নিরব
কমল
সাপ্তাহিক
আলোচনা সভা। ডিপোজিট সংগ্রহ, ঋণ আদায়, এলসি খোলা ও বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা; ডিসেম্বর
টার্গেট তো আছেই। বেঁধে দেওয়া জুনের টার্গেট করতে পারেনি শাখা। কী করবে তাই নিয়ে
আলোচনা। প্রতি কোয়ার্টারেই প্রধান কার্যালয় থেকে ডিপোজিট, অ্যাডভান্স, প্রোফিট টার্গেট বেঁধে দেওয়া হয়
প্রতিটি শাখাকে; শাখাকে সেটি পূর্ণ করতে হয়। শাখা ব্যবস'াপক এই নিয়েই আলোচনা করছিলেন। সকলের মনোযোগ ব্যবস'াপকের আলোচনার দিকে। কিন' নিকিতা রহমান মন
দিতে পারছে না সেদিকে। ওর মন চলে যাচ্ছে এই আলোচনা থেকে দূরে। নিকিতা বরাবরই এরকম;
ওর মন পাগলা ঘোড়ার মতো বেয়াড়া। মনকে বশে রাখতে কসরত করতে হয়
সবসময়। যখন কলেজে পড়তো তখন স্যার-ম্যাডামদের লেকচার শোনার সময় মাঝেমাঝেই আনমনা হয়ে
যেতো; বকাও খেতে হতো সেজন্য। কিন' পরিবর্তন হয়নি কোন। তেমনটিই আছে আজও!
নিকিতা
প্রিন্সিপ্যাল অফিসার। তিনদিন ট্রেনিং শেষে আজ অফিসে এসেছে। ট্রেনিং ছিল বাংলাদেশ
ব্যাংকে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ বাংলাদেশের
কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশ লাগছিল ট্রেনিং-এর পরিবেশ। পড়া পড়া খেলা। রিল্যাক্স মুডে
গেছে এই তিনটে দিন। অনেকটা সময় ছিল নিজের জন্য যা অফিস চলাকালীন পাওয়া যায় না। অফিস
তো কাজের জায়গা, হেলাফেলা করে গল্প-গুজবে কাটিয়ে দেওয়ার
জায়গা নয় তা জানে নিকিতা। এখানে কাজ ছাড়া বসে থাকা যায় না, ব্যাংক-শাখাতে সেটি সম্ভবও নয়। নিকিতার এরকম কাজের ভার পছন্দ নয়;
ও মনে করে কাজের মধ্যে কিছুটা সময় যদি রিল্যাক্স মুডে থাকা যায়
তবে কাজের উন্নতি হয়। ওর এখন ট্রেনিং-এর কথা মনে পড়ছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে
ত্রিশজন এসেছিল ট্রেনিং-এ। ওদের মধ্যে সবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি নিকিতার। দুই
তিনজনের সঙ্গে কথা হয়েছে ভালো লেগেছে। ফোন নম্বর দেওয়া- নেওয়া হয়েছে।
এই
মুহূর্তে চটপটে একটি ছেলের কথা মনে পড়ছে; ওর নাম নিরব
কমল। যেদিন ট্রেনিং শেষ হয় সেদিন বলেছিল ফোন করবে। খুব চটপটে, মিশুক,
প্রাণবন্ত তরুণ। চোখেমুখে কথা উপচে পড়ে। একনজরে দেখলে মনে হবে
কোন বিষয়ে সিরিয়াস নয়; কিন' খুব
সিরিয়াস। ওর এই সিরিয়াসনেসই ভালো লেগেছে নিকিতার। নিকিতা এই মুহূর্তে কমলের ফোন
আশা করে। ওর কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল নিকিতা। ব্যবস'াপকের ডাকে চমকে ওঠে। ‘নিকিতা এবার আপনি
ট্রেনিং-এর কথা সংক্ষেপে বলুন।’ ব্যবস'াপকের কথা শুনে নিজেকে একটু প্রস'ত করে। তারপর
