গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮

নীহার চক্রবর্তী

মা


খেলার মাঠের মুখোমুখি বাড়ি অপর্ণাদের ।
ছেলেরা সকাল-বিকাল সেখানে খেলতে আসে । অপর্ণা কাজের অবসরে খোলা জানলা দিয়ে তাদের খেলা দেখে । খেলা দেখতে দেখতে কখন যে ওয় দু'চোখ জলে ভরে ওঠে । চোখ মুছে আবার ও ছেলেদের দৌড়াদৌড়ি প্রাণ-ভরে দেখে ।
সেদিন দুপ্রের পর স্থানীয় ক্লানব নেতাজী সঙ্ঘের সঙ্গে ফুটবল খেলা শুরু হল পাশের গ্রাম নবীনপুরের একটা ক্লাবের । কোনোদিন যা হয়নি সেদিন তাই হল । অপর্ণা কোনোরকমে ঘরের কাজ সেরে আর বিধবা শাশুড়িকে খেতে দিয়ে পাশের বাড়ির রঘু সাহার বৌয়ের সঙ্গে খেলা দেখতে বাইরে বেরিয়ে এলো । মাঠের পাশে একটা জায়গা করে নিলো দুজন ।
সমস্তটুকু খেলা দেখে অপর্ণা মনের আনন্দে ঘরে ফিরে এলো ।
শাশুড়ি ওকে বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলল,''কি অলুক্ষনে । তুমি কিনা খেলা দেখতে ঘর থেকে বেরিয়েছিলে / মাঠের পাশে অনেক লোকের মাঝে বসতে তোমার লজ্জা করলো না / মরণদশা আর কি । এখন গৌতম জানলে কি হবে ভেবেছ কি ? আমি কিছু জানি না বাপু ''
শাশুড়ির কথা শুনে অবাক হলেও পরে হেসে ফেলে বলল,''খেলা দেখতে কার না প্রাণ চায় ? আজ সময় করে দেখলাম । কি যে মজা খেলা দেখার । ছেলেগুলো যেন আমার বুকের মধ্যে খেলছিল । দেখতে দেখতে আমার চোখে জল এলো । তবে জল মুছে নিয়েই আবার দেখতে থাকলাম । আমাদের দলকে জিতিয়েই ফিরলাম । কিচ্ছু হবে না,মা । তুমি আমার পাশে থেকো ।''
কিন্তু অপর্ণা কোন উত্তর পেলো না ওর শাশুড়ির । সে তখন একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে ।
অপর্ণার স্বামী অশেষ অফিস থেকে ফিরল সন্ধের কিছু আগে । কিছু সময়ের মধ্যেই তার কানে গেলো অপর্ণার মাঠে বসে খেলা দেখার ব্যাপারটা ।
মার ঘরে যেতেই সে বেশ বিরক্তির সঙ্গে তাকে বলে,''এই বুঝি তোর বৌ ? ঘর ছেড়ে বাইরে যায় ? কত চোখের সামনে বসে খেলা দেখে ? আমি ভাবতে পারছি না । তুই এবার ভেবে দেখে ।''
সাথে-সাথে অশেষের মেজাজ চড়ে যায়
মাকে বলে,''তাই বুঝি ? আমি দেখছি । অপেক্ষা কর । এ হতে পারে না । এমন সাহস পায় কোথা থেকে ।''
বিধবা মার মুখে তখন হাসি ফেরে । 
স্মিত হেসে বলে,''হুম । গুরুতর ।''
তারপরেই অশেষ ছোটে অপর্ণার কাছে । অপর্ণা তখন টিফিন তৈরি করছিলো রান্নাঘরে ।
অশেষ পিছন থেকে বলে বসলো ওকে,''এসবের কোন দরকার নেই । আমার সব কথার উত্তর দাও এবার । এসব হচ্ছে কী ? আমাদের সম্মান বলে বুঝি কিছু নেই ?''
শুনে চমকে উঠে অপর্ণা অশেষের দিকে তাকায় ।
বেশ থতমত খেয়ে বলে,''হলটা কী ? তুমি ঠিক আছো তো ? কি হয়েছে আমাকে বল ।''
অশেষ এবার মার কথাগুলো উগড়ে দিতে থাকলো সরোষে । সব শোনার পর অপর্ণা খুব জোরে হেসে উঠলো । পর মুহূর্তে ওর দু'চোখ জলে ভরে গেলো । সেইসাথে মুখে একরাশ ঘৃণা বসুবাড়ির প্রতি ।
''আচ্ছা,একটা কথা বলতে পারো আমাকে তুমি ?''
