ধারাবাহিক - ২০
ইন্দোর,
মধ্যপ্রদেশ,
হ্যান্টেড কাহিনী--২০
প্রান্তরেখার বাইরে
কিছুকাল
চাকরির সুবাদে আমি ইন্দোর
ছিলাম। তখনকার এক ঘটনা--
কিছুটা
অন্ধকার ধরণের ছিল—অনুপমদের বাড়ির সামনের
রাস্তার দু পাশের ঝাপড়ানো
গাছপালার জন্যে আধ-অন্ধকার হয়ে রেখেছে।
এক
মাস পরে মিত্র মেসো
মশাইদের বাড়ি যাচ্ছিলাম। উনি
অনুপমের বাবা, অনুপম
আমার বন্ধু। আমি মাস
খানেক বাইরে ছিলাম,
তাই অনুপমদের বাড়ি আসতে
পারিনি। মেসোমশাইয়ের সঙ্গেও আর
দেখা হয় নি। মাসিমা,
মানে অনুপমের মা,
আজ বছর তিন হল
মারা গেছেন। তারপর থেকে দেখেছি
মেসো মশাই প্রায়ই মনমরা
হয়ে পড়ে থাকতেন। আমি
একদিন তাঁকে বলেছিলাম,
মেসো মশাই, মোবাইলে
আজকাল সারা দুনিয়া পাওয়া
যায়। আপনি শিখে নিলে
সময় কাটাতে কোন অসুবিধা
কবে না। তারপর থেকেই
তিনি মোবাইল
নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেন।
আর এখন ত বেশ
এক্সপার্ট দেখলাম।
এই
ত এখনই দেখা হল
তাঁর সঙ্গে। তিনি রাস্তার
এক পাশের কালভার্টে বসে
আছেন। মোবাইল নিয়ে খুব
ব্যস্ত দেখলাম তাঁকে। আমি যখন
মেসোমশাই বলে
ডাক দিলাম, এক ডাকে
তিনি সাড়া দিলেন না।
তিন ডাকের পর মেসোমশাই
আমার দিকে তাকালেন।
--কেমন আছেন
মেসোমশাই ?
--ভাল আছি—তুমি ভাল তো
?
--হ্যাঁ—মাথা নাড়লাম আমি।
--তুমি তো
অনেকদিন আস না আমাদের
বাড়ি।
--হ্যাঁ।
--যাও—আমাদের ঘরে যাও।
কথার
ফাঁকে ফাঁকে বারবার অন্যমনস্ক
হচ্ছিলেন মেসোমশাই। মোবাইলের দিকে
চোখ রাখছিলেন।
মেসোমশাই
হঠাৎ আমাকে একবার দেখে
নিয়ে বলে উঠলেন--তোমার মাসিও ভালো
আছে।
--মাসি
?
--বুঝলে না
? আমার স্ত্রী।
--কি বলছেন
?
--বিশ্বাস না
হলে, এই দেখো,
মেসোমশাই তাঁর হাতের মোবাইলটা
আমার সামনে তুলে ধরলেন,
দেখো দেখো--
আমি
অবাক হয়ে তাকালাম তাঁর
মোবাইলের দিকে। এ কি
? এ যে তিন বছর
আগের মাসিমার ওপর করা
ভিডিও। আমি বললাম,
এখনো এটা দেখেন
?
--হ্যাঁ,
ওর সঙ্গে কথা বলি,
চোখের আড়াল হলেই ডেকে
নিই। দেখবে, দেখবে বলে
আবার মোবাইল টিপলেন তিনি,
এই যে দেখো মাসির
সঙ্গে কথা বলো--
--মানে
! আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম
না। কিন্তু এ কি
? মাসি সত্যি তো আমার
দিকে তাকিয়ে হাসছে,
বলছে, তপন অনেকদিন পরে
তুমি এখানে এলে--ভালো আছ বাবা
? মাঝে মাঝে এমনি এসে
আমার ছেলে, ছেলে
বৌকে দেখে যেও। আমি
তো আর সশরীরে আসতে
পারি না !
