গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৭

উত্তম বিশ্বাস

 চোরাচালান

 গোপনে আনেক চিঠি চালাচালি করার পর অবশেষে তাদের গোপন ডেরায় প্রবেশের অনুমতি পেলাম । মাহাতোপাড়ার কৃষ্ণপতি টাড়বাড়োর ভুয়ো এনকাউন্টারে মৃত্যুর পর পৃথিবীর সকল হিংস্র প্রজাতিই এখন একটু বিশেষরকম সতর্ক ! তাদের উল্লিখিত শর্ত সকল মেনে নিলাম বটে , কিন্তু নারীসঙ্গ ছাড়া আমার ব্যবসায়িক বুদ্ধি একেবারে পঙ্গু ! অর্থাৎ পুনরায় বিবেচনা করার জন্য অযাপিল করা হলে , তাদের পক্ষথেকে মিডিয়া এবং ক্যামেরার ব্যাপারে কোন ছাড়পত্র পাওয়া গেল না । গভীর রাতে নোনাজল কেটেকেটে আমাদের বোট যখন পর্যটনখাড়ি ও ওয়াচটাওয়ার অতিক্রম করে বনবিবি দ্বীপে নোঙর ফেলবে ঠিক সেই মুহূর্তে শ্বাসমূলে খোঁচা খেয়ে নৌকার তলা গেল ভেঙে ! আমি সাঁতরালাম , আর আমার নারী সঙ্গী আমাকে শামুকের মত আঁকড়ে নোনাজল ভাঙবার চেষ্টা করল ! হোগলাপাতার চাটাইতে আমাকে যখন শুইয়ে দেওয়া হল তখন পূর্ব আকাশের কয়েকটি তারা নিভে গেছে । ক্ষুধিত পৃথিবীর কোলে তারাদেরও জেগে থাকায় বড় অনীহা ! যাই হোক , বনবিবি আমাকে খেতে দিল কাঁকড়ার ডিম আর মধু । শিওরে সে এমনভাবে বসে আছে যেন চিন্তাসুখে আনত আমার স্ত্রী ! একে তো ফাগুন মাস , তার ওপরে রাত্রে মধু !  হেতালগাছের সুদীর্ঘ ছায়া আর বনবিবির দ্বাদশীর চাঁদের মতো মুখের আড়ালে আমার নারীসঙ্গীকে আর দেখা যাচ্ছিল না । ঘুম আসছিল না কিছুতেই । অদূরে একটি টিলার ওপরে এসে বসলাম । আমার দেখাদেখি এসে বসলেন এ ডেরার ব্যাঘ্রবর্ষীয়ান নেতা । আমি সম্মোহিত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই উনি হুঙ্কার দিয়ে আমাকে বসতে বললেন ! সে হুঙ্কারে যতটা পাশবিকতা তারচেয়ে অধিক শহুরে সৌজন্য মিশ্রিত ! আমার চমক ভাঙল বনবিবি , সে ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি টেনে বলল ,-- অবাক হলেন ? উনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর কোলকাতার চিড়িয়াখানায় কাটিয়ে এসেছেন, ---এটুকু তারই প্রভাব আর কি ! আপনাদের যে জন্যে আগমন সে ব্যাপারে এবার কথা শুরু করতে পারেন । আমি আমার নারী সঙ্গীকে আর জাগালাম না , বনবিবির হাত ধরে বেতসকুঞ্জ চিরে এগিয়ে চললাম বাঘেদের ভিটেমাটি ঘরদোর অসুখবিসুখ অনুসন্ধানে !

