গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১৮

সুবীর কুমার রায়

তাল ফল টক
(স্মৃতির পাতা থেকে)

কলেজে পড়ার সময় ব্যাতড়ে দীপুদার দোকানে বা অজিতের চায়ের দোকানে আড্ডাটা বেশ ভালোই চলছিল। রেল লাইনের পাশ দিয়ে একটা  ভাঙাচোরা পাকা রাস্তা ছিল। এখন সেটা আরও ভাঙ্গা ও অবহলিত, কারণ ওই রাস্তা এখন আর ব্যবহৃত হয় না। পাশ দিয়ে এখন কোনা এক্সপ্রেস হাইওয়ে বয়ে গেছে। ওই আধভাঙা রাস্তার ধারে একটা কালভার্টের ওপর সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চির মতো ছিল। সেটার ওপর বসেও আমরা আড্ডা মারতাম। শীতের সন্ধ্যায় একদিন ওই বেঞ্চে বসে আছি। শীতকাল, সবাই সিগারেট ধরাবার জন্য ব্যস্ত, কিন্তু কারো কাছেই দেশলাই নেই। এমন সময়, বিড়ি বা সিগারেট টানতে টানতে চাদরমুড়ি দিয়ে একজনকে আসতে দেখা গেলে, রাঘব উঠে গিয়ে বললো, দাদা একটু আগুনটা দেবেন? সঙ্গে সঙ্গে লোকটা সপাটে রাঘবকে একটা চড় কষিয়ে দিল। রাঘব, মাধবের আত্মীয় ও একটু দাদা দাদা গোছের ছেল, ব্যাতড়েই থাকে। আমাদের থেকে বয়সে সামান্যই ছোট। অমন একটা সুস্বাদু পুষ্টিকর চড় খেয়েও রাঘব লোকটাকে কিছু না বলে, গালে হাত বোলাতে বোলাতে চুপচাপ্ চলে গেল। পরে জানা গেল, রাঘবের বাবা সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে ফিরছিলেন, আর বেচারা রাঘব তাঁকেই গিয়ে দাদা একটু আগুনটা দেবেনবলে বসেছে।
সন্ধ্যার দিকে আমাদেরও খুব সাবধানে থাকতে হতো, কারণ ওই সময়ে মাধবের দাদু সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরতেন। মাধব, দাদুর বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। দাদু আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন বটে, কিন্তু আমরা তাঁকে খুব ভয়ও পেতাম। তবে তাঁর চোখের আড়ালে আমরা সবই করতাম।
দাদুর বাড়ির পিছনে ও দাদুর বাড়ি ও পাশের দীপুদার বাড়ির মাঝখানে, দু-তিনটে নারকেল গাছ ছিল। মাধবদেরই গাছ। একদিন দুপুরে মাধবের বাড়ি পড়তে গিয়ে নারকেল পাড়ার পরিকল্পনা হলো। দরজা খুলে বাইরে গেলে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। ফিরে আসার সময়ও সেই একই বিপদের সম্ভাবনা, কেউ জেগে গেলে জানাজানি হবেই, এবং তাতে বিপদ ঝামেলার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। আমরা ওপরে দোতলার ঘরে পড়তাম। দোতলা থেকে কায়দা করে রান্নাঘর বেয়ে নেমে পাঁচিল টপকে গিয়ে, পিছনের গাছ থেকে নারকেল পেড়ে আনলাম। কাক পক্ষীতে টের পেলে ক্ষতি ছিল না, ক্ষতি ছিল দাদু টের পেলে, কিন্তু কেউ কিছু জানার আগে একই কায়দায় দোতলার ঘরে ফিরে এলাম। আর একদিন সন্ধ্যাবেলা পাশের গাছ থেকেই নারকেল পাড়লাম। গাছটা ঠিক জানালার পাশে হলেও সন্ধ্যাবেলা সম্ভবত মশার আগমন থেকে বাঁচতে, সমস্ত জানালা বন্ধ করে রাখা ছিল। আমি ভর সন্ধ্যায় নারকেল গাছে উঠেছি জানলে আর রক্ষা ছিল না। নারকেল গাছে আমি আগেও অনেক উঠেছি, কাজেই বিপদ কিছু হতো না, তবে বিপদে পড়েছিলাম তাল গাছে উঠে।
