বাড়ির
সামনে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় একটা বিজাতীয় গন্ধ বেশ টের পেল শম্ভু। পাশের বাড়ির চৌধুরীদের
ছোট বউটা পাঁচিল ডিঙিয়ে এদিকে ময়লা ফেলেছে – এটা সে গন্ধ নয়। একফালি বাগানের
আগাছার মধ্যে পোকামাকড়ের মৃতদেহ আর শ্যাওলাধরা মাটির পুরনো সোঁদা গন্ধও নয়। এ গন্ধ
একদম অন্য। দরজার দিকে সাবধানে এগিয়ে গেল শম্ভু।
হাতল
ঘোরাতেই সামান্য ক্লিক আওয়াজ করে খুলে গেল দরজা। ঠিক এরকমটাই আশা করছিল। লক করা
নেই। তার মানে ভিতরে কেউ আছে। অন্ধকারে চোখ জ্বলে শম্ভুর, পরিষ্কার দেখতে পেল সব।
বসার ঘর এলোমেলো। একপাশে সিঁড়ির ধাপে পায়ের ছাপ, এক নয় একাধিক। ঘরে ঢুকে আলতো করে
দরজাটা লাগিয়ে, শম্ভু পকেটে হাত দিল। সার্ভিস রিভলভারটা থাকলে ভালো হত।
লাল
স্কার্ফটা গলায় এঁটে বসছিল যেন। ডান হাতের ব্রোঞ্জের কড়াটা অকারণেই চেপে দিল ওপরে
যতটা পারে। হাত দুটো মুঠো করল। বাড়িটাতে আর একা নেই সে – এইটা ভাবতেই শিরিশিরে
অনুভূতিটা টের পেল শম্ভু। চার নম্বর চূড়ার সফল অধিগ্রহণের পর, পাঁচ নম্বরের দিকে
যাবার সময় সঙ্গী সুবেদার হরিশ যখন বলেছিল, সে “দুশমন”এর গন্ধ পাচ্ছে, ক্লান্ত
বিধ্বস্ত আহত শম্ভুর ঠিক এইরকম শিরশিরানি অনুভব হয়েছিল। নিঃশব্দে বুকে হেঁটে চলার
গতি বেড়ে গিয়েছিল।
প্রায়
আশি ডিগ্রী কোণে উপরে উঠছিল শম্ভুরা চূড়াটাকে দখল করতে। অবিশ্বাস্যভাবে গুলি
বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল দু’শ মিটার আগে থেকে। শত্রুপক্ষ যে সত্যিই ঘাঁটি গেড়ে
থাকতে পারে, এই হিসেবটা বেজায় ভুল হয়ে গিয়েছিল এ তরফে। গন্ধের ব্যাপারটা তখন থেকেই
বিশ্বাস করে শম্ভু। সবার, সব কিছুর আলাদা গন্ধ আছে। ছোট করে ছাঁটা চুলগুলোতে হাত
বুলিয়ে সিঁড়ির দিকে দু’পা এগোতেই শম্ভু থমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। টর্চ হাতে একটা
ছেলে নেমে আসছে ওপর থেকে।
পাশে
মেজর গিল রক্তে মাখামাখি হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল যখন, শম্ভুর সাথে সাথে সুবেদার হরিশও এগিয়ে এসেছিল
সাহায্যে। কিন্তু শম্ভু এই মুহুর্তে একা। ছেলেটা শেষের ঠিক দুটো সিঁড়ি আগে দেখতে
পেয়েছে ওকে। হাত থেকে টর্চটা পড়ার বিকট আওয়াজ হল প্রায় ফাঁকা বাড়িটায়। আর সেই
শব্দেই কি না জানা নেই, আরো তিনটে ছেলে দুদ্দাড় করে নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে। শম্ভুর
দিকে চোখ পড়তে থমকে স্ট্যাচু হয়ে গেল একেবারে। ঠিক যেমন শুনেছিল, ছয় ফিট মতো
লম্বা, সুদর্শন, হাতে ব্রোঞ্জের কড়া, গলায় টকটকে লাল স্কার্ফ, খুব ছোট করে ছাঁটা
চুল। মেজর এস মন্ডল, তেরো জে অ্যান্ড কে রাইফেলস্।
গুড়িগুড়ি
বৃষ্টিতে পিছল পাহাড়ী পাথুরে অসমানতায়, বারুদের বৃষ্টির মধ্যে হরিশ এগিয়ে এসেছিল
মেজর গিলকে সাহায্য করতে শম্ভুর সাথে। খোলা জায়গাটা থেকে হরিশকে ধাক্কা মেরে বড়
পাথরটার আড়ালে পাঠিয়ে দিয়েছিল শম্ভু, বলেছিল, তোমার ছেলেমেয়ে আছে হরিশ! গুলি
বৃষ্টির মধ্যে মেজর এস মন্ডলের সেটাই ছিল শেষ কথা।
ছেলে
চারটে অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে শম্ভুর সূক্ষ্মদেহ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। লাল
স্কার্ফটা পতাকার মতো দরজার পাশে রাখা যোদ্ধার মূর্ত্তিটার বর্শার ফলায় এমনভাবে
গেঁথেছিল, ঠিক যেন পাঁচ নম্বর পাহাড় চূড়ায় তিরঙ্গা!
