নন্দিনীর সঙ্গে স্বপনের বন্ধুত্বের শুরু
সেই কবে থেকে। স্বপনের নাম আসলে লিয়াকত, লিয়াকত ইসলাম। ওকে স্বপন বলে ডাকে।
স্বপ্নে পাওয়া ছেলে নাকি স্বপ্ন দেখা ছেলে তা জানি না। নন্দিনী বলে, মনে হয়
পরেরটাই ঠিক।
---যা স্বপ্ন দেখিস তুই। পারিস না তো কিচ্ছুটি, মুখে ইয়া ইয়া কথা...আর মেয়েগুলোকেও দ্যাখ, হামলে পড়ে তোকে দেখে একেবারে!’
---যা স্বপ্ন দেখিস তুই। পারিস না তো কিচ্ছুটি, মুখে ইয়া ইয়া কথা...আর মেয়েগুলোকেও দ্যাখ, হামলে পড়ে তোকে দেখে একেবারে!’
স্বপন হাসে। ‘ কি করব বল, তোদের মত এত বড়
বাড়ি, নাকি এত বড় চাকরি আছে আমার বাবার! আমরা গরীব-গুর্বো মানুষ, বাপ মাঠে জমি চাষ
করে। মা ধান সেদ্ধ করে, সেলাই করে মীরা দিদিমনির বুটিকে। না আছে তোদের মত ঝকঝকে
বাড়ি, না আছে গাড়ি। তাই স্বপ্ন দেখে কাটাই। বেশ লাগে কিন্তু!’ বলেই আবার হাসি। ওর
হাসিটা এত সুন্দর, এত অমলিন, নন্দিনী হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, তাকিয়েই থাকে। তারপর
স্বপন হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলে চমক ভাঙ্গে। কি যে আছে ওর হাসিতে, কে জানে!
ছোটবেলার সেই বন্ধুত্বটা বড় হয়ে কেমন যেন বদলে গেল। এখন নন্দিনী কলেজে যায়। কোনদিন গাড়িতে, কোনদিন কলেজ বাসে। রোজই যাবার সময় দেখে,স্বপন মায়ের হাত থেকে একটা বড় থাকওয়ালা টিফিনবাক্স নিয়ে যাইকেলে চাপছে। বাসের কিংবা গাড়ির পিছনে অল্প একটু রাস্তা সঙ্গে এসে অন্যদিকে চলে যায়। নন্দিনী জানে, স্বপন এইসময় ওর সঙ্গে আসবে না, ওর দিকে তাকাবেও না, তবু নন্দিনী দেখে, যতদুর দেখা যায়। স্বপন অন্য রাস্তায় চলে গেলে মুখ সামনে ঘু্রিয়ে গাড়িতে ঠিক হয়ে বসে। স্বপনের হাতের বড় টিফিনবাক্সটা স্বপন আর কাবুল চাচার দুপুরের খাবার। স্বপন স্কুল পাশ করার পর থেকে বাবার সঙ্গে জমি চাষ করে। সন্ধ্যেবেলা ফিরে এসে ওদের বাড়ির উঠোনে বসে কারো চিঠি, কারো দলিল্পত্র এসব লিখে দেয়। তা থেকে যা পয়সা আসে, সেটা ওর হাতখরচ। আগে টাকাপয়সার দরকার পড়লে নন্দিনীর কাছে চাইত। তখন লজ্জ্বা ছিল না, এখন বন্ধুত্বটা বদলে গিয়ে লজ্জ্বা এসে ঘিরে ধরে, চাইতে পারে না। নন্দিনীও স্বপনের দিকে সবসময় মুখ তুলে চাইতে পারে না। অথচ রোজই দুজন দুজনকে দেখা চাই, যেভাবেই হোক। কি এক লুকোচুরির খেলা চলছে যেন ওদের মধ্যে।
সেদিন বিকেলে হঠাৎ করেই বাবা এসে মা’কে
বলেন নন্দিনীর বিয়ের কথা। এক বন্ধু একটি ছেলের সন্ধান দিয়েছেন, নন্দিনীর সঙ্গে
মানাবে ভালো। কান পেতে শোনে নন্দিনী। কিন্তু সবটা শোনার আগেই এক ছুটে স্বপনের
বাড়ি। স্বপন তখন সবে মাঠ থেকে এসে একটু জিরোচ্ছে। গায়ে গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। হাতে
একটা বই নিয়ে খাটিয়ায় লম্বমান। নন্দিনী ঘরে ঢুকে একটানে হাতের বই মাটিতে ফেলে
স্বপনের দিকে তাকিয়ে কতাহ বলতে শুরু করে। রাগে ফুঁসছে যেন। হাত-পা কাঁপছে। ‘ এত
বোকা কেন তুই? হাঁ করে বসে থাক...এদিকে আমায় এসে...’ ওবাক হয়ে গেছে স্বপন। কি বলবে বুঝতে না পেরে বোকার মত বলে--- ভালই
তো, কবজি ডুবিয়ে আমরা সবাই’ কথা শেষ হবার আগেই নন্দিনী মারমুখী---লজ্জ্বা করে না
তোর? তুই একটা......‘ কি কি বলেছিল এখন আর মনে নেই স্বপনের। তারপর দুজনের কি যে
হল, ওরাই জানে। ঘর থেকে নন্দিনী যখন বেরিয়ে এল একেবারে শান্ত, ধীর, স্থির। বাড়ি ফেরার আগে ফিক করে হেসে স্বপনের নাকে একটা টোকা
মেরে বলল---জানিস, আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। আমাদের ভাষা কিন্তু এক। ঝড়-ঝাপটা যাই আসুক
আমরা কিন্তু মন খুলে বোঝাতে পারব। পারব তো, বল?’
হাসল স্বপন। সেই সুন্দর হাসি, যে হাসি
দেখলে নন্দিনী শুধু তাকিয়েই থাকে। নন্দিনীর চুলের একটা বিনুনীতে টান দিয়ে বললে
স্বপন—আর আমার স্বপ্ন তো আছেই। আমি কিন্তু বাংলায় স্বপ্ন দেখি, তোর ওটা বুঝতে
একটুও অসুবিধে হবে না, দেখিস...!’