করলো না— “নরনাং মাতুলক্রম