বলা শুরু করে। ‘মাঝেমধ্যে আমাদের সকলেরই প্রশিক্ষণে যাওয়া
উচিত। আমরা স্যার কাগজে কলমে কাজ করি, কখনও বুঝে করি কখনও
বা না বুঝে।
কখনও ফাইল দেখে কাজ করি, কখনও আগেরজন
যেভাবে কাজটি করেছে তার কাছ থেকে শুনে বা দেখে করি। কাজ করে যাই ঠিকই কিন' আমাদের মধ্যে অনেকেই কাজটি কেন এভাবে করা হলো তার ব্যাখ্যা দিতে পারি
না। ট্রেনিং-এ গেলে পার্টিকুলার বিষয়টি সম্পর্কে জানা যায়। যদিও বিস্তারিত জানা এই
কয়েকদিনে সম্ভব হয় না তবুও ভালো হয় স্যার। মাঝে মধ্যে এমন ছোটখাটো ট্রেনিং-এ সকলেই
যাওয়া প্রয়োজন বলে আমার মনে হয় স্যার।’ নিকিতা ছোটখাটো
একটি বক্তৃতাই দিয়ে ফেলে। ব্যবস'াপক সাহেব আগেপিছে সবাই
ট্রেনিং-এ পাঠানোর ভরসা দিয়ে আলোচনা সভা শেষ করেন। সন্ধ্যার আযান শোনা গেল। টেবিল
গুছিয়ে ফেলেছে; আযান শেষে বাসায় ফিরবে। উঠতে যাবে এমন সময়
টেলিফোন; নিরব কমল।
কেটে
গেছে ছয়মাস। কমলের সঙ্গে দেখা হয় না খুব একটা কিন' কথা হয়
ফোনে। ফোনে কথা বলতে বলতেই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একটা টান অনুভব করে মনে;
মাঝেমধ্যে খুব দেখতে ইচ্ছাও করে। সুসম্পর্ক দুইজনের। বাবার অসুখ
শুনে গ্রামে গিয়েছিল; খুব ব্যস্ত থাকাতে ঢাকতে কারো
সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারেনি। কমলের খবরও নিতে পারেনি। গতকাল ঢাকা ফিরেছে। আজ
অফিসে। কমলের খবর নিতে হবে আজ। ও কাজ করছে। ক্লিয়রিং সেকশনের কাজ; নির্দিষ্ট সময়ে চেক পাঠাতে হয় ‘বাংলাদেশ
ব্যাংক ক্লিয়ারিং হাউজে।’ ঠিক সময়ে চেক না পাঠালে চেক
ফেরত আসবে।
তখন হিসাবধারকদের অসুবিধা হয়ে যাবে। মাঝেমধ্যে এরকম সমস্যা ঘটে।
ও নিবিষ্টমনে কাজ করছিল যাতে ভুলচুক না ঘটে।
এমন
সময়ে বেজে ওঠে ফোন। করিমুল। করিমুলের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে ট্রেনিং-এ। কথা বলে কম,
মেপে মেপে। কুশল বিনিময়ের পরে বলে, ‘আপা
চাকরি নেই কমলের!’ ‘ কেন?’ বিস্মিত
নিকিতা। ‘চাকরি চলে যাবে এমন সেকশনে তো কাজ করতো না কমল।
কাজ করতো রিকনসাইলে। তাছাড়া এতো সিরিয়াস ছেলে তার চাকরি যাবে কেন?’ করিমুল বলে, ‘না আপা ওখান থেকে বদলি করে
দিয়েছিল বৈদেশিক বাণিজ্য শাখাতে। ওর মায়ের শরীর খারাপ ছিল, মন দিতে না পারায় কাজে একটু গোলমাল করে ফেলেছিল, তাতেই ব্যাংক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পার্টি ভর্তুকি দিতে চেয়েও দেয়নি;
পালিয়েছে! আর কমলের কাছে অতো টাকা নেই যে ভরপাই করে দিবে। ফলে চাকরি
চলে গেছে। প্রাইভেট ব্যাংক শুধু চাকরি নিয়েছে, কারাবাস
দেয়নি। বেঁচে গিয়েছে কমল।’ কথা শুনে মন খারাপ হলো
