প্রাপ্তি
অনিমেষ
ভেবেছিল,
একটা ক্ষীণ আশা করেছিল, মায়ের
মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অন্তত দু এক দিনের জন্য ছেলে আসবে । আমেরিকা থেকে আসা-যাওয়া তো
এখন জলভাতের মত । ভুল ভেবেছিল আনিমেষ । দু মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইটা চালিয়েছিল
অনিমা । অনিমেষ বুঝেছিল অনিমার লড়াই
করার পুঁজি ছিল একটা আশা । ছেলেকে কিছুক্ষণের জন্য কাছে পেতে চেয়েছিল অনিমা । হ্যাঁগো, বাবু আসবেনা ?
কবে আসবে ? ফোন করেছিলে ? মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল অনিমেষ,
আসবে আসবে । এই তো সামনের মাসে
ওর জন্মদিন । জন্মদিনে বাবুকে পায়েস খাওয়াবে তুমি ।
আজ দশদিন
হল অনিমার লড়াইটা শেষ হয়েছে । শ্রাদ্ধশান্তির কাজটাও আজ মিটল । অতিথি অভ্যাগতরা
চলে গেছে ।
অনিমার
ছবিতে ফুলের মালাগুলো এখনও বেশ তাজা রয়েছে । অনিমেষ অনেকদিন আগেই বুঝেছিল ছেলে আর
দেশে ফিরবে না । তবু যদি বছরে একবার অন্তত দু একদিন মা-বাবার সঙ্গে কাটিয়ে যেত ! এর বেশি কিছু ভাবেনি অনিমেষ । অনিমা তখনও বিছানা নেয়নি, ফোন করেছিল ছেলেকে ‘বাবু এবছর তো একবারও এলে না । তোমার মা
বলছিল দাদুভাইকে দেখলামই না, কত বড় হয়ে
গেল ! তোমার ছেলেকে ওর দাদু-দিদাকে দুদিন আদর করার সুযোগ দেবে না ?
এবার পূজোয় দিন কয়েকের জন্য এসো । ছেলে বলেছিল ‘তোমরা একটূও বদলালে না বাবা । সেই পূজো-পার্বণ, রীতি-রিচুয়াল
নিয়ে আছো । আমাদের ও সব মানতে গেলে চলে না বাবা । আমাদের শুধু ছোটা আর ছোটা । সেই ছোটা থামিয়ে সাতদিন
পুরনো হুজুগে মাতা যায় না বাবা’ । যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল অনিমেষ । ভেবে পায় না, এতোটা অনাত্মীয় কি করে হয়ে গেল ছেলে তার !
এমন হবার তো কথা ছিল না । ছেলেকে
ঘিরে কত স্বপ্ন ছিল তাদের । অনিমেষ চায়নি ছেলে বিদেশে যাক । অনিমাই বলেছিল “যাক না ।
এতো পড়াশোনা করলো । এখানে পচে কি দাম পাবে’ ? ছেলে বলেছিল “দুবছরের চুক্তি তো বাবা । দুবছর পরে চলে আসবো ওদেরই
কোম্পানীতে’ । সেই
দুবছরটা সাতবছর হয়ে গেছে ।
সেদিনের
পর আর তাকে আসার কথা বলেনি অনিমেষ । অনিমা বিছানা নেওয়ার পর শুধু একদিন অনিমার
অসুখের সংবাদটা দিয়েছিল ছেলেকে । নিরুত্তাপ স্বরে ছেলে বলেছিল “সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাটা করাও, টাকার
জন্য চিন্তা করো না” ।
অনিমার
মৃত্যুর খবরটাও ছেলেকে দিতে চায়নি অনিমেষ । কি হবে ? ভেতরটা আর একবার খানখান হয়ে যাবে,
বুঝেছিল অনিমেষ । প্রতিবেশি প্রবীণ
দুলাল কাকা বলেছিল “ সে কি কথা
অনিমেষ, মায়ের মৃত্যুসংবাদ ছেলেকে দেবে না ? হাজার হোক গর্ভধারিণী মা তো ! ফোন
করেছিল অনিমেষ । কয়েকটি মাত্র শব্দ “তোর মা আজ ভোরে মারা গেছে”
আর কোন কথা বলেনি । ছেলে বলেছিল”আমি যাবার
চেষ্টা করছি, কিন্তু সেই আশায় দেহ ফেলে রেখো না, দাহ করে দাও । এখনই যাওয়ার ব্যাপারে আমি সিওর নই” । অনিমেষ
বুঝেছিল আসার চেষ্টা করছি বলে ছেলে বাবাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে । মায়ের শেষ
বিদায়ের সাক্ষি থাকতে ছেলে যে তার পাশে থাকছে না, সে কথা শুধু অনিমেষ কেন, সকলেই বুঝে গিয়েছিল । মৃদু কন্ঠে অনিমেষ শুধিয়েছিল “ দুলাল কাকা,
মুখাগ্নি কি আমাকেই করতে হবে” ?
