গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮

আফরোজা অদিতি

বন্যা আর একজন সখিনার মা  


  খুব বৃষ্টি; যাকে বলে ক্যাটস অ্যান্ড ডগআকাশে ভেঙে নেমেছে যেন, একটানা ঝরছে তো ঝরছেই। কোন কমতি নেই। একে বন্যা আবার বৃষ্টি; মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। খলবলানো জল চারদিকে। রাস্তার ওপর দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে দ্রুত নামছে জল। পাশের পুকুর উপচে নামছে, এতো দ্রুত জল নামছে যে রাস্তা পার হতে পারছে না মানুষ। খুব অসুবিধা হচ্ছে তবুও চলতে হচ্ছে মানুষকে; পা টিপে টিপে চলছে তারা। একটু অন্যমনস্ক হলেই পা হড়কানোর সম্ভাবনা; আর একবার পা হড়কালেই জলের তোড়ে কোথায় ভেসে যাবে বলতে পারে না কেউ। রাস্তার ওপারে নিচু এলাকার সব বাড়িঘরে থৈথৈ করছে জল। এখনও সবটুকু তলিয়ে যায়নি তবে বাঁকিও নেই। আর একটু বাড়লেই জলের তলে যাবে সব বাড়ির টিনের চাল।   

   এপাশে ভিটে উঁচু করে বানানো কয়েকটি ঘরে কোমর সমান জল। ঘরে মাচা বেঁধে আছে কেউ কেউ; কেউ কেউ ঘর ছেড়ে উঠেছে আশ্রয়কেন্দ্রে। স্কুল কলেজ বন্ধ দিয়ে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। সেই কেন্দ্রে মানুষের সঙ্গে আশ্রয় পেয়েছে হাঁস,মুরগী গরু, ছাগল। এতো আশ্রয়হীন মানুষ সঙ্গে গবাদী পশু; 'ান সংকুলান হচ্ছে না। মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় পাওয়া বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষগুলোকে। 

    এই বন্যাদুর্গত এলাকাতেই থাকে মা-বাবার সঙ্গে সখিনা। তিন বছরের ফুটফুটে এক শিশু সখিনা। খুব শান্ত, গোবেচারা; যেখানে বসিয়ে রাখা যায় সেখানেই বসে থাকে সখিনা, আবার দাঁড়িয়ে থাকতে দাঁড়িয়েই থাকবে! না বলা পর্যন্ত কোন নড়াচড়া করবে না মেয়েটি। সখিনার বাবা, জমির মিয়া দিন-হাজিরার কাজ করে। গ্রামে কাজ না থাকায় এবং বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় বন্যা আসার কয়েকদিন আগেই ঢাকা গিয়েছে সখিনার বাবা, জমির মিয়া। কাজ আর কি; শহরে গিয়ে রিকশা চালানো কিংবা অন্য কোন কাজ করা। গ্রামে থেকে তিনজনের সংসারের চাকা সচল রাখতে পারছিল না জমির মিয়া। শিশু সখিনার জন্য খরচ একটু বেশিই করতে হয়। সেটা করে উঠতে পারছিল না জমির মিয়া। তাই শহরে যাওয়া। যখন শহরে যেতে না করলো তার স্ত্রী তখন নিরুপায় জমির মিয়া বলে, ‘এখানে থাইক্কা কী করুম ক’, তার চায়া ঢাহা যাই; রিকশা চালান যায় নাকি দেহি।সখিনার মা বলে, ‘কয়েকদিন পর যায়েন নাহয়। এহনও তো খাবার আছে ঘরে। ঘরে জমানো ট্যাহাও আছে কিছু, কোনমতে চইলা যাইব। 