বনবিবি আসলে আর কেউ না ; ও হল আমাদের মত গৃহপালিত জীব ও বন্য জন্তু  জানোয়ারের মধ্যস্ততাকারি দোভাষী ---  স্বামী সমাজ পরিত্যক্তা নির্জন দ্বীপের এক বাসিন্দা ! এই তো এখুনি গল্প শুনতে শুনতে এলাম,--- স্বামী তার ভবঘুরে বন কর্মী । হঠাত একদিন এক মধুশিকারির মোহে পড়ে সুসজ্জিত বনবাংলো ছেড়ে আজ আশ্রয় নিতে হয়েছে এমন এক ভাঙ্গাচোরা হোগলাপাতার চালায় ! বেচারা লম্পট মধু শিকারি ! জীবনটা তো হারালোই ; সেইসাথে টুকরো টুকরো মাথার মাংস ঢুকে গেছে সেই কোনকালে বাঘের পেটে !---আর বন কর্মী স্বামী তার কোন খাঁড়িতে ভাসে গেছে কেউ জানে না ! দীর্ঘ বনবাস জীবনে , বাঘের ডেয়ায় থাকতে থাকতে বনবিবির গায়ে এখন কেমন যেন একটা আদিম বুনো বুনো গন্ধ , আর কেয়া ফুলের মৌতাত  মাদকতা ! সমস্ত বন্যপ্রাণীর ভাষা ও দারুণভাবে আয়ত্ব করে ফেলেছে ----বিশেষত মাংসাশী প্রাণীদের সাথে ওর সখ্যতা অত্যন্ত প্রগাঢ !  
একটা বুনো চামাটে গন্ধ প্রত্যাশা করেছিলাম এ মহল্লায় । কিন্তু না, কোথাও তার লেশমাত্র নেই সর্বত্র ছিমছাম আর ঘুমপাড়ানিয়াগুলির বারুদের গন্ধে ভরপুর ! একটা ঢিবি অতিক্রম করতেই নজরে এল কিছু অল্পবয়সী ব্যাঘ্র বতসের জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা ! কোনও অনুন্নত মুসলিম কিম্বা আদিবাসী পাড়াতে গেলে তাদের সন্তানাদির যেমন অবস্থা কারও নজর এড়ায়না ,ঠিক তেমনই ! অদুরে ধূসরিত ঢিপির ওপরে আলুথালু শুয়ে আছে কয়েকটি বাঘিনী --, বুঝলাম ; ওদের মা ! গোসাবা সন্দেশখালি হিঙ্গল গঞ্জ বাসন্তির অনাহার ক্লিষ্ট পরিবারের প্রসূতি মায়েরা যেভাবে কালিপড়া নিরাসক্ত চোখে একজন গাইনো ডাক্তারকে পর্যবেক্ষণ করে দূর থেকে ওরাও তেমন আমাকে দেখতে পেয়ে পাশমোড়া দিয়ে আবারও শুয়ে পড়ল ! আমি জানতে চাইলাম---এদের এমন হাল কেন , ঠিকমতো খেতে পায় না ?” বাঘেদের পিতামহ চোয়াল ভার করে অভিযোগ তুললেন---ওই দেয় নরম চিকেন আর সপ্তাহান্তে চালানি গোরুর মাংস ! এতেও আজকাল এমন সব মেডিসিন মেশানো ওরা খেতে চায় না । আর যদিও কেও খায় তারা সব অদ্ভুত কেমন আচরণ শুরু করে দেয় ; ঠিক যেন মঠে পালিত
সন্যাসিদের মতো !
- ওরা নিজেরা শিকার করলেই পারে ?’
--‘ কাকে শিকার করবে ? জেলে আর মধু সন্ধানীরা এখন আর খুব একটা আসতে পারে না ! ওয়াচটাওয়ারে ভীষণ কড়াকড়ি ! তারজাল ডিঙিয়ে মানুষের ঘরে উঁকি মারতেও অনীহা ! কেননা ওদের ঘরেও বাচ্চাকাচ্চার চরম আকাল ! হরিণ আর বনমোরগের গায়ে ট্যাগ লাগানো ; ওর পেছনে ছুটলেই ঘুমপাড়ানে গুলির ভয় আছে ! তাছাড়া যারা একটু তাগড়াই আর শিকারের উপযুক্ত হয়ে ওঠে , অমনি তাদের খাঁচাবন্ধী করে চালান করে দেওয়া হয় শহরের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় ! সেলফি আর ফটোশুটের ঝলকে ওদের চোখে ছানি পড়া না পর্যন্ত এই সুন্দরবনে আর ফেরত পাঠানো হয় না ! ব্যাঘ্র বর্ষীয়ান প্রপিতামহের হয়ে জবাব দিতে দিতে একটা অপেক্ষাকৃত নাদুসনুদুস বাঘের বাচ্চা আমার নারী সঙ্গীর কোলে দিলে বনবিবি ! আমার নারী সঙ্গী তার আঁচলের খুটে পরম মমতায় তার গায়ের উসকোখুসকো পশম এবং চোখের পিচুটি মুছে দিতে দিতে এগিয়ে চলল ! আমার নারী সঙ্গিনী অত্যন্ত স্নেহবৎসলা হৃদয়ের অধিকারিণী ; পাথরও বিগলিত হয় শ্রাবণ ধারায় ! শাবকটির তুলতুলে শরীরের উষ্ণতা মাঝে মাঝে আমিও অনুভব করতে থাকলাম 
!  
গভীর মনযোগ সহকারে প্রবীণের কথাগুলো শুনলাম এবং নোট করে নিলাম ; এবং প্রমিস করলাম শহরে গিয়ে আপনাদের প্রজাতি বিলুপ্তির সম্ভাব্য কারণগুলি নিয়ে সরকারের সঙ্গে একটি জরুরি বৈঠকে বসব ! ব্যাঘ্র পিতামহ কৃতার্থ হয়ে একদলা হরিণের মাংস এগিয়ে দিলেন আর করমর্দনের জন্যে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন । লক্ষ্য করলাম ওঁর হাতের থাবায় সেই আদি রাজকীয় নখ আর একটিও নেই ! সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করলাম—‘ আপনার বাচ্চাকাচ্চারা এমনিতেই শুনছি খেতে পায় না ! খামোখা আমাদের জন্য হরিণটা হত্যা করার কি দরকার ছিল ! থাকলে তো অসময়ে ওরা একবেলা খেতে পার? 

