গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮

দেবলীনা চক্রবর্তী

গানের গুঁতো 

মুশকিলটা হচ্ছে এখনও পর্যন্ত তপন বাবুকে কেউ মুখের ওপর আসল সত্যি কথাটা বলে উঠতে পারে নি । অনেকে অনেক চেষ্টা- চরিত্র করেও শেষরক্ষা কেউ করতে পারে নি । 
তপন গায়েন এই তল্লাটের বর্ধিষ্ণু , অভিজাত ব্যবসায়ী । নম্র ও ভদ্রতো বটেই , সবসময় তাঁর মুখে সলজ্জ হাসিটি লেগেই থাকে । এলাকায় যেকোনো ত্রাণ , ডোনেশান , সেবামূলক , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর সহৃদয় সাহায্য ও সহযোগীতা অবশ্য স্বীকার্য । তাই আসল কথাটা তাঁকে বলা ভীষণভাবে দুষ্কর । 

আসলে তিনি হলেন একজন একনিষ্ঠ ও নিয়মানুগ সুর সাধক ! রোজ সকাল - সন্ধ্যাতে সুর সাধনা তাঁর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য । 
চুপিচুপি বলি , অনেক বছর রেওয়াজ বা সাধনা করেও তাঁর গায়কী ও সুর জ্ঞান একটুও উন্নত হয় নি । এই নির্মম সত্যি টা ওনাকে বলার দুঃসাহস কারোর হয় নি । তবে অনেকেই সৎ পরামর্শ দিতে সচেষ্ট হয়েছেন কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয় নি । 
এলাকার যুবকবৃন্দ ক্লাব গত বছর এক অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল যার বেশিরভাগ আর্থিক অনুদান তপনবাবুর ছিল , সে অনুষ্ঠানে পাড়ার কিছু লোক প্রায় অনুনয় - বিনয় করে উপস্থিত এক প্রথিতযশা শিল্পীকে সুর সাধনা ও গান পরিবেশনের সঠিক নিয়ম সম্বন্ধে কিছু বলতে অনুরোধ করেছিল , যা পুরোটাই ছিল তপনবাবুকে পরোক্ষভাবে এ বিষয়ে শোনানো বা শেখানো । কিন্তু সে উদ্দ্যোগ ব্যর্থ করে পরদিন সকালেই তাঁর বেসুরো গানে পাড়া উদভ্রান্ত হয়ে উঠেছিল । 
এই পাড়ার সকলের খুব উপকারী বন্ধু চিন্তামনি ডাক্তার । অনেকে তাকে হাতুরে ডাক্তার ও বলে কিন্তু যার যখনই দরকার সবার আগে এই চিন্তামনির দাওয়াই প্রাণ রক্ষা করে । 
সেদিন মাঝরাতে তপন বাবুর ও বুকের বাঁ দিকে হঠাৎ প্রচন্ড ব্যথা , পাড়ার লোকেরা এই সময়  হাতুরে ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হয়েছিল সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার  করতে ,সে রাতে তাঁকে সুস্থ করেছিলেন এই চিন্তামনি ডাক্তার এবং তাকে বলতে অনুরোধ করা হয়েছিল যে , তপনবাবুর এই বয়সে এইভাবে রোজ বুকে , পেটে ও গলায় চাপ দিয়ে রেওয়াজ  করাই নাকি বুক ব্যাথার কারণ , তাই এ মুহূর্ত থেকে এই সাধনা তাকে পরিত্যাগ করতেই হবে , তবেই তাঁর শরীর - স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব । এমনই শিখিয়ে পড়িয়ে চিন্তামনি ডাক্তারকে পাঠানো হল গায়েন বাবুর চিকিৎসা করতে এবং আরও জোর দেওয়া হলো -শহরের বড় ডাক্তারকে গায়েন বাবুকে দেখিয়ে আনতে হবে এবং তাঁকে দিয়েও এমন সম্ভাবনার কথা বলানোর গুরু দায়িত্ব দেওয়া হল । 
কিন্তু পরমেশ্বর হয়তো সহায় ছিলেন না এ যাত্রায় !
বড় ডাক্তার সেদিন তপনবাবুর গলা সাধা যে তাঁর হৃদযন্ত্র বিকলের কারণ সেকথা নস্যাৎ করে এভাবেই আরও কিছুকাল মন - প্রাণ উজাড় করে গলা ছেড়ে গান গাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন । এবং আরও বলেছিলেন তাঁর হার্ট অত্যন্ত দুর্বল তাই মনের আনন্দে গান গাওয়াই নাকি গায়েন বাবুর বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ । 

আসলে এ যুগে তো ভূতের রাজাও নেই আর সত্যজিতের বুদ্ধিদীপ্ত গপ্পোও নেই ,যেখানে তপন গায়েন কে ভূতের রাজা বর দিয়ে সুরেলা গায়ক আর তার সুরের যাদুতে সকলকে মোহিত করে রাখবে । তাই অগত্যা এইভাবেই পাড়-পড়শীর চরম দুর্দশা চলছে - চলবেই !!