ধীর পায়ে
দোতলায় শোবার ঘরে উঠে এলো অনিমেষ । কাজের মেয়ে দীপ্তি ফুলমালা দেওয়া অনিমার ছবিটা টেবিলে
ভালো করে রেখে নিজের ঘরে চলে গেলো । অনিমা অসুখে পড়ার পর থেকে দীপ্তি এখানেই থাকে
। দোকান বাজার রান্না ওই করে । অনিমেষ শূণ্য দৃষ্টিতে অনিমার ছবিটার দিকে চেয়ে
অতীতে ফিরতে চাইল ।
অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি ভেসে আসছিল অনিমেষের চোখে । কলেজে
পড়ার সময় থেকেই পরিচয় হয়েছিল সহপাঠী অনিমার সঙ্গে, ঘনিষ্ঠতা হতে দেরি হয়নি । গ্রাজুয়েশনের পর একটা চাকরী পেয়েই অনিমাকে নিয়ে
এসেছিল সে । মা-বাবাও
মেনে নিয়েছিলেন । বাবুর জন্মের পর সেই অনিমাই একটু একটু করে যেন বদলে যেতে লাগলো ।
বাবুকে ঘিরে অনিমা একটা নিজস্ব স্বপ্নের নির্মাণ করেছিল । মা মারা যাবার পর
নিঃসঙ্গ বাবাও তার নাতিকে ঘিরেই সুখ খুঁজতে চেয়েছিল । অনিমা তেমন ভাবেনি । জেদ
ধরেছিল,
সারাজীবন স্কুলমাষ্টারি করা দাদুর সান্নিধ্যে ছেলে তার মানুষ হবে
না । বাবা শুধু বলেছিলেন, “বেশ ওর মা
যদি মনে করে এখানে থাকলে বাবু মানুষ হবে না, তাহলে ওকে হোস্টেলেই দিয়ে দাও,
নিজের ভালো-মন্দ
নিজেই বুঝে নিতে শিখুক” । মা চলে গেছেন, নাতিকেও
দূরে সরিয়ে দিল অনিমা । অবসাদে আছন্ন বাবা শেষে অনিমাকে খুশি করতে অনিমেষকে বলেছিলেন, “আমাকে তুমি
কোন বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দাও, নাহলে তোমার জীবনটা সুখের হবে না । তোমার কোন খরচ
হবে না,
আমার যা পেনশন তাতে আমার কোন
অসুবিধা হয়ার কথা নয় । তবে আমার ইচ্ছা বৃদ্ধাশ্রমটা যেন একটু দূরে হয়” । অনিমেষের
মন মানেনি,
কিন্তু অনিমার জেদাজেদিতে মেনে
নিতেই হয়েছিল । দশ বছর আগে মাহালয়ার আগের দিন বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিল
অনিমেষ । অনিমার চোখমুখে তখন তখন কতটা খুশি ছড়িয়েছিল এখন আর তা
মনে পড়ে না । অনিমাকেই তো চলে যেতে হল তাকে ছেড়ে । বৃদ্ধাশ্রমে বাবাকে বেশিদিন
থাকতে হয়নি । বছরদুয়েক পরে একটা পোষ্টকার্ডে
বাবার মৃত্যু সংবাদ এসেছিল । সেই চিঠিতেই বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল
বাবা চাননি ছেলে তার মৃতদেহ স্পর্শ করুক বা মুখাগ্নি করুক ।
অনিমেষ ঘমোয়নি, ঘুমাতে পারেনি, সময়ের কোন হিসেবও ছিল না অনিমেষের কাছে । শেষ রাতে বোধয়
একটু তন্দ্রা এসেছিল । দীপ্তি দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল, চা নিয়ে এসেছে । চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল, দাঁড়ালো অনিমেষের ডাক শুনে । অনিমেষ বললো, “বুঝলি
দীপ্তি,
সময়ের কোন পক্ষপাত নেই । কাউকে
বেশি দেয় না,কমও নয়” । অনিমেষের কন্ঠস্বর যেন খুব স্বাভাবিক । দীপ্তি কিছু বুঝলো কিনা কে জানে ! শুধু অনিমেষের দিকে তাকিয়ে
ছিল ফ্যালফ্যাল করে ।