তরুণ
শ্রীবাস মাঝির নৌকায় প্রায় পারাপার হয় সোনাদিদিমণি । তাতে খুব খুশী শ্রীবাস । ওর
চোখেমুখে খুশীর ঝিলিক দেখলেই বোঝা যায় । অন্যদিকে সোনাদিদিমণিও ওকে উপেক্ষা করতে
পারে না । দুজন চোখাচুখি হলে সেও স্মিত হাসে । তবে তার হাসির নিয়ন্ত্রণ বেশ বোঝা
যায় । কারণ তার সাথে আরও কিছু সহকর্মী থাকে ।
দিনে-দিনে
সোনাদিদিমণির প্রতি শ্রীবাসের আকর্ষণ বাড়তেই থাকে । তাকে ওর খুব ভালো লাগে । তবে
শ্রীবাসের মনোভাব সোনাদিদিমণি সেভাবে কিছু বোঝে না । শ্রীবাসের হাসির উত্তরে তার
মুখে শুধু নিয়ন্ত্রিত হাসি । তবে কোন-কোন সহকর্মী দুজনের হাসাহাসি লক্ষ্য করে মজা
পায় ।
এই
সেদিন রূপাদিদিমণি বলছিল সোনাদিদিমণিকে,''একটা
জিনিস বোঝো কি তুমি ?''
অবাক
হয়ে সোনাদিদিমণি জিজ্ঞেস করে,''কী গো ?''
তখন
রূপাদিদিমণি এক-গাল হেসে বলে,''শ্রীবাস কিন্তু
তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে । ওর হাসি লক্ষ্য করে দেখো । বেশ মায়া-মায়া আর
তন্দ্রা-তন্দ্রা । ভালোবাসার আভাস আর কি ।''
শুনে
লজ্জা পায় সোনাদিদিমণি ।
সলজ্জ-হেসে
বলে,''কি যে বল । বুঝি না ছাই । আসলে শ্রীবাস খুব
ভালো ছেলে বলেই আমার মনে হয় ।''
এর
কয়েকদিন পর শ্রীবাস একদিন সোনাদিদিমণিকে দেখে অনাবিল হেসে বলে,''আপনারে আমার খুব ভালা লাগে । কি যে ভালা লাগে আমার । কইতে পারি না ।
চুখে জলও আইস্যা পড়ে ।''
শ্রীবাসের
কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সোনাদিদিমণি ।
খুব
আগ্রহের সঙ্গে শ্রীবাসকে বলে,''সে আমাকে তোমার
ভালো লাগতেই পারে । মানুষেরই মানুষকে ভালো লাগে । কিন্তু চোখে জল আসার ব্যাপারটা
বুঝলাম না । খুলে বল আমাকে ।''
তারপর
শ্রীবাস অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে । চোখ বুজে ফেলে । অবাক হয়ে সোনাদিদিমণি শ্রীবাসের
দিকে তাকিয়ে থাকে । হঠাৎ দেখে শ্রীবাসের গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে ।
সোনাদিদিমণি
আলতোভাবে ধাক্কা দেয় শ্রীবাসকে ওর সম্বিৎ ফেরানোর জন্য । তারপরেই শ্রীবাস চোখ-ভরা
জল নিয়ে বলতে থাকে,''সে অনেকদিন আগের কতা,দিদিমণি । আমরা ছিলাম দুই ভাই-বোন । আমি ছুটু । দিদি আমার চাইয়া কিসু
বয়াসে বড় । ওর বিয়া হয় । কিন্তুক দু'বছরে মদ্যি অ সোয়ামির
ঘরে গায়ে আগুন দিয়া নিজেরে শ্যাস করে । আপনার মুখডা ঠিক আমার সেই দিদির মুতো ।
একেবারে লক্ষ্মীঠাকুর । আপনারে দেখি আর অবাক হই । এহানেই আমার আনন্দ,এহানেই আবার দুক্ক ।''
শ্রীবাসের
কথা শেষ হলে সোনাদিদিমণি একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
তারপর
শ্রীবাসের হাত ধরে তৃপ্তির হাসি হেসে বলে,''আজ
থেকে তুমি আমার ভাই । আর ধর তোমার সেই দিদি আমিই । আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ক
পরমায়ু পাক । এসো,আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি ।''
শুনে
শ্রীবাস চোখের জল মুছতে মুছতে বলে ওর সদ্য-প্রাপ্ত দিদি সোনাকে,''তবে এগডা কতা আচে আমার । কই ?''
সোনা
হাসতে হাসতে বলে,''কইয়া ফেলো তাইলে । কী
কইব্যা ?''
''আমি
কিন্তুক এরপর থেইক্যা পারের ভাড়া নিমু না তুমার কাচ থিকা ।''
সোনা
তখন আবার শ্রীবাসের হাতদুটো ধরে এক-মুখ হাসি নিয়ে বলে,''আমি তো দিদি । তোমার থেকে আমার আয় ঢের বেশী । এমন ভাবলে হয় ? তবে মাসের চারদিনের ভাড়া আমি দেবো না । ওই ঠিক আছে । তাই তো ?''
তাতেই
রাজী শ্রীবাস ।
এক-মুখ
সরল হাসি হেসে সোনাকে,''তাইলে তাই হইব । তুমি
ভাইয়ের জুন্যু কত ভাবো । এ আমার কপাল ।''
পরে
শ্রীবাসের কথা সোনাদিদিমণি রূপাদিদিমণিকে বলে খুব আনন্দের সাথে ।
সে
শুনে হেসে উত্তর দেয়,''খুব ভালো কথা গো ।
তাই তো রবি ঠাকুর লিখেছেন,'অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে /
অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে' । তোমার সেই অচেনাকে
তবে চেনা হল কি দারুণভাবে । আমার কী আর সে কপাল আছে ?''
রূপাদিদিমণির
দু'চোখে জলের আভাস দেখা গেলো তার কথার পরেই । তবে
সোনাদিদিমণি তার কাছে কিছু জানতে চাইলো না তখন । হয়তো সে ভাবল,নিজের আনন্দটা আগে উপভোগ করি । তারপর ওরটা জানা যাবে । সময় তো আর বয়ে
যাচ্ছে না ।