সজল-চোখে জিজ্ঞেস করলো অপর্ণা অশেষকে ।
অশেষ বেশ মেজাজের সঙ্গে বলল,''হুম । বল তুমি ঝটপটসেইথেকে আমার কিছু ভালো লাগছে না ।''
''
আমাদের সংসারে মানে আমার কোলে কখনো সন্তান আসবে ? তোমার কী মনে হয় ?''
অপর্ণার কথা শুনে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লো অশেষ ।
বেশ কর্কশ গলায় বলল,''সে তুমি সব জানো । এ আবার বলার কী আছে ? সে কপাল কী তোমার আছে ?''
''
মুখ সামলে কথা বলবে তুমি । আমার কপালের কথা আসছে কেন,শুনি ? ডাক্তার কার সমস্যা বলেছে ? আমার,না তোমার ?''
অপর্ণা চোখের জল কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে বেশ রাগের সঙ্গে বলল । বেশ থমকে গেলো তখন অশেষ
''সে না হয় বুঝলাম । কিন্তু এখানে এ কথা কেন ? তুমি প্রসঙ্গ বদলাতে চাইছ কেন ? আমি কি এ নিয়ে কথা বলেছি ?''
বেশ আমতা আমতা করে অশেষ কথাগুলো বলে গেলো ।
তখন অপর্ণা বলল কষ্টের এক চিলতে হেসে,''প্রসঙ্গটা এলো তোমার প্রসঙ্গ ধরেই । বাচ্চা দিতে পারবে না আর বাচ্চাদের খেলা দেখতে তুমি বারণ করবে ? ঘর থেকে খেলা কতটুকু দেখা যায় । বেশ করেছি আমি । আজ বাচ্চাগুলোর খেলা আজ প্রাণ-ভরে দেখেছি । আমার বুকের মধ্যে ওরা কি যে লাফালাফি করছিলো । কি যে সুখানুভূতি গো । সে বোঝার ক্ষমতা নেই । সর । কিছু ভাল্লাগছে না । আমি একটু ঘুমবো । আমার কাছেই এসো না ।''
কথাগুলো দ্রুত শেষ করে অপর্ণা মুখে কাপড় ঢাকতে ঢাকতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । 
তাওয়ায় রুটি পুড়ে যাচ্ছিলো । সেদিকে ছুটে গেলো অশেষ ।
তারপর সব চুপচাপ । 
অশেষ মাথা নিচু করে নিজের কাজ করে গেলো । অপরাধী-মুখে গেলো অপর্ণার কাছে । নিজের ভুল স্বীকার করে নিলো ।
অপর্ণাকে বলল,''আমি সত্যিই অক্ষম । তোমাকে সন্তান দিতে পারবো না । তুমি বাচ্চাদের নিয়ে থাকো । প্রাণ-ভরে খেলা দেখো । একটু মাকে সামলে খেলা দেখতে যেও আর কি । বোঝোই তো পুরনো মানুষ । পরিবারের সম্মান নিয়ে খুব ভাবে ।''
অপর্ণা অশেষের কথা শুনে কষ্টের হাসি হেসে বলল,''আমার এমন সময় বা ইচ্ছে নেই যে ভুল পথে গিয়ে পরিবারের সম্মান নষ্ট করবো । বাচ্চাদের খেলা আমার খুব ভালো লাগে । একসাথে মনে হয় ওরা আমার সবকিছু । তুমি একদিন আমার সঙ্গে বসে খেলা দেখো । দেখবে কি মজা তাতে ।''
হঠাৎ অশেষকে ডেকে উঠলো ওর মা ।
প্রায় তার-স্বরে বলল,''এদিকে আসবি একটু ? নাকি ওখানেই সব সময়....''
মার কথা শুনে অশেষের রাগ হল বেশ । অপর্ণা হেসে উঠে পিঠে আলতো ধাক্কা দিয়ে ওকে মার ঘরের দিকে পাঠিয়ে দিলো তখন ।
দরজার ওধারে দাঁড়িয়ে অপর্ণা স্পষ্ট শুনতে পেলো ওর শাশুড়ি অশেষকে বলছে,''তা বললি ওকে ? ও কিছু বলল ? তুই কী বললি ?''
