এই
বিদেশেই এক গুজরাতির মুখে শুনেছি, বাঙালিদের নাকি খুব
ঠান্ডা লাগে। আমি অভিযোগ বা অনু্যোগ করার পাত্রী মোটেই নই। আমার এই বিশ্রী স্বভাবের
জন্য যে, জীবনের রাস্তাঘাটে কত মার খেয়েছি বা এখনও খাচ্ছি
তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, “ইজ্জত যায় না
ধুলে, আর স্বভাব যায় না মলে” তার
জ্বলন্ত উদাহরণ মনে হয় আমিই। এটাই বিশ্বাস করি মনে প্রাণে যে, 'চুপের বড় বাড় নেই'। কাজেই সেইটাকেই ধরে থাকি আর
ব্রত করেছি যতদিন প্রাণ থাকে এই পৃথিবী্তে, এইভাবেই থাকব।
আসল কথা কিন্তু বড্ড দেরী তে বলি আমি, ওই আমার বিরাট এক দোষ।
আসলে আজ আমি এক মোহিনী ভালবাসার রঙের কথা বলব- বলে লিখছি...
খুব ঠান্ডা লাগাতে ডাক্তারের এ্যপয়েমেন্ট করেছিলাম। দিন ও সময় ধার্য
হয়েছিল, ৫-ই জানুয়ারী ২০১৭,সকাল দশটা ৩৫ মিনিট। হাজির হলাম ।
বাঙালিয়ানাকে
যেভাবে সাপটে ধরেছি আজকাল, একটু দেরীতেই পৌঁছালাম।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, বাঙালি সময়ের তোয়াক্কা করে না। কাজেই
আমি মুক্তমনা বাঙালিনী একগাল হেসে হাজির হলাম রিসেপশানিস্টদের জানলায় বেশ কুড়ি মিনিট
সময়ের পরে। প্রকৃ্তির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমায় আমি পল্লবিত সেই সময়। সাথে
আছেন আমার হাজবেন্ড। দুজনেরই এ্যনুয়াল ফিজিক্যাল চেক আপ-ও
করার কথা। তিনি তো আমাকেই এগিয়ে দিলেন। আমার হয়ে গেল চেক আপ, আমি বাইরে চলে এলাম। এবার আমার হাজবেন্ড এর ডাক পড়ল। তিনি ও ভেতরে চলে গেলেন
নার্স-এর সাথে সাথে। বেশ কয়েকজন অপেক্ষমান পেসেণ্টদের সাথে
বসে আছি। তিনটে ইংলিশ (হেলদি লিভিং, টাইমস, কসমোপলিট্যান) ম্যাগাজিন-রা ফটাফট শেষ হয়ে গেল। আমার পড়া তো একেবারে
বই এর ভেতরে ঢুকে যাওয়া। পাশ বা পেছনদিক থেকে কেউ ডাকলেও কিন্তু কানে যায় না। কারুর
কিছু জিগ্যেস করার থাকলে একেবারে পাশে এসে জিগ্যেস করে। না! না! প্লিজ হাসবেন না, এইটাই অভ্যেস ছোটবেলা থেকে। প্রথম যখন এই দেশে অফিসের কাজে ঢুকি,
তখন তো একেবারে বোধহয় এত বেশী কাজের মধ্যে ঢুকে যেতাম যে,
কাজ আর আমার মধ্যে দূরত্ব থাকত এক চুলের। সুপারভাইজারের নির্দেশে(বকুনির পর্যায়ে) লাঞ্চ ব্রেক আর লাঞ্চ এর পরে ১৫
মিনিটের গ্যাপে কলিগদের সাথে যেন আমায় কথা বলতে দেখেন। বোঝো ঠ্যলা!!
