গ্রামের
বাড়ি থেকে বাবাকে এনে আমার ফ্লাটে বসার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছি ! উনার আবার শুয়ে বসে
অস্বস্তি----ঝুলিয়ে রাখা চাই ! বেঁচে থাকতে ত আর উনাকে বাগে আনতে পারিনি এভাবে ;
তাছাড়া যখনই গ্রামের বাড়িতে বড়মুখ করে গেছি , তখনই দেখি কোমরে মোটা পাটের দড়ি
পেঁচিয়ে গাছের সাথে ঝুলছেন ! তবে ঋতুভেদে দৃশ্য দু’রকম ---শীতে খেজুর আর গ্রীষ্মে
তাল । তবে তালে ছুঁলে বাঁশ ! আমি
আমার স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই----‘ যাক , এই বয়সে
পৃথিবীর সকল বুড়োবুড়িরা যেখানে তাদের সন্তানদের কাঁধের ওপর জড়ানো জটের মত ঝুলছে ! ---আর
আমার বাবা সেখানে ,---দেখেছ কতটা স্বতন্ত্র !’ আমার শহরচোষা চোখ মাঝেমাঝে খেজুর
গাছগুলোকে দেখলে লজ্জাও পেতো ! বিশেষকরে মাসের শেষে টাকার তাড়া নিয়ে আমি যখন
স্ত্রীর কোলঘেষে বসতাম ; উনি বড়মুখ করে কোনদিন আমার কাছে একটি বিড়িও চাইত না---
টাকা তো দূর অস্ত , কোনও কিছুর প্রয়োজন হলেই দেখতাম, ঠোঙায় ঠিলে ঝুলিয়ে নিয়ে
চড়চড়িয়ে গাছে উঠছেন ! ইচ্ছা থাকলেও তখন
খেজুরগাছগুলোর জন্য মৃত্যু কামনা করতে পারতাম না ! বাবার সাত সন্তান আমরা ; সাত
দিক থেকে ঝড়ে পড়া আম জামরুলের মত সুনাম সুখ্যাতি কুড়িয়ে আনার চেষ্টা করতাম আমরা ;
কিন্তু বাবার হাতে তৈরী শীতের নলেন গুড়ের সৌরভ সুখ্যাতিকে আমরা টেক্কা দিতে পারিনি
কোনদিনই !
শীত
এলে মাঠের চেহারা যেত পাল্টে । সর্ষে ক্ষেতের আলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো মুচকি
মুচকি হাসত ; ---কেউ পোয়াতির মত পেট উঁচু করে , কারো বা দু’চোখ ভরা পিচুটি ; কেউ
আবার গোপালের মায়ের মত মাজাভাঙ্গা ; কেউ কেউ ভগীরথের মত ডাকাবুকো ---কেঊ বা রেশন
না পাওয়া আলোবাতাসহীন আশ্রয়হীন জীর্ণ শীর্ণ ভিখারি তরিবালার মত ঠায় দাঁড়িয়ে !
কুয়াশার বুকচিরে শনশন করে বাতাস বইত যখন , বুঝতে পারতাম---এইমাত্র বাবা বুঝি ওদের
চুল আঁচড়ে দিয়ে গেলেন ; কী খোলতাই না লাগছে ওদের মাথাগুলো ! দীর্ঘ অশৌচান্তের পর , গ্রামের মায়েরা যেমন নখ খুঁটিয়ে মাথাঘষে
স্নান করে, তেল সিঁদুর মেখে ঘরে ওঠে ---- ঠিক যেন অমন ফুরফুরে দেখতে লাগত তখন
মাঠের সমস্ত গাছেদের মাথা দোলান ! পোড়ামুখি ভাঁড় পুড়ে পুড়ে খয়ের হয়ে উঠত ; আর
জেলোর কানাছাপিয়ে উতলে উঠত গরম জিরেন রস ! সাপের ফনার মত লম্বা খেজুরের ছড় দিয়ে উঠোনের মাঝখানে বসে গুড় ঘুটতেন বাবা –--কী অদ্ভুদ
সেই শব্দ ! শিশু বয়েসে কিছুতেই মেলাতে পারতাম না --- গরম গুড়ের ঘাইমারা শব্দটা
আসলে কিসের মত ! বড় হয়ে সংসার পেতে এখন মিলিয়ে নিতে পারি এসব শব্দের সারাৎসার !
- স্যার , এসব গল্প শহরে বসেই লেখা হয় !
