গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

সোনালি ভট্টাচার্য মুখার্জী

অবিকল্প

অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প হয় না জানিস।তাই আগেকার মানুষেরা বলতেন তিনমাথা, মানে হাঁটুতে মাথারাখা বুড়োদের কাছ থেকে বুদ্ধি নিতে। ওহো, এই সব শুনবো না।না।না। গল্প বলো। বলো না একটা গল্প। এক যে রাজা। না।রাজাগজা আর হয় না এখন কার দিনে। হয় না বুঝি? ঐ যে অত বড় দুর্গের মত বাড়ি।দেওয়ালের কাঁটাতার ঢাকা দেওয়া বিদেশী ফুলের কেয়ারী ঝুলিয়ে।কত কত পাহারাদার দারোয়ান লোক লস্কর, রাজবাড়ী নয় কি? ও বাড়ির মালকিনের একখানা নাকছাবির হিরের দামে আমার ঘরবাড়ি কেনা যায় তা জানো। ওরা রাজা গজা না তো রাজা আর বলে কাকে? তা বটে। আচ্ছা, তারপর। রাজ্যপাট ছেড়ে যুবরানী মাঝেমাঝে সৌন্দর্যবর্ধন করতে আসেন। আফটার অল রাজমহিষী। তার চোখের কোলে কালি,পায়ে খড়ি ওঠা, হাতের নখ এবড়োখেবড়ো, এসব হলে কি চলে? চলে না।লোক সমাজে সব সময় চকচকে ঝকঝকে নিভাঁজটি হয়ে থাকতে হয়। তাই এলেন। কোথায়? এ হল মস্ত বড়লোকেদের আরাম কেনার দোকান। ধবধবে ফেনার মত বিছানা। তাতে পালকের গদি। কত শত পরিচারিকা,সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ। কেউ মাথা ধোয়ায়,তো কেউ পায়ে মালিশ করে। কেউ ঝরঝরে হবার জন্যে শরবত নিয়ে আসে,তো কেউ নখে রং লাগায়। রাজপরিবারের লোক আসলেই চারিদিকে সাজ সাজ রব। আরামের পরাকাষ্ঠা হলে তবেই ত যাওয়ার সময় মুঠো মুঠো টাকা সবার হাতে গুঁজে দিয়ে যাবেন রানি। কিন্ত এক সকালে সেই সুন্দর হবার দোকানের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে অবাক হলাম। সব ম্যানেজাররা দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে,আর যুবরানী,অতি বিরক্ত গলায় বকাবকি করে চলেছেন। কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে শুনি ডাক্তারদের বিশেষত, কলকাতার ডাক্তারদের মুণ্ডুপাত করছেন শ্রীমতি।
একটু গায়ে লাগল বলেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,কি সমস্যা। সবাই আমায় দেখে বকুনির থেকে একটু রেহাই পেয়ে বলল, এই ত,ডক্টর, একটু দেখুন না,কি ভীষন প্রব্লেম। ম্যাডাম আর আসতে সময়ই পাচ্ছেন না আমাদের কাছে। ম্যাডাম তত ক্ষন আপাদ মস্তক জরিপ করছিলেন আমায়। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,আপনি আর শুনে কি করবেন। কলকাতার সব বড় অর্থোপেডিক,নিউরোলজিস্ট, সার্জেন দেখানো হয়ে গেছে। কোন রকম পরীক্ষা বাকি নেই।কেউ কিছুই খুঁজে পায়না, অথচ রোগিণী যন্ত্রনাতে চীৎকার করেন সারা দিন। আবার বলছে হিস্টিরিয়া। ছোঃ এদের ধারনা আছে আমার শ্বাশুড়ীমায়ের মনের জোর কত? অল্প বয়েসে বিধবা হয়ে একা হাতে ব্যবসা সামলে এই এতবড় সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। ছেলেপুলেদের মানুষ করে এক একটি রাজ্যপাট দিয়েছেন। তাঁর মানসিক ব্যাধি হতেই পারেনা। এত যন্ত্রনা যে নড়াতেও পারছি না। নইলে অন্য রাজ্যে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা ঠিক ধরতে পারতেন কি হয়েছে। এত যন্ত্রনা? গুরুমুখী বিদ্যা মস্তিষ্ককে জানান দিল এত যন্ত্রনা মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে সমস্ত শরীরকে অচল করে দিতে পারে দুটি প্রধান রোগে।কর্কটরোগ, ক্যান্সার, অথবা যক্ষ্মা। ক্যান্সার নয় সে সম্বন্ধে নাকি যাবতীয় পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। একটি পুরোনো অভিজ্ঞতার স্মৃতি ধরে জিজ্ঞাসা করলাম আপনাদের বাড়িতে দুধ খাবার অভ্যাস কি রকম সকলের? এমন অদ্ভুত প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে, বিশাল ফিরিস্তি উত্তর দিলেন ভদ্রমহিলা। তাঁদের কত ফার্ম,তাতে কত লোক খাটে ইত্যাদি ইত্যাদি বাংগালি ডাক্তারবাবু যে তাঁদের ঐশ্বর্য কতটা তা ধারণাই করতে পারছেন না, এতে আরও বিরক্ত হচ্ছিলেন ইনি। বললাম, যে অর্থোপেডিক দেখছেন তিনি কি মেরুদণ্ড থেকে রস নিয়ে টিউবারকিউলোসিসএর টেস্ট করেছেন? একেবারে বোমা ফাটল এবার। ছাদ কাঁপিয়ে চেঁচালেন মহারাণী। কি! টিউবারকিউলোসিস?যা কিনা খেতে না পাওয়া ভিখিরিদের হয়? আপনি জানেন আমি কে? চীৎকার থামলে পরে বললাম, আপনাদের তো হারাবার কিছু নেই। এই পরীক্ষাটি করে দেখতে বলুনই না। ভুলেও গেছিলাম এই ঘটনা। হঠাৎ মাস তিনেক পর সেই বাড়িরই সিঁড়িতে এক মহিলা খপ করে হাত ধরে দাঁড়িয়ে পরলেন। অবাক হয়ে বললাম,কি ব্যাপার? বললেন, চিনতে পারছেন না,সেই যে তিন মাস আগে কথা হয়েছিল? ডক্টর আর ইউ আ ম্যাজিশিয়ান? ইয়েস, ইট ওয়াজ স্পাইনাল টিউবারকিউলোসিস। থ্যাংকস টু ইউ শি ওয়াজ কিয়োর্ড।অউর আপনে তো পেশেন্ট কো দেখা ভি নহি। এবার মনে পড়ে গেলো ওনার গল্পটি। প্রনাম জানালাম গুরুদের মনে মনেই। তারপর বললাম, বাড়ির খাঁটি গরুর দুধ খাওয়াটা বন্ধ করুন।পাস্তুর সাহেব অনেক দিন আগে এই জন্যেই পাস্তুরাইজড দুধ খেতে শিখিয়ে ছিলেন পৃথিবীকে। ওনার উচ্ছ্বসিত ধন্যবাদ পিছনে রেখে উঠে এলাম ওপরে। ভাবলাম ভাগ্যিস এমন পেশেন্ট আগে দেখেছি,তাই কলকাতার মান রাখা গেলো,তাই বলছিলাম,অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প হয় না । বুঝলে ।