গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৭

শান্তিময় কর

কুকুর কীর্তন                 

          কোন না কোন সময়, কোন না কোন কারণে প্রতি মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বলেইআমার ধারনা। কিন্তু আগে কোনদিন আমার ক্ষেত্রে এরকমটা হয়েছিল বলে আমার মনে পড়ে না।মনে হয়, এই প্রথমবার কদিন আগের এক রাত্রে আমার খুবই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। না, কোনদুশ্চিন্তা বা উদবিঘ্নতা থেকে নয় বা শরৎচন্দ্র উল্লিখিত কন্যাদায়গ্রস্থতা বা অম্লব্যাধি জনিত কারণেওনয়। এতগুলো বছর পার করে এলাম - কোন কারণ বশতঃই কখনও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনিএমনভাবে। এবং এমন একটা কারণে এটা ঘটলো যা শুনলে পাঠকের মনে কী প্রতিক্রিয়া হবে, আমার জানা নাই। তবে ব্যাঘাত ঘটলো এবং এটাই সত্য।

          প্রতি রাত্রের মত দু' তিন দিন আগের রত্রেও যখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক তখনইরাস্তার যত কুকুরের তার সপ্তকে অর্থাৎ উচ্চ নিনাদে গলা ফাটানো শুরু হয়ে গেল। এটানিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা, প্রতি রাত্রেই এই রকমটাই হয়। এটাকে আমি বলি কুকুর কীর্তন। এই কুকুরকীর্তনের মধ্যেই বিছানায় শোবার কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে ডুবে যাই প্রতি রাত্রে। ঘুম ভাঙ্গেসেই ভোরবেলায়। রাগ-রাগিনী সহকারে কুকুর কূলের সমবেত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আমার ঘুমের পথেঅন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি কোনদিনই। মাঝে মাঝে রাগ যে হয় না বা বিরিক্তি আসে না, তানয়। কিন্তু কুকুরের কাজ কুকুর করেছে”, এই আপ্ত বাক্য স্মরণ করে ওদের শান্তিতে সঙ্গীতসাধনা করতে দিয়ে আমিও নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়ি। তার আগে স্ত্রীকে বললাম, “ শোন শুরু হয়েগেল রাগ সাধনা এই বলে ঘুমোবার তোড়জোড় করছি, অকস্মাৎ স্ত্রীর প্রশ্ন, “আচ্ছা, বর্ষাকালেএই কুকুরগুলোর খুব অসুবিধা, তাই না” ? কি এবং কিসের অসুবিধা জানতে চাইলে সে যা বলল, তা হল, এখানে মুম্বাই শহরের গোরেগাঁওয়ে যে এপার্টমেন্টে আমরা থাকি, তার সামনের লম্বারাস্তাটার দুদিকে শুধু ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট। শুধুই কংক্রিট আর কংক্রিট। গেটে গেটে অতন্দ্র পাহারা।

মাছিও ঢুকতে পারে না। গাছও অপ্রতুল। তাহলে বর্ষাকালে যখন দিনরাত প্রবল বৃষ্টি পড়ে, তখনকুকুরগুলো থাকে কোথায়, ঘুমোয় কি করে? রাস্তার দুপাশে এমন কোন শেড নাই বা আশ্রয় নাইযেখানে ওরা ঠাই করে নিতে পারে। শয়ে শয়ে গাড়ী রাস্তার উপর পার্ক করা থাকে, তার তলায়ঢুকতে পড়তে পারে কিন্তু ওখানেও তো জল থৈথৈ। তাহলে ওরা কি করে কাটায় বর্ষাকালে, ঘুমোয়কোথায়” ?  সত্যিই বিশাল সমস্যা। সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে পেলাম না। কিন্তু সমস্যাটাআমার মনে গেঁথে গেল। কোন একটা উপায়ের কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।কিন্তু একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল আমার।