আমি বলছি এই গুড় খাঁটি ; আপনি বিশ্বাস করে একবার নিয়ে দেখুন ঠকবেন না !
- দাঁড়াও , বাবাকে একটু দেখিয়ে আনি । ভদ্রলোককে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে গুড়ের পাত্রটা নিয়ে একচ্ছুট্টে বাবার কাছে এলাম । সন্তানের কাছে বাবারা মরেনা কোনও দিন ---আমার তো তাই বিশ্বাস ! এ জন্য ভালোমন্দ সমস্তকিছুর মতামত নিতে এখনও বাবার কাছেই ছুটে আসি ।
- দাঁড়াও , বাবাকে একটু দেখিয়ে আনি । ভদ্রলোককে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে গুড়ের পাত্রটা নিয়ে একচ্ছুট্টে বাবার কাছে এলাম । সন্তানের কাছে বাবারা মরেনা কোনও দিন ---আমার তো তাই বিশ্বাস ! এ জন্য ভালোমন্দ সমস্তকিছুর মতামত নিতে এখনও বাবার কাছেই ছুটে আসি ।
- না গো ! আপনার গুড় ঠিক
নেই !
- কে বললেন ? আপনার বাবা ? উনাকে একটু বাইরে আসতে বলুন না !
- না ! উনি বাইরে আসতে পারলে তো আর আপনাকে ডাকতাম না !
- কে বললেন ? আপনার বাবা ? উনাকে একটু বাইরে আসতে বলুন না !
- না ! উনি বাইরে আসতে পারলে তো আর আপনাকে ডাকতাম না !
লোকটা ভারি নাছোড়বান্দা ! পরদিন আবার এসে
হাজির ! কে যে ডেকে দাঁড় করায় কে জানে !
- স্যার আপনার বাবার কাছে
একটু যেতে পারি ?
- ক্যান পাটালি এনেছেন
বুঝি ? দিন আমার কাছে দিন –আমিই নিয়ে যাচ্ছি ! সারাঘর নতুন নলেন গুড়ের পিঠেপুলর
গন্ধে যেমন গ্রাম্য দামাল শিশুরা হামলে পড়ে ; কিছুক্ষণের জন্যে বাবার ছবিটাতেও অমন
একটা চেনা অস্থিরতা ফুটে উঠল !
- এ আপনি কোথা থেকে এনেছেন
?
- স্যার আগে খুলে তো দেখুন
!
- আরে মশাই ! খুলব কিনা সেটা
আমার ব্যাপার ; কিন্তু কোথা থেকে এমন জিনিস এনেছেন সেটাই তো আপনাকে জিজ্ঞাসা
করছি---!
- বাংলানী ভাঁটা থেকে !
রসিকতা করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা খেয়েছে বুঝে , গুড়আলা থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল ,
- স্যার ! অন্যায় হয়ে গেছে
, আর এমন হবে না ! আজকের মত মাফ করে দিন ! বুঝতে পারিনি আপনার বাবা------!
আজ বাবার মৃত্যু বার্ষিকী বলে কথা !
সন্তান হিসাবে কিছু তো একটা কর্তব্য আছে আমার ! বিশেষকরে তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছে ----!
দ্রুত বাবাকে দেওয়াল
থেকে নামিয়ে গাড়ির মাঝের সীটে বসিয়ে , গুড় আলাকেও তুলে নিয়েই গাড়ি হাকালাম জোরসে !
পড়ন্ত বিকেলের রোদ সরিয়ে একসময় পৌঁছলাম বাংলানী ভাঁটায় ! গ্রামীন ফায়ার ব্রিক্সের
একটি নতুন কারখানা ! ধুধু করা আবছা চেনাচেনা গ্রাম---- সন্ন্যাসীর শেষ বসনখানি
চুরি গেলে তাঁর চোখে মুখে যেমন দিগম্বর উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়----এখন ঠিক তেমনই
! একের পর এক লরি , ম্যাটাডোর বোঝাই হয়ে আসছে খণ্ড খণ্ড খেজুরগাছের গুড়ি---ফিরতি
টিপে বোঝাই হয়ে শহরমুখী হচ্ছে পোড়া ইট !
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবার সাথে আমিও
দেখছিলাম,----- তাঁরই হাতে লালিত রসরাজ সন্তানদের শেষ কৃত্য ! আর তাদের আত্মাহুতির
অদ্ভুত চেনা গন্ধ--------------!!