মেসোমশাই
এবার মোবাইলটা হাত বাড়িয়ে
নিয়ে নিলেন।
ব্যাপারটা
ভীষণ আশ্চর্য লাগছিল আমার
কাছে। এমনটা কি ভাবে
হতে পারে ? মাসিমা
তো মারা গেছেন তিন
বছর আগে। তবে কি
এ ধরনের কোন ভিডিও
অনেক দিন আগে তুলে
রাখা ছিল ? না,
মাসিমার তাৎক্ষণিক এমনি আমার
সঙ্গে কথাবার্তা বলা,
এমনটা কোন মতই সম্ভব
নয়। ব্যাপারটা কিছুতেই আমার
মাথায় ঢুকছিল না। ভাবতে
ভাবতে দশ মিটারের মত
দূরত্ব পার করে অনুপমের
বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছলাম।
কলিংবেল চাপতেই অনুপম এসে
দরজা খুলে দিলো,
অরে তুই কবে এলি
?
--এই তো
কাল।
--আয়,
আয়, ভেতরে আয়
!
ওদের
ঘরে গিয়ে সোফায় গা
ছেড়ে দিয়ে বসলাম। শীতের
রাতেও ঘামছিলাম আমি। রাত
দশটা তখনও হয়নি।
অনুপম
বলল, খেয়েদেয়ে আসিসনি
তো ? এখানে খেয়ে যাস।
--তোরা এখনও
খাসনি ? মেসোমশাইকে দেখলাম রাস্তার
কালভার্টে বসে থাকতে।
আশ্চর্য
হয়ে তৎক্ষণাৎ অনুপম বলে
উঠলো, কি ! কি
বলছিস তুই ?
--হ্যাঁ,
আমার সঙ্গে কথা হল
তো ?
--রাবিশ--কি যাতা বলছিস
তুই ? তুই জানিস না,
বাবা মারা গেছেন আজ
দু সপ্তাহ হল ?
--কি
? কি ? কি? আমার
মুখ থেকে আর কথা
সরছিল না ! নিজের
বর্তমান অস্তিত্ব নিয়েও সন্দিহান
হয়ে পড়ছিলাম। কেমন স্বপ্নের
ঘোরের মত লাগছিল। বেশ
কয়েক মুহূর্ত লেগে গেলো
নিজেকে সামলে নিতে। ঢোক
গিলে বললাম ,কিন্তু আমার
সঙ্গে যে দস্তুরমত কথা
হল !
--কি বলছিস কি তুই--
অনুপমের
বৌ ঘরের মধ্যে থেকে
সব কথা শুনছিল হবে।
সে দু লাফ দিয়ে
ঘরের বাইরে এসে সবার
সামনে ভয়ের কাঁপা গলা
নিয়ে অনুপমকে বলে উঠল,
ওই দেখো আমার কথা
বিশ্বাস করছিলে না তো
তুমি ?
আমি
প্রশ্ন করলাম, কি কথা
?
--ও সব
কিছু না--অনুপম
তাড়াতাড়ি বলে উঠলো।
--শ্বশুর মশাইকে
আমিও সামনের রাস্তা দিয়ে
হেঁটে যেতে দেখেছি
! অনুপমের
বৌ বলে উঠল।
অনুপম
বলে ওঠে, ওর
ও সব মনের ভ্রম--কিন্তু তুই বলছিস--
আমি
বললাম, হ্যাঁ রে
! আমার সঙ্গে কথা হল।
আমাকে তাঁর মোবাইলে মাসিমাকে
পর্যন্ত দেখালেন।
অনুপম
আশ্চর্য হয়ে বলল,
কি বলছিস তুই
!
--হ্যাঁ রে,
আর মাসিমা লাইভ ভিডিওতে
আমার সঙ্গে কথা বললেন
!
এরপরে
কারও কিছু জোর দিয়ে
বোধহয় বলার ছিল না।
আমরা তিন জন্যেই সোফায়
কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে
বসে থাকলাম।