গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

চন্দনকৃষ্ণ পাল

আমি ও মিতু


(১)

ধানমন্ডী আবাসিক এলাকায় আমাদের অফিস। ভিড় ভাট্টা গ্যাঞ্জাম নেই। অফিসের পর বাড়ী বাড়ী ঘুরে স্টাফ বাস গুলো কর্মচারী কর্মকর্তাদের তুলে নেয়। আজও গেটের পাশে এসে দাড়াতেই কোত্থেকে যে আক্তর এসে হাত ধরে বুঝি না। আক্তার একাউন্টসে বসে। বুঝি নিশ্চয় কোন কাজ। একটা চমৎকার হাসি মেরে আক্তার বলে আজ একটু নীল গাড়িতে চড়তে হবে। কেন? বায়তুল মোকারমে একটু কাজ দোস্ত। নাছোড় বান্দা আদমী আক্তার। উপায় নেই। আমাদের ৯/এ তে নীল গাড়ী আসেনা। কারণ ঐ রুটের স্টাফ নেই। আমাদের একটু হেঁটে ১০/এ তে দাড়াতে হয়। প্লানিং একাউন্টস আর ফিনান্স এর সমস্ত স্টাফরা দাড়িয়ে আছে। আমি নিজে অডিট সেকশনে থাকায় প্রায় প্রত্যেকের সাথেই পরিচয় আছে। সড়ক দ্বীপে নীলার সাথে দাড়ানো একতন্বী কে দেখে চমকাই আমি। আগে কখনো দেখিনি। বেশ দূরে হলেও বুঝা যায় নিস্পাপ, পবিত্র একটি মুখ। আক্তার হাত ধরে টানে। নীল গাড়ী এসে ফুটপাত ঘেষে দাড়িয়েছে। আমি বাসের পা দানীতে পা রাখার আগে একবার ঘুরে দেখি। তন্বীর সবুজ ওড়না হাওয়ায় ওড়ছে। আমি জানিনা ওকে। কোন রুটের যাত্রী।

(২)

জিপিওর সামনে বাস থামে। দুজন নামি। আমার মাথার ভেতর তন্বীর নিস্পাপ মুখ। ধ্যুত, কে না কে। মাথা থেকে সরাতে চাই আমি। পুরোপুরি সরে না। আক্তার স্টেডিয়াম এক চক্কর দেয়। তারপর বায়তুল মোকারমে ঢুকে। কিছু ইলেকট্রনিক্স কেনে। কিছু কাপড় চোপড় কেনে। ঘড়ির কাটা ছটার কাছাকাছি। দোস্ত এবার মুক্তি দাও। আক্তার শিওর বললেও মুক্তি পাইনা। বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে খাবার দাবারে ঢুকে আক্তার। দুরকম পিঠে আর জিলিপিতে নাস্তাটা ভালোই জমে। একটা অলিখিত শর্ত আমাদের কলিগদের মধ্যে। যে বাজার টাজার করুক। বাজারের শেষে খাবার দাবার এ ঢুকতেই হবে বাজেট যাই হোক। পারত পক্ষে কেউ এ শর্ত লংঘন করিনা। খাবার দাবার থেকে বেরিয়ে আমি মোহাম্মদপুরের বাস ধরি। আক্তার মাদারটেক এর টেম্পু ধরে। বাসে জানালার পাশে সীট পেয়ে যাই সৌভাগ্য বশত। নাম না জানা তরুনীর নিস্পাপ মুখটা আবারো ভেসে ওঠে মগজের কোষে। আমি এরকম নিশ্চিত হয়ে যাই ওর কাছ থেকে মুক্তি নেই আমার!

(৩)

