গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৭

আফরোজা অদিতি

যন্ত্রদানব

    খাঁ খাঁ রোদের তাপের মাঝে জেগে উঠল পথচারিদের ‘গেল, গেল’ চিৎকার। ট্রাকটাকে আটকানো গেছে। ওটাকে ঘিরে শুরু হয়েছে বড় রকমের জটলা। ভীড় বেড়ে জটলা শুরু হওয়ার আগেই ভেগেছে ড্রাইভার,আটক হয়েছে কণ্ডাক্টর। খুবই ভীড়। একজনের ঘাড়ের ওপর আরেকজনের মাথা।

    ট্রাক চাপায় ব্যাঙ-চ্যাপটা হয়েছে ছেলেটি। বয়স বেশি নয়,পনের ষোল হবে। মাথাটা একেবারে থেতলে গেছে। গায়ের চকলেট রঙের চেক শার্ট আর সাদা প্যাণ্ট রক্তে-ধূলায় মাখামাখি। কিছুক্ষণ আগেও দেহে ছিল প্রাণের স্পন্দন। কথা ছিল ছিল হাসি। পৃথিবীর মাটিতে ছিল দৃঢ় পদক্ষেপ। আশা ছিল। কিন্তু এখন আর নেই সে। এক নিষ্ঠুর দানব ওকে করে দিয়েছে নিষ্পন্দ,নিথর,বাকশক্তিহীন। ও এখন এ পৃথিবীর কোন মানুষ নয়, ওর কোন নাম নেই, ওর পরিচয় এখন লাশ।অসীম মৃত্যু এসেছে ঘাতক ট্রাকের ছদ্মবেশে,ছিনিয়ে নিয়েছে মায়ের কোলের শিশু, বাবার বুকের ধন,বোনের আদরের ভালোবাসা। লাশটিকে ঘিরে আছে পথচারি, দোকানি, ক্রেতা। কিছু না কিছু বলছে সবাই । কেউ আহা, কেউ বা উহু করছে ।কেউ বা মুছছে তাদের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল ।

    দুপুরে রোদের ঘামে ভেজা ভীড় ঠেলে আসেন একজন পৌঢ় ব্যক্তি। তিনি রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। এসেই আছড়ে পড়েন লাশের ওপর। তাঁর বিলাপের কান্নায় চিড়চিড় চিরে যায় খাঁ খাঁ রোদেলা দুপুর। ঐ প্রৌঢ়টি লাশ হয়ে যাওয়া ছেলেটির বাবা।  এই কষ্টের তো কোন সান্ত্বনা হয় না তবুও  কেউ কেউ এগিয়ে আসে তাঁর কাছে।  কেউ সান্ত্বনা দেয়।

     ‘কাঁদবেন না, সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না।’  কেঁদে কেঁদে শান্ত হয় মানুষটি। হাঁটুতে মুখ রেখে অসহায় বসে থাকেন। সাইরেন বাজিয়ে আসে পুলিশ। জীপ থেকে নামে পুলিশ ইন্স্পেক্টর। সালাম দেয়, ‘স্যার আপনি।’ভাষাহীন  চোখে তাকিয়ে থাকেন ছেলেটির বাবা। কান্নায় ভেঙে পড়েন আবার। কথা আটকে যায় মুখে। বলে, ‘ত...তু...মি বাবা।’ কাছে এসে পাশে বসে ইন্সপেক্টর। ‘ঐ যে দেখ দেখ আমার শাহীন।’ লাশের গায়ে হাত দিয়ে দেখাতে গিয়ে কান্নায় বেসামাল উপুড় হয়ে পড়েন লাশের বুকে আবার।
    ‘শাহীন !’ বিস্মিত ইন্সপেক্টর।‘ওর না আজ রেজাল্ট বের হবার কথা।’
    ‘বের হয়েছে তো। প্রথম হয়েছে এসএসসিতে।’

    আজ শাহীনের রেজাল্ট বেরুবার দিন। রেজাল্ট জানতে এসেছিল স্কুলে। পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার খবর ফোনে দিয়েই  তাড়াতাড়ি ফিরছিল বাসায়। ফেরা আর হয়নি। বাবা গিয়েছিলেন মিষ্টি কিনতে কিন্তু ছেলের মোবাইল থেকে অজানা একজনের ফোন পেয়ে এখানে এসেছেন বাবা। 