ঘটনাটা যদিও অনেক পরের। গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবার পরে, তখনও আমরা চাকরি পাইনি। রোজ সকাল বিকেল ব্যাতড়ে আড্ডা মারতে যাই। রেল লাইনের ঠিক পাশে, পরপর কয়েকটা তালগাছ ছিল। তাতে কচি কচি তাল হয়ে আছে দেখে একদিন তালশাঁস খাওয়ার প্ল্যান হলো। অনেক খুঁজেও গাছ থেকে তাল পেড়ে দেওয়ার লোক পাওয়া গেল না। শেষপর্যন্ত ঠিক হলো নিজেরাই তাল পেড়ে, তাল কেটে শাঁস খাওয়া হবে। অতীত অভিজ্ঞতার একমাত্র অধিকারী, এই অগতির গতির কপালেই সেই মহান দায়িত্ব পড়লো। আমি আগে কোনদিন তাল গাছে উঠিনি বটে, তবে ধরেই নিয়েছিলাম যে দুটো গাছেরই কান্ডের গঠন যখন একই রকম, তখন গাছে ওঠায় কোন অসুবিধা হবে না। আমি একটা কাটারি নিয়ে খুব কায়দা করে গাছে উঠতে শুরু করলাম। নীচে সবাই ঘাড় তুলে তীর্থের কাকের মতো আমার সাফল্য ও তালের আশায় অপেক্ষা করতে লাগলো। নারকেল গাছের পাতা শুকিয়ে গেলে নীচের দিকে মুখ করে ঝুলে থাকে, কিন্তু তাল গাছের আবার কাঁচা পাতাও নীচের দিকে ঝুলে থাকে দেখছি। ঐ ঝুলে থাকা পাতা পর্যন্ত উঠে কাঁটা ভর্তি পাতা সরিয়ে ওপরে উঠতেও পারছি না, তালের নাগালও পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে কাটারি দিয়ে তাল কাটার পরিবর্তে পাতা কাটার চেষ্টায় মাতলাম, সফল হলে আরও কিছুটা ওপরে উঠে তাল কাটা, তারপরেও বেঁচে থাকলে তালশাঁস খাওয়া। গাছগুলো রেলের জমিতে, রেলের সমস্ত কর্মচারী আমাদের পরিচিত, কাজেই ধরা পড়ার বা ঝামেলা হওয়ার কোন ভয় নেই। কিন্তু ভোঁতা কাটারিটা বোধহয় প্রস্তর যুগ শেষ হয়ে লৌহ যুগ আরম্ভের সময় তৈরি হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে একটা পাতাও কাটতে সক্ষম না হয়ে অনেকক্ষণ তালগাছের পাতা ধরে, গাছের কান্ডে পা জড়িয়ে হাওড়া ব্রিজে ওঠা পাগলের মতো বসে থেকে, পা কাঁপতে শুরু করলো। অনেক দিনের অভ্যাস, বিনা রেওয়াজে নষ্ট হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত তাল ফল টকএই সিদ্ধান্তে এসে, নীচে নেমে আসতে বাধ্য হলাম। গাছ থেকে নেমে এসে দেখি জামা, প্যান্ট, হাত, পা, গোটা শরীর, য়লা ও ডিজেল ইঞ্জিনের ধোঁয়ার ভুষো কালিতে কালো হয়ে গেছে। তখন বুঝলাম যুগ যুগ ধরে ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়ার ভুষো কালিতে তালগাছের কান্ড অনেকটাই মোটা হয়ে গেছে। কোন পর্বত শৃঙ্গ প্রথম জয়ের চেষ্টার মতো আমিই বোধহয় প্রথম এই তালগাছ জয়ের চেষ্টা করে বিফল হয়ে ফিরে এলাম। যাহোক্ হাজার ধুয়েও এই কালি তুলতে না পেরে, মোটামুটি কিছুটা পরিস্কার হয়ে, অজিতের চায়ের দোকানে তালশাঁসের পরিবর্তে চা খেয়ে, আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরলাম।