গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

প্রাপ্তি

অনিমেষ ভেবেছিল, একটা ক্ষীণ আশা করেছিল, মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অন্তত দু এক দিনের জন্য ছেলে আসবে । আমেরিকা থেকে আসা-যাওয়া তো এখন জলভাতের মত । ভুল ভেবেছিল আনিমেষ । দু মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইটা চালিয়েছিল অনিমা অনিমেষ বুঝেছিল অনিমার লড়াই করার পুঁজি ছিল একটা আশা । ছেলেকে কিছুক্ষণের জন্য কাছে পেতে চেয়েছিল অনিমা । হ্যাঁগো, বাবু আসবেনা ? কবে আসবে ? ফোন করেছিলে ?  মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল অনিমেষ, আসবে আসবে । এই তো সামনের মাসে ওর জন্মদিন । জন্মদিনে বাবুকে পায়েস খাওয়াবে তুমি ।
আজ দশদিন হল অনিমার লড়াইটা শেষ হয়েছে । শ্রাদ্ধশান্তির কাজটাও আজ মিটল । অতিথি অভ্যাগতরা চলে গেছে । অনিমার ছবিতে ফুলের মালাগুলো এখনও বেশ তাজা রয়েছে । অনিমেষ অনেকদিন আগেই বুঝেছিল ছেলে আর দেশে ফিরবে না । তবু যদি বছরে একবার অন্তত দু একদিন মা-বাবার সঙ্গে কাটিয়ে যেত ! এর বেশি কিছু ভাবেনি অনিমেষ । অনিমা তখনও বিছানা নেয়নি, ফোন করেছিল ছেলেকে বাবু এবছর তো একবারও এলে না । তোমার মা বলছিল দাদুভাইকে দেখলামই না, কত বড় হয়ে গেল ! তোমার ছেলেকে ওর দাদু-দিদাকে দুদিন আদর করার সুযোগ দেবে না ? এবার পূজোয় দিন কয়েকের জন্য এসো । ছেলে বলেছিল তোমরা একটূও বদলালে না বাবা । সেই পূজো-পার্বণ, রীতি-রিচুয়াল নিয়ে আছো । আমাদের ও সব মানতে গেলে চলে না বাবা । আমাদের শুধু ছোটা আর ছোটা । সেই ছোটা থামিয়ে সাতদিন পুরনো হুজুগে মাতা যায় না বাবা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল অনিমেষ । ভেবে পায় না, এতোটা অনাত্মীয় কি করে হয়ে গেল ছেলে তার ! এমন হবার তো কথা ছিল না । ছেলেকে ঘিরে কত স্বপ্ন ছিল তাদের । অনিমেষ চায়নি ছেলে বিদেশে যাক । অনিমাই বলেছিল যাক না । এতো পড়াশোনা করলো । এখানে পচে কি দাম পাবে ? ছেলে বলেছিলদুবছরের চুক্তি তো বাবা । দুবছর পরে চলে আসবো ওদেরই কোম্পানীতেসেই দুবছরটা সাতবছর হয়ে গেছে ।
সেদিনের পর আর তাকে আসার কথা বলেনি অনিমেষ । অনিমা বিছানা নেওয়ার পর শুধু একদিন অনিমার অসুখের সংবাদটা দিয়েছিল ছেলেকে । নিরুত্তাপ স্বরে ছেলে বলেছিল সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাটা করাও, টাকার জন্য চিন্তা করো না
অনিমার মৃত্যুর খবরটাও ছেলেকে দিতে চায়নি অনিমেষ । কি হবে ? ভেতরটা আর একবার খানখান হয়ে যাবে, বুঝেছিল অনিমেষ । প্রতিবেশি প্রবীণ দুলাল কাকা বলেছিল সে কি কথা অনিমেষ, মায়ের মৃত্যুসংবাদ  ছেলেকে দেবে না ? হাজার হোক গর্ভধারিণী মা তো ! ফোন করেছিল অনিমেষ । কয়েকটি মাত্র শব্দ তোর মা আজ ভোরে মারা গেছেআর কোন কথা বলেনি । ছেলে বলেছিলআমি যাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু সেই আশায় দেহ ফেলে রেখো না, দাহ করে দাও । এখনই যাওয়ার ব্যাপারে আমি সিওর নই। অনিমেষ বুঝেছিল আসার চেষ্টা করছি বলে ছেলে বাবাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে । মায়ের শেষ বিদায়ের সাক্ষি থাকতে ছেলে যে তার পাশে থাকছে না, সে কথা শুধু অনিমেষ কেন, সকলেই বুঝে গিয়েছিল । মৃদু কন্ঠে অনিমেষ শুধিয়েছিল দুলাল কাকা, মুখাগ্নি কি আমাকেই করতে হবে?
ধীর পায়ে দোতলায় শোবার ঘরে উঠে এলো অনিমেষ । কাজের মেয়ে দীপ্তি ফুলমালা দেওয়া অনিমার ছবিটা টেবিলে ভালো করে রেখে নিজের ঘরে চলে গেলো । অনিমা অসুখে পড়ার পর থেকে দীপ্তি এখানেই থাকে । দোকান বাজার রান্না ওই করে । অনিমেষ শূণ্য দৃষ্টিতে অনিমার ছবিটার দিকে চেয়ে অতীতে ফিরতে চাইল ।
অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি ভেসে আসছিল অনিমেষের চোখে । কলেজে পড়ার সময় থেকেই পরিচয় হয়েছিল সহপাঠী অনিমার সঙ্গে, ঘনিষ্ঠতা হতে দেরি হয়নি । গ্রাজুয়েশনের পর একটা চাকরী পেয়েই অনিমাকে নিয়ে এসেছিল সে । মা-বাবাও মেনে নিয়েছিলেন । বাবুর জন্মের পর সেই অনিমাই একটু একটু করে যেন বদলে যেতে লাগলো । বাবুকে ঘিরে অনিমা একটা নিজস্ব স্বপ্নের নির্মাণ করেছিল । মা মারা যাবার পর নিঃসঙ্গ বাবাও তার নাতিকে ঘিরেই সুখ খুঁজতে চেয়েছিল । অনিমা তেমন ভাবেনি । জেদ ধরেছিল, সারাজীবন স্কুলমাষ্টারি করা দাদুর সান্নিধ্যে ছেলে তার মানুষ হবে না । বাবা শুধু বলেছিলেন, “বেশ ওর মা যদি মনে করে এখানে থাকলে বাবু মানুষ হবে না, তাহলে ওকে হোস্টেলেই দিয়ে দাও, নিজের ভালো-মন্দ নিজেই বুঝে নিতে শিখুকমা চলে গেছেন, নাতিকেও দূরে সরিয়ে দিল অনিমা । অবসাদে আছন্ন বাবা শেষে অনিমাকে খুশি করতে অনিমেষকে বলেছিলেন, “আমাকে তুমি কোন বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দাও, নাহলে তোমার জীবনটা সুখের হবে না  তোমার কোন খরচ হবে না, আমার যা পেনশন তাতে আমার কোন অসুবিধা হয়ার কথা নয় । তবে আমার ইচ্ছা বৃদ্ধাশ্রমটা যেন একটু দূরে হয়  অনিমেষের মন মানেনি, কিন্তু অনিমার জেদাজেদিতে মেনে নিতেই হয়েছিল । দশ বছর আগে মাহালয়ার আগের দিন বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিল অনিমেষ । অনিমার চোখমুখে তখন তখন কতটা খুশি ছড়িয়েছিল এখন আর তা মনে পড়ে না । অনিমাকেই তো চলে যেতে হল তাকে ছেড়ে । বৃদ্ধাশ্রমে বাবাকে বেশিদিন থাকতে হয়নি । বছরদুয়েক পরে একটা পোষ্টকার্ডে  বাবার মৃত্যু সংবাদ এসেছিল । সেই চিঠিতেই বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল বাবা চাননি ছেলে তার মৃতদেহ স্পর্শ করুক বা মুখাগ্নি করুক ।
অনিমেষ ঘমোয়নি, ঘুমাতে পারেনি, সময়ের কোন হিসেবও ছিল না অনিমেষের কাছে । শেষ রাতে বোধয় একটু তন্দ্রা এসেছিল । দীপ্তি দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল, চা নিয়ে এসেছে । চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল, দাঁড়ালো অনিমেষের ডাক শুনে । অনিমেষ বললো, “বুঝলি দীপ্তি, সময়ের কোন পক্ষপাত নেই । কাউকে বেশি দেয় না,কমও নয়অনিমেষের কন্ঠস্বর যেন খুব স্বাভাবিক । দীপ্তি কিছু বুঝলো কিনা কে জানে !  শুধু অনিমেষের দিকে তাকিয়ে ছিল ফ্যালফ্যাল করে