অশেষ উত্তর দিলো,'আসলে মা আমারও ভুল আছে । অপর্ণাকে বুঝতে হবে আমাদের । কোন মেয়ে না মা হতে চায় ? কিন্তু সে আর সম্ভব না । তাই ও ছেলেদের খেলা দেখে খুশি থাকতে চায় । আমি কি কিছু বলতে পারি আর ?''
অশেষের কথা শুনে ওর মা বেশ রেগে গেলো ।
রাগত-স্বরে বলল,''এমন উদাহরণ অনেক আছে । সবার মা হওয়া হয় না । তা বলে পরিবারের সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে মাঠের ধারে বসে খেলা দেখবে ? তুই মানুষ না । আমি মানতে পারলাম না ।''
মাথা নিচু করে অশেষ সব শুনে গেলো ।
শেষে মাথা তুলে সকাতরে বলল,''আমি কিছু বুঝি না গো । যা বুঝেছি তাই বললাম তোমাকে । তুমি মা । মায়ের অনুভূতিটা নিশ্চয় বুঝতে পারো । আর কিছু বলার নেই আমার । আসি ।''
অশেষ চলে গেলে ওর মা রাগে জ্বলতে থাকলো খুব । বিড়বিড় করে কীসব বলে গেলো কিছু সময় ।
অশেষ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অপর্ণা সারা মুখে হাসি নিয়ে ওর শাশুড়ির ঘরে ঢুকল । তার মুখোমুখি বসে হাতটা চেপে ধরল ।
তাকে বলল,''আপনার ব্যাপারটা আমি অস্বীকার করি না,মা । পরিবারের সম্মান বলেও কিছু আছে । আমি এমন বোকা নই যে পরিবারের সম্মান নষ্ট করবো । আমার শ্বশুর নামী অধ্যাপক ছিলেন । সে কি আমি জানি না ?''
অপর্ণার কথা শুনে শাশুড়ি এক চিলতে হেসে বলল,''তারপর ?''
''
তারপর আর কি,মা । আমি পরিবারের সম্মান রক্ষা করবোই । কিন্তু ঈশ্বর তো একটা সন্তান জন্ম দেননি । তার কত যে সন্তান । যেসব ছেলেরা মাঠে খেলে তারাও তার সন্তান । আমি তাদেরই দেখতে গেছিলাম । আপ্নিও আমার সঙ্গে তাদের দেখতে পারেন । আবার নাকি পরশু খেলা আছে । আপনি আমার সঙ্গে যাবেন । দুজন মিলে এবার থেকে খেলা দেখবো । তাই তো ?''
শুনে এবার শাশুড়ি হেসেই ফেললো ।
হাসতে হাসতে সে বলল,''আমার কি আর দেখার সময় আছে ? মাজাই চলে না । তুমি যা বললে তাতে আমি খুশী । তুমি দেখে আমাকে তোমার সন্তানদের কথা আমাকে জানিও । আমিও তোমার কষ্ট বুঝি,মা । আমি কি মা নই ?''
শাশুড়ির কথায় অপর্ণার দু'চোখ জলে ভরে গেলো । দু'গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করলো । সঙ্গে-সঙ্গে শাশুড়ি ওর মাথাটা তার বুকে টেনে নিয়ে অনাবিল- হেসে বলল,''অমন করে চোখের জল ফেলতে নেই,মা । আমার তো একটাই সন্তান । তোমার শত-সহস্র । তুমি অনেক উঁচু মনের মেয়ে । আর কাঁদে না গো ।'''
কখন যে সেখানে অশেষ এসে উপস্থিত হয়েছে ওর মা বা অপর্ণা লক্ষ্য করেনি ।
অশেষ হাততালি দিয়ে সোল্লাসে বলে উঠলো,''মাতৃ-যুগলের স্বরূপ বুঝতে পেরে আমি আজ ধন্য । এমন করেই তোমরা চলতে থাকো । বাবা খুব খুশী হবেন ওপর থেকে । সর্বোপরি ঈশ্বর ।''
এবার ওর মার চোখেও জল চলে এলো ।
জল-ঝাপসা চোখে সে প্রায় অস্ফুট-গলায় বলল অশেষকে,''আমি বুঝি তোর বৌয়ের থেকে কিছুটা পিছিয়েই আছি ।''
লজ্জায় তখন জিভ কাটল অপর্ণা । অশেষ হাসল বেশ তৃপ্তির সঙ্গে ।