    মায়ের রান্না শেষ। ছেলের জন্য পায়েস করেছে। খেতে ভালোবাসে ছেলে। পায়েস ছাড়াও প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় আজ বিশেষ খাবারের আয়োজন। শাহীন যেসব খাবার পছন্দ করে তার বেশিরভাগই রান্না করেছেন মা।

    প্রতীক্ষা করছেন মা। খোকন ফিরলো না এখনও!  ঘর-বার করছেন মা। মনে আশংকা। কিছু হলো না তো। ওর বাবাও কেন আসছেন না। বারবার দরোজার কাছে যাচ্ছেন। একটু শব্দেই ভাবছেন এই বুঝি তাঁর ছেলে এলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মায়ের মন কেমন কেমন করছে। অচেনা এক অনুভূতি ঘা দিচ্ছে মনের ভেতর। গতকাল রাতে খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। তাছাড়া ছেলে বের হবার সময় হোঁচট খেয়েছে। ভয় পেয়েছেন মা। মায়ের ভীত অবস'া দেখে হেসেছে ছেলে। বলেছে, ‘তুমি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছ মা।’

    শাহীন জানে মায়ের এ রকম ভীত অবস্থা মানে স্বপ্ন দেখা। মায়ের মতো স্বপ্ন দেখায় বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না  ছেলে। তবে বিশ্বাস না করলেও মায়ের ভাবনাকে অসম্মান করে না কখনও। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,‘ চিন্তা করো না মা, এই যাবো আর আসবো। দেখ, তোমার পায়েস রান্না হতে হতেই চলে আসবো।’ ওর কাণ্ড দেখে হেসে গড়িয়ে পড়েছে ছোট বোন তনিমা।

    ফুল কিনেছে তনিমা। সাজিয়ে রেখেছে কাঁচের গ্লাসে। সুন্দর লাগছে। রজনীগন্ধ্যা আর গোলাপ। গোলাপটা এত টাটকা ছিল কেনার সময় কিন্তু ঘরে আসতে না আসতে কেমন ম্লান হয়ে গেছে। দিন প্রায় শেষ। মেয়েকে ডাকে মা। ‘তনিমা, এখনও আসছে না কেন ওরা।’

    তনিমা সাহস দেয় মাকে। ‘চিন্তা করো না তো মা। চলে আসবে। রাস্তার যানজটে আটকে আছে মনে হয়্‌।’
    ‘কী যে কস না তনু, যানজট থাকলেও কী এত বেলা পর্যন্ত থাকবে।’ এ কথার তো কোন জবাব হয় না।
    শাহীন মায়ের কষ্টের মানিক। পরপর তিনটি ছেলে মারা গেছে আঁতুড়ঘরে। শাশুড়ির গঞ্জনা চলেছে অনবরত। শাহীনের বাবাকে আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে শাশুড়ি। কতো কান্না কতো গঞ্জনা। পীর-ফকির-ডাক্তারের কাছে আসা যাওয়া। সব পুরানো কথা মনে পড়ে মায়ের। মায়ের মন কাঁপে। কিসের থেকে কী কথা মনে পড়ছে বারবার ! মা অস্থির।
    ‘কী হলো বলতো, আসছে না কেন?’ মেয়েকে জিজ্ঞেস করে মা। ‘আসবে মা, আসবে। বাবা আছে তো সঙ্গে।’ মেয়ে  কোল ঘেঁষে আসে মায়ের।

    পুলিশ ইন্সপেক্টর পরিচিত থাকায় আনুষাঙ্গিক সব কাজ তাড়াতাড়িই মিটে গেল। মর্গ থেকে লাশ নিয়ে ফেরার সময় ইন্সপেক্টর বলে, ‘স্যার, ড্রাইভার ধরা পড়েছে। আপনি থানায় ডায়েরি করবেন, চলুন। ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দিব।’ ইন্সপেক্টরের কথায় বলেন বাবা, ‘না মুনির, টাকার প্রয়োজন নাই। কারও জীবনের দাম কি টাকায় মাপা যায় ! যায় না। জীবনের কোন মূল্য হয় না বাবা। মানুষের জীবন অমূল্য ধন বাবা, অমূল্য ধন।’

    বিড়বিড় করতে করতে মৃত ছেলেকে নিয়ে বাসায় দিকে রওয়ানা হন বাবা। সেদিকে তাকিয়ে ইন্সপেকটর। জলে ভরে ওঠে তার দুচোখ।