          স্বপ্নে দেখলাম দুটো কুকুর ঝগড়া করছে আমার বাড়ীর সামনে গেটের পাশে। সে কীগগনভেদী চিৎকার। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও থামার কোন লক্ষণ না দেখে একটা মোটা ডাণ্ডানিয়ে তাড়াবার জন্য যেই গেছি, অমনি তেড়েফুঁড়ে বলে কিনা, “তোমরা যখন ঝগড়াঝাঁটি, মারপিট, চিৎকার চ্যাঁচামেচি করো নিজেদের মধ্যে, তখন কি আমরা তোমার মত ডাণ্ডা নিয়ে তেড়ে আসিথামাবার জন্য ? আমরা কুকুর, ঝগড়া আমাদের সহজাত, স্বভাবসিদ্ধ।  নিয়ে তোমরা কেন মাথাঘামাও বলতে পারো ? ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করো, একটু ভেবে দেখো তো, তোমাদের, মানে মানুষেরএবং আমাদের অর্থাৎ কুকুরের স্বভাব কি কখনও এক হবে ? আমরা কুকুর, সত্যি সত্যি কুকুর, তবুও আমরা অনেক বাধ্য। আর মানুষকে মানুষ বানায় কার সাধ্যি? আমরা জেগে থাকি বলেইতোমরা আরাম করে ঘুমোতে পার। আমরা ছাড়া তোমাদের আর কে রক্ষা করে বলতো ? 'কুত্তা' ছাড়া আর কিছু কি বল তোমরা আমাদের ? 'দূর', 'ভাগ', 'হট' যতই বল না কেন, আমরাতোমাদের পিছন ছাড়ি না, তোমাদের আগলে রাখি। ভোজ বাড়ীতে তোমরা আয়েশ করে, কব্জিডুবিয়ে কত ভালমন্দ, মণ্ডা মেঠাই খাও, ভুলেও কি কখনও সামান্য খাবারও আমাদের তোমরা দাও ? ডাণ্ডা নিয়ে আমাদের তাড়া কর, মাথায় ঢিল মার, তবুও আমরা তোমাদের সেবা করি। এর মধ্যেকি একতিল মিথ্যে আছে” ?

          আমি বাকরুদ্ধ। সত্যি তো কোন মিথ্যে নেই এর মধ্যে। শতকরা এক ' ভাগ সত্যি।মুখের উপর মুখের মত জবাব পেয়ে  মেরে গেছি, থতমত খাচ্ছি বলতে গেলে। ভাবলাম মনেমনে, এটা কি কুকুরের নিছকই অভিমান না অন্য কিছু ? ভাবতে ভাবতেই আবার বিছানায় গাএলিয়ে দিলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। আবার সেইআগের মত স্বপ্ন। এবার দেখি অনেকগুলো কুকুর আমার সামনে দাঁড়িয়ে তারস্বরে আমাকে জিজ্ঞেসকরছে, “আরাম করে তো ঘুমোচ্ছ, আমাদের দুর্দশার কথা কি একটি বারের জন্যও ভেবে দেখেছো ? বাইরে এই যে এমন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, চারিদিক জল থৈথৈ, আমরা কোথায় শোব, কোথায়ঘুমবো আমরা ? রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িগুলোর তলাতেও বসতে শুতে পারছি না। সর্বত্র শুধু জল, জল, আর জল সত্যি সমস্যা ওদের। কিন্তু কিভাবে ওদের এই সমস্যা দুর করবো ভাবতে নাপেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ আমার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেওরা চলে যেতে লাগলো। যাবার সময় চিৎকার করে বলতে বলতে গেল, “এই মানুষগুলো ভীষণস্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ, দয়ামায়াহীন, নিষ্ঠুর, নির্মম - এরা আমাদের জন্য কিছুই করবে না, মানুষ হয়েজন্মেও এরা অমানুষ। এদের মানুষ বানায় কার সাধ্য। চাইলে এরা কিছুই দেবে না আমাদের, তাইজোর করেই কেড়ে নিতে হবে। আয় সবাই, গায়ের জোরেই আজ আমরা গেট দিয়ে ভিতরেঢুকবো - দরকার হলে দারোয়ানদের আঁচড়ে কামড়ে দেবো এইসব বলতে বলতে চলে গেলওরা।

          আমি নির্বিকার, নিশ্চল, অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। তাছাড়া আর কীই বা করতেপারতাম। ঘুমোতে পারলাম না আর বাকী রাতটুকু