“আবে শালা পাড়ায় এই একটা
মাত্র রক্ষাকালী পূজোয় হাজার টাকা চাঁদা কি খুব বেশি চাওয়া হয়েছে? শালা শুধু বিসর্জনে সাতটা ঘোড়ার গাড়ির
জন্য কত টাকা প্রয়োজন জানিস? তাছাড়া
প্যান্ডেল আছে, আলো আছে, প্রতিমা আছে, ব্যান্ড পার্টি আছে। পাড়ার মুখ রক্ষা করতে চিৎপুর
থেকে রমজান আলির ব্যান্ড নিয়ে আসছি, তার খরচ কত জানিস? কে জোগাবে, তোর বাপ্? শালা, মক্ষীচোষ”।
“বিল্টুদা আমার সামান্য চায়ের দোকান। বাড়িতে সাতটা প্রাণী, সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাই, এত
টাকা কোথায় পাবো বলো। আমি একশ’ টাকা চাঁদা দিচ্ছি, রাগ করো না,
এটা নিয়ে আমায় রেহাই
দাও”।
“শালা শুয়োরের বাচ্চা, আমায় ভিক্ষে দিচ্ছিস?
তিন তিনটে বাচ্চা
পয়দা করবার সময় মনে ছিল না যে খরচ চালাতে পারবি না? সন্ধ্যার
মধ্যে টাকাটা ডেরায় পৌঁছে দিয়ে আসবি,
তা নাহলে কাল সকাল
থেকে তোর দোকান মায়ের ভোগে চলে যাবে। এই চল্ চল্, অনেক জায়গা ঘোরার বাকি আছে”।
বাজারের ভিতর বিল্টুদা এই একটাই রক্ষাকালী পূজা করে, বেশ ধুমধাম করেই করে। তবে দেব দেবীতে
বিল্টুদার অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি, তাই রক্ষা কালী ছাড়া শীতলা,
মনসা, অন্নপূর্ণা, জগদ্ধাত্রী, ইত্যাদি প্রায় সব পূজাই করে থাকে। বিল্টুদাতো
এইসব পূজা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য করে না, স্থানীয় বাসিন্দা ও বাজারের সব দোকানদার, সবজি ও মাছ বিক্রেতাদের
সাংসারিক মঙ্গলার্থে করে থাকে। তাই স্বেচ্ছায় না হলেও, বিল্টুদার ইচ্ছায়,
ও বড় বড় নেতা যাঁরা
এইসব পূজা উদ্বোধন করতে আসেন, তাঁদের সম্মান রক্ষার্থে, সারা
বছরের আয়ের একটা সিংহ ভাগই এরা বিল্টুদাকে দিয়ে থাকে, বলা ভালো,
দিতে বাধ্য হয়।
কাছে বা দুরে, এ জেলায় বা অন্য জেলায়, খরা বন্যা বা অন্য যেকোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে,
বিল্টুদার মন কেঁদে ওঠে। ঐ বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত এলাকায় পুরাতন জামা কাপড়, বা খাদ্যদ্রব্য বয়ে নিয়ে যাওয়ায় অনেক হ্যাপা, লোকবলেরও
প্রয়োজন হয়। তাই বিল্টুদার পক্ষে ইচ্ছা থাকলেও চাল, ডাল, বা
পুরাতন বস্ত্র দিয়ে আর্ত মানুষকে সাহায্য না করে টাকা দিয়ে সাহায্য করা
ছাড়া উপায় থাকে না। যদিও করুণাময় বিল্টুদা এইসব আর্তের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার
জন্য সারা বছর উদগ্রীব হয়ে থাকে, কিন্তু এইসব ঘটনাতো আর নিয়ম করে প্রতিমাসে আসে না, তাই এই জাতীয় কোন ঘটনা ঘটলে, অসহায়
মানুষগুলোকে রক্ষার দায়িত্ব স্থানীয় বসবাসকারী ও বাজারের বিক্রেতাদের বিল্টুদার
মারফৎ নিতেই হয়, এবং
বিনা প্রতিবাদে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্যও করতে হয়।
বিল্টুদা এখন এ অঞ্চলের ভি.আই.পি.। প্রোমোটার হিসাবেও এখন তার বেশ
নাম ডাক। অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতার সাথেই এখন তার দাদা-ভাই এর সম্পর্ক। কাজেই এই অঞ্চলে বিল্টুদার
ইচ্ছাই শেষ কথা।
এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগপূর্ণ গভীর রাতে সহায় সম্বলহীন বিধবা,
কমলার কুড়ি বছরের একমাত্র ছেলেটা বুকের যন্ত্রণায় ছটফট্ করতে শুরু করলো। এই
দুর্যোগে কোন ডাক্তারকে তার বাড়ি নিয়ে আসা সম্ভব হ’ল না। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলেও টাকা চাই, গাড়ি চাই। শেষে কোন উপায় না দেখে
দুর্যোগ মাথায় করে কয়েকজন ভদ্রলোক ইচ্ছা না থাকলেও বিল্টুদার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত
হলেন। শুনশান রাতে বাড়ির গেটের কাছে দ্বাররক্ষকের ঘরে
দ্বাররক্ষকের দেখা পেয়ে তাদের আসার কারণ জানালে, দ্বাররক্ষক তাঁদের জানান যে সাহেব ব্যস্ত আছেন, এত রাতে দেখা করা সম্ভব নয়, কাল সকালে আসুন। তবু বার বার অনুরোধের
ফলে দ্বাররক্ষক তাঁদের সঙ্গে করে সুদৃশ্য মার্বেল মোড়া সিঁড়ি ভেঙ্গে বিল্টুদার ঘরে
নিয়ে যাবার সময়, তাঁরা একটা হাল্কা মিষ্টি সেতারের সুর শুনতে পেলেন।
তিনতলার নির্দিষ্ট ঘরের কাছে নিয়ে গিয়ে দ্বাররক্ষক তাঁদের ভিতরে যেতে বললো। অন্ধকার ঘরের
দরজা ভেজান। দরজা ঠেলে খুলতেই দেখা গেল অন্ধকার ঘরে হাল্কা নীল আলো জ্বলছে। একটা
তক্তপোষে বসে বিল্টুদা সেতারে দরবারি কানাড়ার আলাপ বাজাচ্ছে। আগন্তুকরা
তাকে বিরক্ত না করে ঘরের ভিতর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আরও
বেশ কিছুক্ষণ চোখে জল এসে যাওয়া আলাপ শেষে, সেতার রেখে বিল্টুদা তাঁদের এই গভীর
রাতে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলো। সব শুনে কোন কথা না বলে, সে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল। মিনিট দশেক পরে বিল্টুদা ফিরে এসে আগন্তুকদের হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে একটি
ভালো হাসপাতালের নাম করে ছেলেটিকে সেখানে নিয়ে যেতে বলে জানালো,
যে সে ফোনে কথা বলে রেখেছে কোন অসুবিধা হবে না।
আগন্তুকরা সিঁড়ি
ভেঙ্গে নামার সময় আবার বিল্টুদার সেতারের সুর শুনতে পেলেন, তবে এবার পরিস্কার নয়,
কারণ বিল্টুদার সেতারের সুর বাড়ির নীচে অ্যাবুলেন্সের তীব্র হুটারের আওয়াজে ঢাকা
পড়ে গেল।