(কার্গিল শহীদ ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার
জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখা)
সবুজ রঙের মেঘ
"চন্দননগর
স্টেশনে যখন ট্রেনটা এলো হাঁ হয়ে
গিয়েছিলাম। কেন জানিস? ট্রেনটার
রঙ ধবধবে সাদা আর তাতে ঠিক মাঝবরাবর কালো রঙের তিনটে করে স্ট্রাইপ। ঠিক
টটেনহ্যামের জার্সির মত। ট্রেনে ভিড় ছিল না,
আবার বসার জায়গাও ছিল না। পরের স্টেশনে উপরের বার্থ
থেকে একজন নামতেই, আমি
টুক করে পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে জায়গাটা নিয়ে নিলাম।
বার্থে শুয়ে পাশে লাগানো স্ক্রীণে জ্যাকি
চ্যানের সিনেমা দেখতে দেখতে যাচ্ছি, হঠাৎ বিকট একটা আওয়াজ!
ট্রেনটা বুলেটের মতো যাচ্ছিল। সাঁ সাঁ
করে। হঠাৎ থামতে সে কি ঝাঁকুনি! সবাই এর ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু
হয়ে গেল।
যা
বুঝলাম, ট্র্যাকে
মাইন পাতা ছিল। মাইন জানিস তো? দেশের বর্ডারে লাগানো থাকে। কেউ পা দিলেই, ধুম!
শেষ! এদিকে ট্রেনের সামনের দিকে দাউদাউ করে আগুণ জ্বলছে। আর লকলকে শিখাগুলো তীর
বেগে কামরা থেকে কামরায় ছড়িয়ে পড়ছে। বিষাক্ত গ্যাসে লোকজন সব কাশছে, দুর্বল হয়ে কামরার মেঝেতে গড়াগড়ি
খাচ্ছে। আমি কি করলাম জানিস? পকেট থেকে রুমালটা বার করে স্যাট করে নাকে বেঁধে নিলাম। আগুণ হু হু
করে এগিয়ে আসছে। ঠিক আমার আগে কামরাটায় পৌঁছে গেছে। কি করি! কি করি!
সামনের বন্ধ দরজাটা ধাক্কালাম প্রথমে।
খুলল না। চোখ গেল ইমারজেন্সি এক্সিটে। সেটাকে এক ঘুঁসি মেরে ভেঙে সোজা লাফ দিলাম
বাইরে!
স্পাইডারম্যানের
মতো ল্যান্ড করলাম নীচে। কিন্তু সে কি ভীষণ অন্ধকার। চোখ সয়ে গেল আগুনের আলোয়।
দেখলাম কি জানিস? দুহাত
দূরেই টানেলটার গায়ে একটা দরজা। তাতে একটা ইয়াব্বড় গোল স্টিয়ারিঙের মতো হাতল
লাগানো।
হাতলটাকে এদিক ওদিক করতেই খুলে গেল
দরজাটা। ট্রেনটা ততক্ষণে দাউদাউ করে জ্বলছে। কোনো লোক আর বেঁচে নেই। কিন্তু, না!
একজন আছে! ট্রেনের শেষের দিক থেকে এদিকেই এগিয়ে আসছে একটা লোক। লম্বা, বেশ চওড়াও।
আমাকে দেখতে পেয়েই হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, "কে ওখানে?"
পুরো ট্রেনে কেউ বেঁচে নেই, তাহলে এই লোকটা কে? এই তবে দুষ্টু লোকটা নয়তো?
লোকটা ততক্ষণে কাছে এসে গেছে বড় বড় পা
ফেলে। আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। পালাব?
নাকি অপেক্ষা করব?
শেষ
মুহূর্তে দরজাটা দিয়ে ঢুকে টেনে বন্ধ করে দিলাম। ক্লিক করে লক হয়ে গেল। লোকটা
ধামধাম করে দরজায় বাড়ি মারছিল। ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সরু প্যাসেজ মতো। এটা
কোথায় যায় কে জানে!
আমি
হাতড়ে হাতড়ে চলতে লাগলাম। স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ একটা। আর সেরকম ঠান্ডা। প্রচন্ড ভয়
লাগছিল। কিন্তু কয়েকপা গিয়েই আলো দেখতে পেলাম। মানে একটা খোলা দরজা। দরজার কাছে
পৌঁছে কি দেখলাম জানিস?
ঠিক যেন শূণ্যে ঝুলছি। অনেক অনেএএএক নীচে
একটা বিশাল নদী।
নীচের
দিকে তাকিয়েই মাথাটা ঘুরে গেল। সাঁতার জানি না যে ঝাঁপ দেব, এদিকে ফিরে গেলেও নির্ঘাত মৃত্যু।
ঠিক
এই সময়ে সোঁ সোঁ করে আওয়াজ শুরু হল বাইরে। ঠিক যেন ঝড় উঠেছে। আর দেখতে না দেখতে
একটা ইয়াব্বড় পাখি, আমাকে
ছোঁ মেরে তুলে নিল। কি বিশাল তার ডানা, একটা ঘরের মতো বড়। কি পাখি জানিস?
টেরোডাকটাইল! হাঁ করে আছিস কেন? নাম শুনিস নি?"
"বাবান,
ঘরে এসো! সন্ধ্যে হতে চলেছে।"
"যাই,
মা!"
বাবান তার শ্রোতাদের কর্তৃত্বের সুরে বলল, "লালু, ভুলু বাকিটা কাল বলব। এখন যা!"
বাচ্চা
নেড়ি দুটো কি বুঝল কে জানে, কেঁউ কেঁউ করে সায় দিয়ে দিল লেজ নেড়ে নেড়ে।