আমার বসের মাস্তানী দেখলে নিজেও মাস্তান হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। তার মুখে চমৎকার সব নীতি কথা। কিন্তু আমার মনে হয় সে একটা বড় দরের ভন্ড। সে কোন দিন টাইমলি অফিসে আসে না। অথচ কোন স্টাফ কোন কারণ বশতঃ দেরী করে আসলে সে লাল কালিতে এটেনডেন্ট রেজিষ্টারে দাগ কাটে। যখন তখন যে কোন ছোট খাটো ব্যাপারে চার্জ করতে তার জুড়ি নেই। কোন স্টাফ ছুটি চাইলে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নানান বাহানা তৈরী করে সে ছুটি না দিবার চেষ্টা করে। অথচ নিজের ছুটির ব্যাপারে সে মেম্বারের পা চাটতে দ্বিধা করেনা। এতো সব গুণের অধিকারী প্রথম শ্রেণীর ছোট লোকটার ডাক শুনতে হয় অফিসে ঢুকতেই। আমি ওর রুমে যাই। যথারীতি সালাম জানাই। সে তার গোলগোল হিংস্র চোখ দিয়ে আমাকে দেখে এবং কি জানি চিন্তা করে। এক সময় আরাকানী ভাষা মিশ্রিত বাংলায় যা বলে শুদ্ধ করলে তা হলো। আপনি আজ কার্যক্রম পরিকল্পনায় অডিটে যাবেন। মিনিট পনেরোর মধ্যে আপনি চিঠি পাবেন। কাগজ পত্র প্রস্তুত করুন। আমার বলার কিছু নেই। আমি তার রুম থেকে ফিরে আগজ পত্র গুছাই। মিনিট পনেরো পরে স্টেনো চিঠি নিয়ে আসে। একজন সহকর্মীকে সদস্য করে টিম তৈরী হয়েছে। আমরা কার্যক্রমের দিকে যাত্রা করি।

()

আমরা আঠারো জন একই দিনে নিয়োগ পত্র পেয়ে এই প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছিলাম। তার একটা খালিদ। খালিদ কার্যক্রমে বসে। আমি সহকর্মী বাহার সহ খালিদ এর সামনের চেয়ার দুটো দখল করি। খালিদই ডিরেক্টর এর কাছে চিঠি পৌছানোর ব্যবস্থা করে। ডিরেক্টর ডাকলে আমি ভিতর যাই এবং প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে আবার খালিদ এর রুমে ঢুকি। ঢুকেই আমাকেই চমকাতে হয়। গতকালের তন্বী। পুরো একটি ফুল সেক্রেটারিয়েট টেবিল দখল করে বসেছেন। নিজের পবিত্রতা সারা ঘরে ছড়িয়ে ঘরকে পবিত্র করছেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই নিরবে নামিয়ে নেন। আমি খালিদের সামনের চেয়ার দখল করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি রাখি খালিদের চোখে। খালিদ সম্ভবত বুঝে এবং তৎক্ষণাৎ পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি জানতে পারি মিতু একউন্টস অফিসার। নিউ রিক্রুট। বাড়ী রাজবাড়ীর পাংশা। পড়াশুনা রাজবাড়ী এবং ঢাকা। আপাততঃ অবস্থান আগারগাঁও। সিঁথিতে সিন্দুর পড়েনি জেনে ভালো লাগে। ক্ষীণ একটা আশাবাদ যে জাগেনা তা নয়। বসের মাস্তান মার্কা চেহারাটা ভুলে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে কাজের গভীরে ডুবে যেতে। খালিদের সৌজন্যে চা আসে। মিতু আমি আর খালিদ একসাথে গরম চায়ে চুমুক দেই।
 
(৫)

কোন কোন সময আমি কাজে বিভোর হয়ে যাই। যেমন আজ। কারো কারে কাছে এটা গুন। কেউ কেউ আবার এটা দোষ বলেই ভাবেন। মানুষের মধ্যে কতো রকমের ভাগাভাগি যে আছে তা স্বয়ং ঈশ্বর জানেন না কিনা আমার সন্দেহ। আজও আমি ডুবেছিলাম কাজের গভীরে। হঠাৎ চোখ তুলি। মিতুর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। ও এতোক্ষণ আমাকেই দেখছিলো। ধরা পড়ে হাসে। অপ্রস্তুতের হাসি। ভালো লাগে।
- অরে কতো করবেন, লাঞ্চের সময়তো হয়ে গেলো।
- সত্যি নাকি। তাহলে তো ভালোই। আপনার বক্সে আজ ভাগ বসানো যাবে।
-খুশী হবো?
-বেশীর ভাগ ঢাকাবাসী হয় না।
- ব্যতিক্রম কি থাকতে পারে না?
- পারে। ধন্যবাদ। আমি উঠার প্রস্তুতি নেই।
-আরে উঠছেন কেনো। বক্সে ভাগ নাই বসালেন, কিছু আনাই।
-আপনি সিরিয়াস? আমি কিন্তু নির্ভেজাল কৌতুক করেছি।
-আমি খুশী হতাম। বিষন্নতা মিতুর কণ্ঠে।
-পাওনা রইলো। অন্য এক সময় খেয়ে যাবো।
-সত্যি।
-সত্যি।
আমি বাইরে চলে আসি।


(৬)

বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিশু একাডেমীর অডিটরিয়াম। বছরে এই একটা দিনে আর বার্ষিক বনভোজনে আমারা সবাই এক পরিবারের হয়ে যাই। দীর্ঘ দিনের প্রস্তুতির পর আজ অনুষ্ঠান। সবাই এসেছে। বিবাহিত কলিগরা বৌ নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো মিনিট পয়তাল্লিশ বাকী। আমি দূরন্তর কাছাকাছি একা বসে থাকি। সবার গতি বিধি দেখি। শফি তার সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে একান্তে একাডেমি বিল্ডিং এর সিঁড়িতে বসে আছে। একা একা নিজের বউকে দেখছে। ওর বউ নাজনীন মুন্সীগঞ্জের মেয়ে। খুব লক্ষ্মী। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে নাজনীন হাসছে। চমৎকার হাসে মেয়েটা। আমার হঠাৎ করে মিতুর কথা মনে পড়ে। ওকি আসবে।
-নমস্কার। আমি একটু চমকাই। আসলে একটু আগেই মুন্সীগঞ্জের শীতলক্ষার তীরে চলে গিয়েছিলাম। বাস্তবে ফিরি। মিতু। অবাক হই আমি।
-নমস্কার।
-একা এবং চুপচাপ বসে আছেন।
-যদি বলি আপনার অপেক্ষায়।
-বিশ্বাস করিনা। মিতু হাসে। চমৎকার।
-সবকিছু অবিশ্বাস করতে নেই মিতু।
-আপনি সিরিয়াস?
-হ্যা ।মিতু মাথা নিচু করে কি যেন চিন্তা করে। তারপর হাসে।
-খুশী হলাম
-সত্যি
-সত্যি

(৭)

শিশু একাডেমীর চত্তর। তিন নেতার মাজার। হাইকোর্টের মাজার।দোয়েল মোড়। সব সুন্দর হয়ে যায়। শফি আর নাজনীন অডিটরিয়ামের দিকে ফিরছে। দূরন্তর কাছে এসে থামে।
-তপুদা কেমন আছো। নাজনীনের কণ্ঠে উচ্ছাস।
-এসে তো কর্তাকে নিয়েই ব্যস্ত। তপুদা আছে না মরেছে খোঁজ নিয়েছো। আমি রাগ দেখাই। শফি হাসে।
-ক্ষমা চাইছি।
-এবারের মতো। এসো পরিচয় করিয়ে দেই। ইতি শ্রীমতি মিতু। আর মিতু ওরা শফি আর নাজ। কর্তাগিন্নী। ওরা পরস্পরকে সম্ভাষণ বিনিময় করে।
-তপুদা কানে কানে একটা কথা বলি।
-বলো
-তাহলে তুমি উঠে এসো। আমি উঠে যাই।
-কি বলো
-মেয়েটা খুব সুন্দর।
-তো আমি কি করবো?
-ওকে বৌদি বানিয়ে ফেলি।
-ওরে বাবা এতো সুন্দর মেয়ে কি আমাকে বিয়ে করতে চাইবে?
-আলবৎ।
-তুমি আলাপ করে দেখো। ওকে তপুদা ওকে।

(৮)

রাত প্রায় আটটায় শেষ হয় অনুষ্ঠান। নাজ-শফি আমাকে স্পেশাল নিমন্ত্রণ জানিয়ে বাসে ওঠে। আমি ইতস্ততঃ হাঁটি। মিতু এসে সামনে দাড়ায়।
-এই মুহূর্তে আপনার কি কোন কাজ আছে?
-না
-তাহলে মিরপুরের গাড়ীতে উঠুন। একটু কাজ আছে।
-আচ্ছা। আমি মিরপুরের গাড়ীতে উঠি। আগারগাঁও এসে মিতু নামে। আমাকেও নামতে হয়। বাস চলে যায।
- কি ব্যাপার।
-আমাকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে।
-আমাকে এতো বিশ্বাস করার কারণ।
-আমার বিশ্বাসে কি ভুল আছে?
-চলুন হাঁটি। পাশাপাশি হাঁটি দুজন। তিন চার মিনিটের পথ। বাসার গেটে এসে থামি দুজন।
-আমার প্রশ্নটার জবাব। গেটের সামনে আবছা অন্ধকার।
- জবাবটা আগামী বসন্তে দেবো। আপনি কি ততোদিন অপেক্ষা করবেন।
- করবো।
 
বুক থেকে একটা পাথর নেমে যায়।
 
মিতু কলিং বেলের বোতামে আঙ্গুল রাখে। বাসার ভেতরে একটা চমৎকার পাখি ডেকে ওঠে।