নিকিতার। ছয় মাসের পরিচয় হলেও খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। কাজ শেষে টেবিলে চুপচাপ;
ভালো লাগছে না। করিমুল বলল
অনেকগুলো টাকার ব্যাপার; ১০ লাখ। সবাই
মনে করছে পার্টির সঙ্গে যোগসাজস করে ঘটনা ঘটিয়েছে। বিষণ্ন মনে বসে থাকে নিকিতা।
মনে পড়ে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা।
তখন
সবে যোগ দিয়েছে ব্যাংকে। শাখা অফিসে লেজার পোস্টিং। তখনও কম্পিউটার চালু হয়নি।
ম্যানুয়ালি কাজ করতে হতো। ওর সই জাল করে নিয়েছিল টাকা। অনেকগুলো টাকা। ৫০ হাজার।
অফিসের অন্য একজন কর্মচারির সঙ্গে যোগসাজসে টাকা নিয়ে গেছে হিসাবধারক। হিসাবে আছে
মাত্র ১০০টাকা; নিয়ে গেছে ৫০ হাজার। দিন শেষে লেজার
চেকিং-এ গিয়ে ধরা পড়েছে; চেকটি পোস্টিং-এর জন্যও আসেনি।
অনেক কষ্টে সেই টাকা উদ্ধার করা গিয়েছিল। টাকাটা উদ্ধার না হলে নিজের গাঁটের টাকা
ভরতে হতো না হলে নির্ঘাত কারাবাস! ব্যাংকে কাজ করার সময় অসাবধান হতে নেই, তাহলেই বিপদ।
রাতে
কমলের বাসায় ফোন করে নিকিতা। ফোনে কথা হয় কমলের সঙ্গে। কমল বলে, ‘কেউ একজন শত্রুতা করেছে আমার সঙ্গে। চেয়ারে নতুন ছিলাম। যাকগে তোমার
কথা বলো।’ নিকিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আমি তোমার কথা জানার জন্য ফোন করেছি। ঢাকাতে ছিলাম না। বাবার অসুখে গ্রামে
গিয়েছিলাম। আজ অফিসে জয়েন করে শুনি এই কথা।’ কমলের ম্লান
হাসি শুনতে পায় নিকিতা। কমল ভারি কণ্ঠে বলে, ‘আমি বিদেশে
যাচ্ছি নিকিতা। ওখানেই থাকবো। এখানে চাকরি পাবো না। এখানে চাকরি থাকা অবস'াতেই মালোয়েশিয়ায় চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম, ওটাই
হয়েছে। ভিসা পেলেই চলে যাবো।’ নিকিতার চোখে জল এসে পড়ে।
টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে কথা। ‘নিকিতা ঠিকই
বলেছিলে তুমি। এখন মানুষ শুধু নিজের পাতে ঝোল টানতে ব্যস্ত। অন্যের দিকে খেয়াল করে
না।’ ‘তুমি একবারটি জানালে না আমাকে, বন্ধু মনে করো না আমাকে।’ নিকিতার কণ্ঠে
অভিমান। ‘না
তা নয়। মন ভালো নেই; তাছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে
না আমার।’ এই কথার পর আর কথা এগোয় না। হঠাৎ একটি যতি
চিহ্ন পথ রোধ করে দুজনের কণ্ঠের। রিসিভার নামিয়ে রাখে না ওরা, আবার কথাও বলে না। অনেকক্ষণ পরে নিকিতা বলে, ‘ভালো
থেকো।’
ফোন
ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসেই থাকে নিকিতা। চারপাশ কেমন ফাঁকা মনে হয়। বিষণ্ন মন বিষণ্ন
হয়ে যায় আরও। বিষণ্নতা মন থেকে উঠে আসে চোখে; চোখের পাতায়
জমতে থাকে হীরের কুচির মতো অশ্রুকণা।