উনার সহাস্য উত্তর—‘ এখানকার হরিণদের আপনি চেনেন না মশাই আজকাল খুব ফ্যাশান বেড়ে গেছে ওদের ! মাঝে মাঝে এমন ভাবখানা দ্যাখায় যেন ওদের গতরদোলান পর্যটনের টাকাতেই সরকার টিকে আছে ! আচ্ছা বর্তমানে আপনার শহরে বাঘের সংখ্যা কতো আছে বলুন তোঁ ?'' আমি একদম চুপ করে রইলাম । বনের গভীরথেকে বনমোরগ ব্যাং দিয়ে উঠল---'' কক্কোর---কক ! ' ব্যাঘ্রপিতামহ হেসে বললেন,--'' আচ্ছা বুঝেছি লক্ষ্য লোক !''

এই মুহূর্তে হাতখানা বুকপকেটে ঢুকোতেও লজ্জা পেলাম ! রাত আর বেশি নেই , এবার উঠতে হবে । দেখলাম আমার নারিসঙ্গী ঘুমভেঙে উঠে সুন্দরী গাছের পাতার মতো একখানি বাহারি শাড়ি পরে নৌকোর গলুইয়ে ভীষণ অস্থিরভাবে পা নাচাচ্ছিল ; আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার রোমশ বুকের মধ্য হাজারো শ্বাসমূল উঁকি দিয়ে উঠল ! খাঁড়িতে তখন অল্প জল আর খিলিখিলি ঘোলা ! আমি রোমাঞ্চিত মুহূর্তকে শেয়ার করবার জন্য আমার নারী সঙ্গীর হাতের মধ্যে হাতখানি গুঁজে দিতে গিয়েই খচ করে একটি কামড় খেয়ে চিৎকার করে উঠলাম ! ও সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতে আমার মুখটা চেপে ভর্তসনার সুরে বলল,-- চুপ চেঁচিও না ! মাথামোটা ! বাচ্চা আছে , কাপড় উঁচু কর না !
 নৌকো চলতে শুরু করেছে । উঁচু পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রইল বনবিবি ! ওর চোখ মুছতে নেই ! সে জানে,--- নোনাজলে ঘন ঘন শাড়ির আঁচল চোবালে তা টিকবে কেমন করে ?!!