   কিন' সখিনার মায়ের কথা শোনেনি জমির মিয়া। চলে গেছে ঢাকা আর ঢাকা যাওয়ার সাতদিনের মাথায় রাতে হুহু বন্যার জলে সয়লাব হলো গ্রাম। আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি সখিনার মা। সখিনাকে নিয়ে রয়ে গেছে বাড়িতেই। না যাওয়ার কারণ এখান থেকে চলে গেলে সখিনার বাপ এসে খুঁজে না পায়, হয়রান হবে মানুষটা। মানুষটাকে হয়রানিতে ফেলতে চায়নি সখিনার মা। ঘরের মধ্যে চৌকির ওপর রান্নাবান্নার সরঞ্জাম একপাশে রেখে অন্যপাশে থাকতো মা-ঝিয়ে। বন্যা ভাসছে সাতদিন হলো। আজ দুইদিন রান্নাও করেনি; চাল কিনতে যেতে পারেনি। সখিনার গায়ে জ্বর। ওকে রেখে যেতে পারছে না। ওষুধ নেই, নেই পথ্য। জোগাড় করতে পারছে না। ওর বাড়ির পাশের ঘরে থাকে রফিজউদ্দিন আর ওর মা। সখিনার মা থাকতে দিয়েছে ওদের। থাকার বিনিময়ে টাকা দিচ্ছে। গতকাল ঐ রফিউদ্দিনের মায়ের কাছ থেকে ধার করে এনেছে এক পোয়া চাল। তাই রান্না করে মেয়েকে খাইয়েছে, নিজেও খেয়েছে আর মেয়ের জন্য রেখে দিয়েছে একমুঠ। 

   সখিনার বাবার কথা মনে পড়ছে। ঈশ্বরকে ডাকছে শুধু। এই বিপদের সময় তাকে পাঠিয়ে দিতে।  মোবাইলও নেই যে মোবাইল করে খবর দিবে। ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়েছে রাতে। হঠাৎ জলের স্পর্শে ভেঙে যায় ঘুম। এতো জল; জল উঠেছে চৌকির ওপরে; থৈথৈ করছে আর পাশে নেই সখিনা। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সখিনার মা। ওর কান্নার শব্দে ছুটে আসে রহিম, করিম, মমিন, হাসুর মা, রফিজউদ্দিনের মা। সমস্বরে ওরা বলে, ‘কী হইছে, কী হইছে?’ সখিনার মা কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘সখিনা নাই, ভাইসা গেছে।ওরাও খুব অবাক; এতো তাড়াতাড়ি জল বেড়ে যাবে কল্পনা করেনি ওরা। জল কম দেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি ওরা। এখন আর এখানে থাকা যাবে না; যেতেই হবে। 

    সকলে মিলে সখিনাকে খুঁজতে থাকে; খুব ভালোবাসে ছোট এই মেয়েটিকে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় হাসুর মায়ের ঘরের পৈঠার ওপর। চেতনাহীন। বুকে কান পেতে সখিনার বুকের ধুকধুকানি শুনতে চায় সখিনার মা। প্রাণ আছে; বেঁচে আছে মেয়েটি। সখিনাকে হেলথ কেয়ার সেন্টারে নিয়ে যায় ওরা। সখিনার মা মেয়ের সঙ্গে হেলথ কেয়ার সেন্টারে রয়ে যায়। আর সকলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেআশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা নেই। ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে বসে থাকে সারারাত। বৃষ্টি ধরে এসেছে।

   সখিনাকে স্যালাইন দিয়ে রেখেছে। চেতনা ফিরেনি এখনও। গায়ে খুব জ্বর। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। বাবাকে ডাকছে বারবার। সখিনার মা বারবার চোখ মুছছে। দুর্ভাবনা ঘিরে ধরেছে ওকে। জমির মিয়া কবে ফিরবে? বন্যার খবর কি জমির মিয়ার কাছে পৌঁছায়নি? কেন আসছে না সে? এমনতর নানা ভাবনাতে অসি'র সখিনার মায়ের মনে উঁকি দিয়ে যায় বাড়ি আসলে তো পাবে না ওদের। কোথায় খুঁজবে ওদের: তাছাড়া বাড়িটা যদি তলিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে! তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে আশ্রয়কেন্দ্রে এলে ওদের খবর পাবে জমির মিয়া। ওখানে তো সকলে আছে। আগে এই কথা মনে হয়নি তাহলে আরও আগেই এই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসতো। ওদিকে হেলথ কেয়ারে মারা গেছে দুটি শিশু। আরও কয়েকজনের অবস্থা বেশি ভালো নয়! সখিনার জন্য চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে ওর মন। ধকধক করছে বুকের ভেতর। সখিনার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খায় মা। সকাল হয়েছে। ওপাশে রিলিফ দিচ্ছে। সাখিনাকে রেখে যেতেও পারছে না মা। হাতে টাকাকড়ি কিছু নেই। জমানো টাকা ছিল বাক্সে তা আছে না ভেসে গেছে জানেও না সখিনার মা। 

