গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৭

দেবাশিস সেনগুপ্ত

বদল

টিনের তলানি মুড়িটুকু ঝেড়েমুছে জলভর্তি বাটিতে ফেলতেই ফুস করে একটা শব্দ বাতাসে ভেসে উঠে মিলিয়ে যায়। দাওয়ায় বসে রমজান শব্দটা শোনে কান খাড়া করে। আজ নিয়ে তিনদিন হল, রাত ঘন হয়ে এলে এই শব্দটার অপেক্ষায় ঠায় বসে থাকা। তারপর অনেকটা সময় ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া, যতক্ষণ না চোখে ঘুম নেমে আসে। সন্ধ্যের পর ইলেকট্রিকের আলো থাকে না প্রায়ই, আজকাল আর দরকারও পড়ে না। ঝিঁঝি পোকার ডাক তীব্র হয়ে কানে তালা ধরার জোগাড় হলে রমজান গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে।

- ঘরে আর কিস্যু নাই। কাইল খাইবা কি? অন্ধকারে আনোয়ারার হিসহিসে প্রশ্নটা চমকে দেয়। নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় লুঙ্গির খুঁটে। - অহন ঘুমা। কাইল দেখুমনে। কিসু একডা করতে হইব। দুটো মানুষের দীর্ঘশ্বাস এক হয়ে মিলিয়ে যায় ঘন অন্ধকারে। ঘরের অন্যধারে চৌকির ওপর মড়মড় আওয়াজে রমজান বোঝে, বারো বছরের নাতি বা তার দাদু পাশ ফিরছে। চারটে আধখালি পেট পলকা ঘুমে এপাশ ওপাশ করে রাতভর।

বয়েস বাড়লে ঘুম কমে যায় মানুষের। আজও ভোর হওয়ার আগেই উঠে পড়ে কেয়ামত। ছেঁড়া চাটাইটা টেনে দাওয়ায় বসে সূর্য ওঠা দেখে। পাশে সাধন মন্ডলের বাড়ির মুরগীগুলোর ডাকে গোটা গ্রামটাকে জেগে উঠতে দেখে একটু একটু করে। বেলা বাড়তে বাড়তে সূর্য মাথার উপর উঠে এলে কেয়ামত আর থাকতে না পেরে হাঁক দিয়ে ওঠে কই লো বড়ঘরের বিটি? মুখে দ্যাওনের কিসু নাই নাকি লা? কোনো সাড়াশব্দ আসে না। ঘরের ভিতর থেকে নাতিটার ঘ্যানঘ্যানানির শব্দ ভেসে আসে শুধু। বুড়ো দু-হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে ঝিমোতে থাকে।

পোস্টাপিসের সামনের চাতালে সকাল থেকে বসে রমজান। দুপাঁচজন এসে ঘুরে যায় বারে বারে। রমজান হাত নেড়ে আশ্বস্ত করে আইলেই হাঁক দিমু খনে। অহন যাও গিয়া। সারাটা গ্রাম যেন মুখিয়ে আছে সাতদিন। রোদ বাড়তে থাকে চড়চড়িয়ে, অল্প ঘামে ভিজে ওঠা খুঁটে হাত বোলায় রমজান। আজ একটা হেস্তনেস্ত না করে ফিরবে না বাড়ি। ঘরে দানাপানি নেই, তিনদিন ধরে জলে ভেজানো মুড়ি আর কলাইয়ের ডাল ছাড়া জোটেনি কিছু। আজ সেটুকুও নেই।

সময় ঠাহর করা যায় না এই অঘ্রাণের শুরুতে। পুকুরঘাট থেকে ভিজে কাপড়ে ঘরে ফেরে আনোয়ারা। আধবোজা চোখে কেয়ামত আলি চেয়ে থাকে ভেজা পায়ের ছাপগুলোর দিকে। সাধনের বউ বড় ভালো আলপনা দেয় লক্ষীপুজোয়। ওদের উঠোনে দাঁড়িয়ে খৈ মুড়কি প্রসাদ খেতে খেতে দেখেছে সে বহুবার। পেটের ভেতর একটা চাপা ব্যথা চাগিয়ে ওঠে। মাথাটা ঘোরাচ্ছে থেকে থেকেই। একটা চাপা হুল্লোড়ে ঝিমুনি ভাঙে কেয়ামতের। কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায় বুড়ো। দৌড়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় আনোয়ারাও।

কালো লঝ্ঝরে অ্যাম্বাসাডারটা বিকট আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসে মেঠো পথ ধরে। আওয়াজটা সব্বার চেনা। পিছন পিছন একদঙ্গল বাচ্চা হইহই করে ধেয়ে আসে। কপালে আড়াআড়ি হাত রেখে গাড়িটাকে ভালো করে দেখে নেয় কেয়ামত। উঠোনে ভেজা পায়ের ছাপের দিকে চোখ চলে যায় তার। দুরে পোস্টাপিসের সামনে উঠে দাঁড়ায় রমজানও। অস্ফূটে একবার বলে ওঠে ইয়া আল্লাহ্! অজান্তেই হাত চলে যায় লুঙ্গির খুঁটে। বেরিয়ে আসে তাদের শেষ সম্বল, একখানা ঘামে ভেজা বাতিল নোট।