যাই হোক, হঠাৎ চোখ তুলে দেখি আমি ছাড়া আর
কোন পেসেন্ট নেই আশে পাশে। একজন আমেরিকান বয়স্কা ভদ্রমহিলা নিঁখুত সাজসজ্জায় এসে আমার
ঠিক সামনের চেয়ারে বসলেন। স্যুটের ল্যাপেল এ নেম ট্যাগ দেখে বুঝলাম ওনার নাম লিন্ডা
রাসেল।
তাকালাম
ওনার দিকে। উনি তো বসেই চোখ মেরে একগাল হাসি উপহার দিলেন। কথা বলার জন্য উশখুশ করতে
লাগলেন, এদিকে আমিও। কিন্তু কে যে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে বা
কী নিয়েই বা বলবে এই দোলায় দুজনেই দুলতে লাগলাম। এই হাসি মুখের ফোয়ারা দেখতে পাওয়ার
জন্যই এই দেশটাকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পরে মিস লিন্ডার ডাক পড়ল। উনি ভেতরে
গেলেন এবং ৩৫ মিনিট পরে ফিরেও এলেন। আমাকে তখনও বসে থাকতে দেখে সোজা আমার কাছে এলেন।
ওনাকে প্রথম দেখেই খুব ফ্রেন্ডলি লেগেছিল আমার। এসে জিগ্যেস করলেন, “হাউ আর ইউ? হোয়াটস ইয়োর নেম? ডিয়ার।” এরা পরিচিত অপরিচিত কাউকেই ভালো লাগলে
প্রথম দর্শনেই 'হানি বা ডিয়ার' বলে
সম্বোধন করে। যেটা নিজেদের মধ্যে আড়ষ্টতাকে টিকতে দেয় না,
মোটেই। -হেসে বললাম; “মাই নেম ইজ সীমা রে, আই এ্যম ওকে।” একটু উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে জিগেস করলেন, “আই সি দ্যাট
ইউ আর স্টিল ওয়েটিং? হোয়াট হ্যাপে...ন্ড?” আমি ওনার প্রশ্নের উত্তরে বললাম,
“মাই হাজবেন্ড ইজ ইনসাইড, উইথ এ ডক্টর নাও।
আই এ্যাম ওয়েটিং ফর হিম।” -ওহ! মাই
গড। হোয়াই ইট ইজ টেকিং সো লং? আই অ্যাম আসিউমিং সামথিং ইজ
রং। ইউ শ্যুড গো এ্যহেড, হানি। এ্যন্ড আস্ক দ্য রিসেপশানিস্ট
এ্যবাউট ইয়োর হাজবেন্ড।” আমিও বললাম, “ওকে, লেট মী চেক, থ্যাঙ্কস
ম্যাম।” এ যেন দীর্ঘ কোনো কণ্ঠস্বর। তেজী স্রোতে আদেশের ভঙ্গিতে
বল্লেন, “প্লিজ, চেক রাইট নাও। আই
অ্যাম হিয়ার উইথ ইউ, হানি।” এই কথা
শুনে মনে হল এক গোয়েন্দা নাম না জানা পাখী ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে বসলো আমার কানে। আমি
তখনই রিসেপশানিস্টকে জিগ্যেস করলাম। সে ও ফোনে কথা বলে আমাকে বলল, “ইফ ইউ ওয়ান্ট, ইউ ক্যান গো ইন সাইড।” আমি মিস লিন্ডার দিকে তাকিয়ে বললাম নার্সকে, “ ইয়েস, অফ কোর্স। আই ওয়ান্ট টু নো হোয়াট ইজ গোইং
অন ইন সাইড।” এমনিতেই বড্ড নার্ভাস আমি। কয়েক মিনিট আলোড়ন?
মনকে কন্ট্রোল করতে বললাম। তারপর হৃদয় শূন্য করে বলে উঠলাম,
“কি হল রে বাবা! সত্যি তো এত দেরী কেন হচ্ছে?”
আমি ওনাকে বাই, থ্যাঙ্কস জানিয়ে ধুকপুকানি
বুকে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি উনি আমাদের প্রাইমারি ডাক্তার আর নার্স এর
সাথে জমিয়ে আড্ডা মারছেন। কারণ তখন সবার ছুটি হয়ে গেছে। আমি যেতেই সবাই বুঝতে পারল
যে টাইম আপ। দুজনে বাইরে বেরিয়ে এলাম প্রায় দশ মিনিট পরে। বাইরে এসে দেখি তখনও দাঁড়িয়ে
আছেন মিস লিন্ডা। চোখে জল এসে গেল ওনাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। নেম ট্যাগ আছে
মানে সোজা অফিস থেকে এসেছেন। উনি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে বললেন, “ইউ আর জাস্ট লাইক মাই এলডেস্ট ডটার। সো, অ্যাজ
এ মাদার'স ইন্সটিঙ্কট' হাউ ক্যান
আই লিভ ইউ এ্যলোন ইন এ সিচুয়েশন লাইক দিস।”
কী
উত্তর দেব সে ভাষা তখনকার মতন হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওই যে সারদা মা বলেছেন না,
“আমি এমনি এমনি 'মা' না, আমি সবার মা।” সত্যি
নিজের সন্তানের মা হয়ত অনেকে হতে পারে, কিন্তু পরের সন্তানের
'মা' হওয়া কি মুখের কথা? আজ আমি হাতে নাতে তার উদাহরণ পেলাম। সত্যি তো কজন হতে পেরেছেন সত্যিকারের
মা? সেই মুহূর্তে নিজের মনটাকেও মনে হয় এক পলক সত্যি। এ রকম
সত্যি পৃ্থিবীতে বেশ কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এইরকম ভালবাসার রঙ তো ঠিক সেই রামধনুর
রঙের মত। আমার প্রবাস বাসের এরকম মধুর অভিজ্ঞতা যেন লেবুর পাতার ঘ্রাণে এক ঝিকমিকে
জ্যোৎস্নাময়ী রাত। এরকম জীবনে আচমকা ভালোবাসার খজ্ঞনী বাজতে থাকলে স্যুইভেল চেয়ারে
বসে কবি হতে কে না চায়?