   রফিজউদ্দিনের মা, হাসুর মা দিয়েছে কয়দিন কিন' কতোদিন! রফিজউদ্দিনের বাপ চার ছেলেমেয়ে রেখে আর একটা বিয়ে করে চলে গেছে কোথায় তা জানে না রফিজউদ্দিনের মা। হয়তো বা ঢাকাতেই আছে। সখিনার মায়ের মন খারাপ হয় জমির মিয়ার জন্য; মনে হয় ওর স্বামীও যদি আর একটা বিয়ে করে তাহলে। মানুষের মন, মানুষের শরীর। সখিনার মা উদাস তাকিয়ে থাকে। এমন সময় নার্স এসে বলে, সখিনার মা ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে ওকে। এখানে এর বেশি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সখিনার মা কেঁদে ফেলে, ‘আমি তো ঢাহা চিনি না আফা। ওর বাপও নাইকা এহানে। কী করুম।নার্স বলে, ‘আপনি আশ্রয়কেন্দ্রে যান লোক পেয়ে যাবেন। আমি তো এখানে থেকে কিছু করতে পারবো না বাবা।সখিনার মায়ের চোখে মুখে ব্যাকুলতা ফুটে ওঠে। বলে, ‘নার্স আপা গো, এহন রাইত কারে পামু কন তো। কাল গেলে কী অসুবিধা হইবো।নার্সটি খুবই ব্যস্ত। অনেকগুলো মানুষের দেখভাল করা ওদের সামলাতে হচ্ছে। ব্যস্ততার সঙ্গে বলে, ‘আজ রাতেই যা করবার করতে হবে। নাহলে...

   সখিনার মায়ের বয়স কম। চার ভাইবোনের মধ্যে ওই বড়। বাবা মা তাদের খরচ কমাতে বারো বছর হতে না হতে সখিনার বিয়ে দিয়েছিল। এখন আঠারো। দেখতে সুন্দরী। সখিনার মা মেয়েকে পাশের এক মহিলার জিম্মায় রেখে আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে পা বাড়ায়। রাতের বেলা বুঝে উঠতে পারছে না কোনদিকে পথসখিনার মা হাঁটছে। হঠাৎ সামনে দুটো লোক দেখে চমকে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘আশ্রয়কেন্দ্র কোনদিকে ভাই।’ ‘আাস আমাগো লগে।সখিনার মা পরম বিশ্বাসে হাঁটতে থাকে ওদের পিছে। একটাই লক্ষ্য আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে পরিচিত জনের দেখা পাবে। ওদের সাহায্য নিয়ে ঢাকা যেতে পারবে। ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করে বাঁচাতে পারবে মেয়েকে। কিন্ত পথ তো ফুরায় না। আর কতোদূর যাইতে হইবো ভাই। আমার মাইয়াডা একলা আছে।ওরা কথা বলে না। হঠাৎ লোকদুটো পেছন ফেরে তারপর সখিনার মাকে জাপটে ধরে হাত পা বেঁধে নৌকায় তোলে। ওকে যে নদীর ধারে এনেছে অন্ধকারে তা বুঝতেই পারেনি। এখন জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই ওর। রাতভর ঐ নৌকাতে পাশবিক নির্যাতন সহ্য করে সখিনার মা। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নদীর পাড়ে আবিষ্কার করে নিজেকে। হাঁটতে পারে না। সব শক্তি নিঃশেষ।  ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। নতুন একটি দিনের সূচনা হচ্ছে। কিন' সখিনার মা জানে না ওর  জন্য কী সংবাদ অপেক্ষা করছে!