প্রচন্ড
এক শীতের রাত। রাত দশটা বেজে গেলেও উঠোনের কলতলা থেকে বাসন নিয়ে ঘরে না ঢোকায়, মাধবী চিৎকার জুড়ে দিলেন।
শহরের
একপ্রান্তে দুঁদে পুলিশ অফিসার স্নেহময় দত্তের বাস। লোকে বলে তার প্রতাপে নাকি
এখনও বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়। তিন বছর আগে পাঁচ বছরের অণিমাকে রেখে মাত্র
কয়েকদিনের জ্বরে কণিকার মৃত্যুর এক মাসের মধ্যেই, বিশ বছরের মাধবীকে সাঁইত্রিশ
বছরের স্নেহময় বিয়ে করে নিয়ে আসেন। মা মরা মেয়েটাকে কে দেখবে, এই যুক্তি মেনে নিতে পারে নি
বলে পাড়ার লোক আড়ালে হাসাহাসি করলেও, মুখে কিছু বলার সাহস দেখায় নি। স্নেহময়কে আর
সবাই ভয় করলেও, তিনি নিজে কিন্তু মাধবীকে যমের মতো ভয় করেন। তাই বিয়ের বছর ঘুরতে
না ঘুরতেই ছ’বছরের অণিমা সর্বক্ষণের কাজের লোকে পরিণত হলেও, তিনি কোন প্রতিবাদ
করার সাহস দেখান নি, বরং ধীরে ধীরে গত দু’বছরে তিনিও নিজের সাথে তাঁর সম্পর্কের
কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়ে, অণিমাকে বাড়ির বিনা পয়সার কাজের লোক ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে
গেছেন। তার কষ্টে এখন আর তিনি কষ্ট পান না, কাজে ফাঁকি দিলে বিরক্ত হন, স্ত্রীর
অভিযোগে অকথ্য অত্যাচার করেন।
কাকভোরে
ঘুম থেকে উঠে ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে শুরু করে, মাধবীকে রান্নার কাজে সাহায্য করা,
টুকটাক দোকান বাজার করা, বাসন মাজা, ছোট ছোট জামা কাপড় কাচা, সব তাকেই করতে হয়।
মাঝে গতরাতের দু’টো রুটি ও তরকারি বা গুড় দিয়ে জলখাবার। দুপুরেও দু’টো ভাত জোটে
বটে, তবে সেটা কখন জুটবে এবং কী জুটবে, নির্ভর করে কখন কাজ শেষ হবে তার ওপর। প্রথম
প্রথম অত্যাচার, খিদে, পরিশ্রম, ইত্যাদি কারণে সে চোখের জল ফেলতো বটে, এখন কিন্তু
মুখ বুজে সব সহ্য করে। হয়তো চোখের জল শুকিয়ে যাওয়াও এর কারণ হতে পারে।
রাত
ন’টায় মাধবী নিজের ও স্বামীর খাবার নিয়ে নিজেদের ঘরে যাবার আগে অণিমার রুটি তরকারি
রান্নাঘরে রেখে দিয়ে যান। কোনদিন সুস্থ অবস্থায়, কোনদিন মত্ত অবস্থায় স্বামী ফিরলে,
একসাথে ঘরে বসে আহার সারেন। অণিমা তার বরাদ্দ দু’টো রুটি ও তরকারি খেয়ে নিয়ে, রান্নাঘর
পরিস্কার করে, রান্নাঘরের এঁটো বাসন উঠোনের কলতলায় নিয়ে গিয়ে মেজে পরিস্কার করে,
টুকটাক কোন ফাই ফরমাশ থাকলে সেরে, রান্নাঘরের পাশের ঘরটায় শুতে যায়।
আজ
এতো দেরি হওয়ায় মাধবী দু’চারবার চিৎকার করেও কোন ফল না হওয়ায়, রান্নাঘরে এসে দেখেন
অণিমার খাবার নেই। তাকে সহবত শেখাতে কলতলায় এসে দেখেন জড়ো করা বাসন পড়ে রয়েছে,
কিন্তু অণিমা নেই।
বাড়ির
ভিতরে কোথাও না থাকায় ও বাইরের দরজা হাট করে খোলা থাকায়, মাধবী স্নেহময়কে ফোন করে
ডেকে পাঠান। মাধবীর চিৎকারে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায় ও সব শুনে তারা আশেপাশে খুঁজতে
বেরোয়। ইতিমধ্যে স্নেহময় ফিরে এসে পুলিশে খবর দেন।
অল্প
সময়ের মধ্যেই অণিমার খোঁজ পাওয়া গেল। প্রায় রোজই তাকে যে দোকানে যেতে হয়, এমনকী
আজও বিকালে যেতে হয়েছে, তারই কিছু দুরে, রাস্তার পাশে ঠান্ডায় অর্ধমৃতা এক বৃদ্ধা
ভিখারিনি শুয়ে আছে। ঠিক
তার
পাশে স্নেহময় তনয়া মাটিতে বসে বাড়ি থেকে ঠোঙায় মুড়ে আনা রুটি তরকারি পরম যত্নে বৃদ্ধাকে
খাওয়াচ্ছে। বৃদ্ধার গায়ে অণিমার রংচটা চাদর।